Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে - ৪১




   

    অন্তরালে 



       অর্ঘ্য ঘোষ 



( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



প্রিয়র বেশ মনে পড়ে বিকাল বেলায় পাড়ার মেয়েরা সব দল বেধে ' মাঠে ' যেতেন। রাতের বেলা যাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মাঠে যেতে না হয় তার জন্য শারীরবৃত্তিয় চাপ মুক্ত হতে বিকালে মহিলাদের ' মাঠে ' যাওয়াটা যেন প্রচলিত নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। অসুখ - বিসুখ  কিম্বা বাইরে কোথাও না গেলে সাধারণত কেউ ওই নিয়ম লংঘন করতেন না। ওই সময়টুকু তাদের যেন অন্যতম অবসর বিনোদন হয়ে উঠত। ' মাঠে ' যেতে আসতে তারা কত যে কথা বলতেন তার ঠিক নেই। বয়সের বেড়া ডিঙিয়ে সবাই যেন সমবয়সী হয়ে উঠতেন। যখন একেবারেই সে ছোট , তখন  অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সে'ও মাঝমধ্যে মায়ের পিছু নিত। আজও প্রিয়র আবছা মনে পড়ে , তখন সবার মুখের আগল খুলে যেত। পারস্পরিক হালো, ওলো, ওটে, হ্যাটে সম্বোধন করে এমন সব কথা বলতেন যাতে তাদেরই মুখ লাল হয়ে উঠত।  কখনও একে অন্যকে ঠেলা মেরে কিম্বা আঁচলে মুখ লুকিয়ে হেসে উঠতেন তারা। কথা বলতে বলতে সবাই ভুলেই যেত ছেলেমেয়েদের কথা। তারপর চোখ পড়তেই পরস্পর ইশারা করে গলার স্বর নামিয়ে নিতেন। তখনই সে বুঝতে পারত এতক্ষণ যেসব কথা বলা হচ্ছিল তা তাদের শ্রবণযোগ্য নয়। অনেক সময় আবার আলোচ্য বিষয় বাচ্চাদের বোধবুদ্ধির বাইরে ভেবে তাদের উপস্থিতি আমল না দিয়ে সমান তালে আলোচনা চালিয়ে যেতেন।আর তারাও ভালোমানুষের মতো ওইসব কথা গিলত।মাকে অবশ্য খুব কম সময়ই বেলাগাম হতে শুনেছে সে।আজ যেন ছবির মতো তার চোখের সামনে সব ভেসে উঠছে। চাপ মুক্ত হয়ে দীঘিতে স্নান করে ভেজা কাপড় সপ সপ করতে করতে যে যার বাড়ি ফিরে আসতেন। তারপর প্রসাধন করতে বসতেন। প্রসাধন আর কি ? ফেরিওয়ালার কাছে কেনা সাধারণ কিছু প্রসাধনী।  তাতেই কি পরিপাটি করে নিজেকে সাজিয়ে তুলতেন মা। মাথায় নারকেলের তেল , পায়ে আলতা। শেষে সিথিতে সিঁদুর দিয়ে হাতের শাঁখায় ছুঁইয়ে সিঁথি আর কপালে ঠেকাতেন।  মাঝে মধ্যে সে পাশে বসে মায়ের সাজা দেখত। সাধারণ প্রসাধনেই কি অসাধারণ দেখাত মাকে। ঠিক যেন দেবী প্রতিমা। মা তাকেও যত্ন করে সাজিয়ে দিতেন।  ওইভাবে সিদুর ছোঁওয়াতে দেখে সে একদিন কারণ জিজ্ঞেস করেছিল। মা মিস্টি হেসে বলেছিলেন , স্বামীর মঙ্গল কামনায় সব মেয়েরাই এটা করে। তোর বউ এসেও করবে দেখিস। বলেই মা তার গাল টিপে দিয়েছিলেন।
সে লজ্জায় বলেছিল -- ধ্যাৎ।
--- ধ্যাৎ কি রে ?  
--- না , আমার বৌ আসবে না।আমার মা থাকলেই হবে। বলেই সে মাকে জড়িয়ে ধরে ছিল।
মা'ও তাকে বুকে চেপে ধরে বলেছিলেন -- তাই বুঝি ? 
---- হুউ।
--- তাই বললে কি হয় বাবা ? আমি কি সারাজীবন থাকব ?
মাকে কথা শেষ করতে দেয় নি সে। দুহাত দিয়ে মায়ের মুখ চেপে ধরেছিল। মা হাঁফিয়ে উঠে বলেছিলেন --- ওরে ছাড় ছাড়। বেশ বেশ থাকব। তোদের ছেড়ে কোথাও গিয়ে আমিও যে শান্তি পাব না।
সেই মা আজ তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। মা কি তাদের ছেড়ে খুব অশান্তিতে রয়েছেন ? সে মনে মনে বলে মা গো , তুমি যেখানেই থাক শান্তিতে থাকো, সুখে থাকো। নাহলে আমরাও যে শান্তি পাব না। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে বার বার তার চোখ ভিজে যায়। বাড়িতে পৌঁচ্ছে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে সৌরভ , মধুরিমা তাকে আর স্বাতীকে কোলে করে গাড়ি থেকে নামায়। অতসীকাকী তাদের বরণ করে ঘরে তোলার জন্য বরণডালা নিয়ে এগিয়ে আসেন। আর সেই মুহুর্তেই মায়ের মুখটা আরও একবার প্রিয়র চোখের সামনে ভেসে ওঠে।তার মনে হয় আজ মায়েরই তো তাদের বরণ করে ঘরে তোলার কথা। সেই কথা মনে হতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে।একহাতে বরণডালা নিয়ে প্রিয়কে বুকে চেপে ধরে অতসীকাকী বলেন -- তোমার কষ্টটা বুঝি বাবা। কিন্তু আজকের দিনে কান্নাকাটি করলে উপর থেকে মা'ও যে কষ্ট পাবেন। তাছাড়া আজ তোমার হাত ধরে যে নতুন জীবনে ঢুকতে চলেছে তার কথাটাও ভাব। তুমি কান্নাকাটি করলে সে'ও যে কষ্ট পাবে।




                                            অগত্যা নিজেকে সংযত করে প্রিয়। স্ত্রী আচারের মধ্যে তাদের বরণ করে ঘরে তোলেন অতসীকাকী।সুরোপিসি, ভানুমতীজ্যেঠি, গঙ্গাধর বাবাজী--মাজীরা একে একে এসে তাদের আর্শিবাদ করে যান। গ্রামের প্রায় সমস্ত লোকই তার সঙ্গে দেখা করে যান। নিছক  নিমন্ত্রণ রক্ষাই নয় , তারা যে আন্তরিকতার টানেই এসেছেন তা তাদের আচার আচরণ দেখেই বুঝতে পারে প্রিয়। যে যেমন ভাবে পারছে হাত লাগাচ্ছে। যেন নিজের বাড়ির বিয়ে। গ্রামের মানুষের আন্তরিকতা খুব ভালো লাগে তার। সেই আন্তরিকতার টানেই সবাই প্রিয়দের তাদের সঙ্গে খাওয়ার আবদার করেন। তাদের আবদারেই প্রিয়রা একাসনে সবার সাথে খেতে বসে। খাওয়া দাওয়ার পর বাড়ি যাওয়ার আগে আরও একবার করে প্রিয়র সঙ্গে দেখা করে যান সবাই। গ্রামের লোকেরা তো বটেই বাবাজী-মাজী পর্যন্ত প্রিয়র হাত ধরে বলে যান , কোন কিছু প্রয়োজন হলে তাদের জানাতে যেন দ্বিমত করা না হয়। প্রিয়ও তাদের হাতে হাত রেখে বলে , আপনারই আমার আপনার জন। আপনাদের জানাব না তো কাকে জানাব ?
বিয়ের ঝামেলা চুকতে না চুকতেই এসে পড়ে দ্বিরাগমনের পালা। দ্বিরাগমনে যাওয়া নিয়ে প্রিয়র মনে কিছুটা দোদুল্যমানতা ছিল। মধুরিমাই তাদের একরকম  জোর করে পাঠিয়ে দেয়। বলে , আবার কবে যেতে পাবি , না পাবি তার ঠিক নেই। আমি থাকতে থাকতে একবার শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘুরে আয়।
সেই মতো নিয়ম রক্ষার্থে স্বাতীকে নিয়ে একদিনের জন্য শ্বশুড়বাড়ি থেকে ঘুরে আসে প্রিয়।তারা ফিরে আসতেই সৌরভ এসে একদিন মধুরিমাকে নিয়ে যায়।যাওয়ার আগে দাদার হাত ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে মধুরিমা। প্রিয়র চোখও ভিজে যায়।দু'জনকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে স্বাতীও কেঁদে ফেলে। মায়ের স্মৃতি পিছনে ফেলে রওনা দেয় মধুরিমা। আস্তে আস্তে স্বাভাবিকতা ফিরতে শুরু করে সংসারে। স্বাতীও শক্ত হাতে ধরে নেয় সংসারের হাল। তারই মধ্যে হাসপাতালে এসে পৌঁছোন ডাক্তারবাবু এবং নার্স দু'জন। এক্স-রে , ই,সি,জি সহ অন্যান্য পরীক্ষার মেশিনও পৌঁচ্ছে যায়। প্রিয়রা গিয়ে একদিন ডাক্তারবাবু আর নার্সদের সঙ্গে আলাপ করতে যায়। যাওয়ার সময় আলু,বেগুন, পটল, মুলো , পেঁপে এমন কি গরুর দুধও নিয়ে যায়। আলাপ পরিচয়ের পর সেগুলি ডাক্তারবাবু আর নার্সদের সামনে নামিয়ে রাখতেই ডাক্তার -- নার্সরা দাম দিতে আসেন। তারা তীব্র আপত্তি তোলে। প্রশান্তকাকা বলেন , আমাদের গ্রামে তো হাট-বাজার নেই। আপনারা নতুন এসেছেন , বিপাকে পড়বেন ভেবেই আনা। তাছাড়া এ তো সব আমাদের ক্ষেতের ফসল। গ্রামের মানুষ তার জমির ফসল প্রতিবেশীকে না দিয়ে খায় না। এখন থেকে আপনারা আমাদের প্রতিবেশী। তাই আপনাদের না দিয়ে খায় কি করে ? আর প্রতিবেশীর কাছে দামই বা নিই কি করে ? 
আর আপত্তি করতে পারেন না ডাক্তারবাবু। আন্তরিকতার সঙ্গে বলেন , হাট বাজার যখন নেই তখন আপনাদের কাছে থেকেই তো জিনিসপত্র নিতে হবে। কিন্তু বার বার একই ঘটনা ঘটলে আমরা  কিন্তু খুব বিড়ম্বনা পড়ে যাব। পরের বার থেকে দামটা কিন্তু আপনাদের নিতেই হবে। আপনার বরং সিস্টার আর আমার জন্য দুজন কাজের লোক যোগাড় করে দেন। 
প্রশান্তকাকা বলে , সে নিয়ে আপনাদের কোন চিন্তা করতে হবে। কাল সকালেই আপনাদের কাজের লোক পৌঁছে যাবে।
তারপর প্রিয়দের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন , সুরো আর ভানুদিদিকে কাজে লাগিয়ে দিলে কেমন হয় ? 
সবাই এক বাক্যে বলে , এর মতো ভাল আর হয় না। প্রসাদ মোড়লের আক্রোশে আজও কোন সরকারি সাহায্য পায় না ওরা।
ডাক্তারবাবু বলেন , অজিতবাবুর কাছে আপনাদের আন্দোলনের কথা শুনেছি। প্রিয়বাবুও শীঘিই আমাদের সহকর্মী হয়ে যোগ দেবেন বলে খবর পেয়েছি। উনি এলে খুব ভাল হবে। আপনাদের সহযোগিতায় আমরা হাসপাতালটাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করব।
ডাক্তারবাবুর কথা শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যান। প্রথম দেখায় ডাক্তারবাবুকে ভালো লেগে যায় তাদের। ডাক্তারবাবুর নাম ময়ূখ চৌধুরী। কথায় কথায় জানা যায় ডাক্তারবাবুও গ্রামের ছেলে। সবে পাশ করে বেরিয়েছেন।তার বাবা কিছুদিন আগে পর্যন্তও রিক্সা চালিয়েছেন। তাই ছেলে যখন জয়েণ্ট এন্টাস দিয়ে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ে বাবার মাথায়। তিনি তো ভেবেছিলেন যে কোন একটা চাকরি বাকরি জুটিয়ে নিয়ে সংসারের হাল ধরবে ছেলে। কিন্তু বাদ সাধেন  গ্রামের লোকজন। তারাই চাঁদা করে তাকে পড়িয়েছেন। তাই গ্রামের মানুষের প্রতি ডাক্তারবাবুর কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। তিনি মনে করেন গ্রামের মানুষের ওই ঋণ জীবনে শোধ হওয়ার নয়।  গ্রামের লোকেরা তার কাছে শুধু দাবি রেখেছিলেন , সপ্তাহে একটা দিন গ্রামে গিয়ে বিনা পয়সায় তাদের চিকিৎসা করতে হবে। আর তারই মতো একজন দুঃস্থকে পড়াতে হবে। শুধু সেই দাবি মেনেই নয় , সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেও প্রতি রবিবার গ্রামে যান তিনি। তার জন্য ২০/২৫ টি গ্রামের মানুষ প্রতীক্ষায় থাকেন। সবার চিকিৎসা করতে করতে দম ফেলার ফুরসত থাকে না তার। পাশের গ্রামের একটি ছেলেকে ডাক্তারিও পড়াতে শুরু করেছেন। তার আক্ষেপ কেবল একটাই , কিছুতেই বাবা-মা গ্রাম ছেড়ে আসতে চান না। তার চাকরি পাওয়ার পরও রিক্সা চালিয়েছেন। বার বার বলেও বন্ধ করতে পারেন নি ডাক্তারবাবু। বাবা নাকি প্রত্যুত্তরে বলেছেন, এতদিনের অভ্যাস ছাড়ি কি করে বল ? শেষে  ডাক্তারবাবুও বলেন ,  তাহলে আমিও আর ডাক্তারি করতে যাব না। বলেই গোঁ ধরে বসেন তিনি, তবেই নিরস্ত করা যায় বাবাকে। সেই আক্ষেপের সুর শোনা যায় ডাক্তারবাবুর মুখে। এমন একজন ডাক্তারবাবুর অধীনে কাজ করতে পারবে বলে মনটা খুশীতে ভরে যায় প্রিয়র।



  ( ক্রমশ ) 



    নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---


No comments:

Post a Comment