অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
শঙ্খকে সরিয়ে নিয়ে যান প্রশান্তকাকারা। প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে শঙ্খ না ফেরায় দুশ্চিন্তা বেড়ে যায় স্বাতীর। মেয়েকে ডেকে বলেন , মালা সাইকেলটা নিয়ে একবার যা না মা। তোর বাবাকে খাবার দিতে গিয়ে শঙ্খও ফিরল না। আমার মনটা কেমন যেন একটা কু ডাকছে।
মায়ের কথা মতো সাইকেল নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মালা। বাবার জন্য তারও খুব দুশ্চিন্তা হয়। হাসপাতালে গেটের মুখে পৌঁছোতেই প্রশান্তদাদুদের জড়িয়ে ধরে দাদাকে কাঁদতে দেখে বুকটা ধক করে ওঠে তার। বাবার যে কোন বিপদ হয়েছে তা নিয়ে আর কোন সংশয় থাকে না। সে দ্রুত সাইকেলটা একপাশে ফেলে দিয়ে দাদার কাছে পৌঁছোয়। আর বোনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে শঙ্খ। মালা শঙ্খকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে , ও দাদা বাবার কিছু হয়েছে ? কি হয়েছে বল নারে দাদা।শঙ্খকে কিছু বলতে হয় না।সুরোপিসিরা ঘটনার কথা খুলে বলে মালাকে। শঙ্খর মতোই মালা চিৎকার করে ওঠে -- না , আমি বিশ্বাস করি না। আমার বাবা এমন কাজ করতেই পারেন না। তার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে বোবা কান্নার মতো শোনায়। সেই সময় জনতার মধ্যে কলরোল ওঠে।
হাসপাতালের গেটে এসে পৌঁছোয় পুলিশের জিপ। কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে গিয়ে প্রিয়র কোমরে দড়ি বেঁধে জিপের দিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। দিনভর অমানুষিক মারধোরের পর তখন আর ভালোভাবে হাঁটার ক্ষমতাটুকু অবশিষ্ট নেই প্রিয়র। তাই চলতে চলতে পড়ে যাচ্ছিল সে। পুলিশের অবশ্য সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা ওই অবস্থাতেই টানা হেঁচড়া করেতেই থাকে। বাবার ওই অবস্থা দেখে আর নিজেদের ধরে রাখতে পারে না দুই ভাইবোন। তারা ছুটে গিয়ে পুলিশের পা জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে , আপনাদের পায়ে ধরছি , বাবাকে ছেড়ে দিন। নাহলে বাবা মরে যাবে। আমাদের বাবা কিছু করার মানুষ নন।
আচমকা ছেলেমেয়ে দুটো ওইভাবে পায়ে জড়িয়ে ধরায় বিব্রত হয়ে পড়েন পুলিশ কর্মীরা। তারা ওসি আবীর বাগের দিকে তাকান। ওসি চোখে ইশারা করা মাত্রই পা ছাড়িয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দেন তারা। তারপর ফের প্রিয়কে টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু করেন।পড়ে গিয়েও বাবার যন্ত্রণার কথা ভেবে নিজেদের যন্ত্রণার কথা ভুলে যায় দুই ভাইবোন। বাবার পিছু পিছু ছুটে চলে তারা। কখনও বাবার হাত কখনও বা পুলিশ কর্মীদের হাত টেনে ধরে আটকে রাখার চেষ্টা করে। আর পুলিশ কর্মীরা তাদের ধাক্কা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয়। মর্মান্তিক সেই দৃশ্য দেখে প্রশান্তকাকা- সুরোপিসিরা কেঁদে ভাসান।
সেই সময় এসে পৌঁছোয় সংবাদ মাধ্যমের গাড়ি। সবাই কৌতুহলী হয়ে সেদিকে দৃষ্টি ফেরায়। আর্যর সঙ্গে গাড়ি থেকে নামেন একদল সাংবাদিক। আর্যকে দেখে একবুক আশা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঘটনার কথা বলে প্রশান্তকাকারা। আরতির সঙ্গেও কথা বলে আর্য। আরতি যথারীতি ছেঁড়া ব্লাউজ দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আর এক ধাপ এগিয়ে সে আর্যর হাত ধরে বলে , আমরা গরীব বলে আমাদের ইজ্জতের কি কিছু দাম নেই ? আপনারাই এর বিচার করুন।
আরতির নিখুঁত অভিনয় দেখে মনে মনে পুলক অনুভব করে প্রসাদ মোড়লরা। তারাও আর্যর সামনে এগিয়ে গিয়ে বলে, সব কিছু তো নিজের কানেই শুনলেন। এবার জানোয়ারটার মুখোশ খুলে দেন দেখি।
কথাটা শোনার পর ঘটনাটা যে সাজানো আর তার পিছনে যে প্রসাদ মোড়লদের হাত রয়েছে তা আর্যর কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। তাই সে বিরক্তির সঙ্গে ' দেখছি ' বলে পুলিশের জীপের দিকে এগিয়ে যায়। প্রিয়কে তখন টেনে হিঁচড়ে জিপে তোলার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে পুলিশ। আর সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে শুরু করে দিয়েছেন ফটোগ্রাফাররা। সেটা লক্ষ্য করে প্রিয় তাদের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করে বলে , দোহাই আপনাদের। আমার একটা কথা শুনুন , আমি নিরপরাধ। চক্রান্ত করে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।
তাই মিথ্যা খবর আপনারা ছাপবেন না। আমার ছেলেমেয়েরা স্কুল -কলেজে পড়ে। তারা কারও কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। সবাই ওদের আঙুল দেখিয়ে বলবে , ওই দেখ ওর বাবা শ্লীলতাহানি করে ধরা পড়েছে। স্ত্রীর দিকে আঙুল তুলে একই কথা বলবে সবাই। কেউ তো আর আসল কথাটা জানবে না। সংবাদ মাধ্যমের খবরকেই সবাই ধ্রুব সত্য মনে করবে। আত্মীয় স্বজনরাও মুখ ফিরিয়ে নেবে। দোহাই আপনাদের এত বড় ক্ষতি করবেন না। বিনা অপরাধে শুধু আমাকেই নয় , আমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েকেও সামাজিক শাস্তি ভোগ করতে হবে।
তারপর আর্যকে দেখে ফের সে বলে ওঠে , আর্যদা আপনি ওদের খবরটা করতে বারণ করুন না। দেখবেন একদিন অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হয়ে যাবে। আইন আমাকে কোন শাস্তি দিতে পারবে না। কিন্তু আপনারা যদি খবর করে দেন তাহলে তো আমার সামাজিক শাস্তি হয়েই যাবে। সেটা তো আর ফিরবে না। সারাজীবনের জন্য আমার গায়ে দাগ লেগে যাবে। সেই দাগ কি আর কোনদিন মুছে দিতে পারবেন আপনারা ?
প্রিয়র আকুতি নাড়িয়ে দেয় আর্যকে। সে মনে মনে ভাবে ঠিকই তো , আইনে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগে সংবাদ মাধ্যম বহু মানুষ সমাজের চোখে অপরাধী বানিয়ে দেয়। আইনে বেকসুর খালাস পেলেও তাদের সামাজিক শাস্তি হয়েই যায়। পরে আর কেউ তার খবরই রাখে না। সংবাদ মাধ্যমের এ বিষয়ে দায়বদ্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করে সে।
সেই উপলব্ধি থেকেই সে ওসিকে জিজ্ঞেস করে , আচ্ছা প্রিয়বাবুকে কি আপনারা অ্যারেষ্ট করছেন ?
আর্যর প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকান ওসি। তারপর কিছুটা বিদ্রুপের সুরে বলেন , কেন আপনার কি মনে হচ্ছে ওকে আমরা হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছি ?
---- না , বেশিরভাগ পুলিশ যে অতটা দয়ালু হন না তা আমি জানি। আমি জানতে চাইছি কোন অভিযোগ হয়েছে ?
--- অফ কোর্টস। এফ, আই, আর ' এর কপি আপনাদের দিয়ে দিচ্ছি।
সাংবাদিকদের হাতে এফ, আই, আর'এর একটা করে জেরক্স কপি তুলে দেন ওসি।সেটাতে চোখ বুলিয়ে আর্য ফের ওসিকে প্রশ্ন করে , কোন রকম ইনভেস্টিগেশন না করেই ওনাকে অ্যারেষ্ট করলেন ?
--- আপনাদের নিয়ে তো মহা মুশকিল মশাই। আপনারা কখন কি যে বলেন তার ঠিক নেই। এফ, আই, আর 'এর পর যদি কাউকে অ্যারেষ্ট না করি তখন তো আপনারাই ফোন করে করে অতিষ্ঠ করে তোলেন। তখন ইনভেস্টিগেশনের সময় পর্যন্ত দেন না। আপনাদের তো এফ,আই,আর নিয়ে কথা। এফ, আই, আর হলেই তো আপনাদের খবর হয়ে যায়। এফ, আই, আরের কপি তো পেয়ে গিয়েছেন। নিন এবার জম্পেশ করে খবর করুন না। খুব ভালো শিরোনাম হবে। ওই যে আপনারা সব কি যেন লেখেন না , পরীক্ষার নামে রোগিণীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে স্বাস্থ্য কর্মী গ্রেফতার।
গা এঁটো করা হাসি হেসে জিপে ওঠেন ওসি। প্রিয়কে নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় জিপ। শঙ্খ আর মালা 'বাবা-বাবা' বলে চিৎকার করতে করতে জিপের পিছনে পিছনে অনেকদূর পর্যন্ত ছুটে যায়। প্রিয়ও জিপের জানলা থেকে ছেলেমেয়েদের দিকে চেয়ে থাকে। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। দুরত্ব বাড়তে বাড়তে এক সময় মিলিয়ে যায় পুলিশের জিপ। আর তখন রাস্তার উপর গড়াগড়ি দিয়ে আকুলকান্নায় ভেঙে পড়ে দুই ভাইবোন।প্রশান্তকাকা , সুরোপিসিরা তাদের বুকে তুলে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
আর্য সান্ত্বনা দিতে গিয়েও কিছু বলতে পারে না। কি'ই বা বলবে সে ? আইনের মারপ্যাঁচ থেকে নির্ভেজাল একটি ভালোমানুষকে সে রক্ষা করতে পারল না। নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার। তাই মুখ লুকোতে সে ছেলেমেয়ে দুটোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে। হাসপাতাল চত্বর ছেড়ে বেড়িয়ে যায় সংবাদ মাধ্যমের গাড়ি।
প্রশান্তকাকারা শঙ্খ আর মালাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে ফেরেন। ততক্ষণে কানে কানে স্বাতী কাছেও খবরটা এসে পৌঁচেছে। খবর পেয়ে এসে পড়েছে সৌরভ আর মধুরিমাও। সবাই হাহুতাশ করে। স্বাতী শুধু রান্নাচালার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে সমানে বিড় বিড় করে চলে। আর মাঝে মাঝে দেওয়ালে মাথা ঠোঁকে। সকাল থেকে তারও পেটে কিছু পড়ে নি। রান্না করা খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে রান্নাশালে। মাথা ঠুঁকতে ঠুঁকতে সেই খাবারের উপরেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে সে। চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে তার চেতনা ফেরানো হয়। পাগলের মতো লাগে তাকে। মধুরিমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকে সান্ত্বনা দেয় , দেখিস দাদার কিছু হবে না। কালই তোর দাদারা কোর্টে যাবে। দাদা ঠিক জামিন পেয়ে যাবে। স্বাতী চুপ করে শোনে সেই কথা। কিন্তু তার মন মানে না। সে অবোধ্য ভাষায় বিড়বিড় করেই চলে। সুরোপিসিরা তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। মধুরিমা খুব সংকটে পড়ে। বাড়িতে শ্বশুর - শাশুড়ি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রয়েছেন। এদিকে স্বাতীর এই অবস্থা। কাকে ফেলে কাকে দেখবে সে ? মধুরিমার শ্বশুর-শাশুড়ির কথা অজানা নয় সুরোপিসিদের। তাই মধুরিমার উদ্বেগ লক্ষ্য করে তারই বলে , তুমি কোন চিন্তা কোর না। আমরা তো আছি। আমরা এদিকটা সামলাচ্ছি। তুমি বাড়ি যাও।
তবু স্বাতী, ভাইপো-ভাইঝিদের এই অবস্থায় ফেলে যেতে মন চাই না তার। কিন্তু শ্বশুর -শাশুড়ির কথা ভেবে সুরোপিসিদের উপর ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে ফিরে যেতে হয় তাদের। প্রশান্তকাকারাও প্রিয়র বাড়িতে থাকার দায়িত্ব নেন। ঠিক হয় পরদিন সকালেই সৌরভ চলে আসবে। তারপর প্রশান্তকাকা আর ঋজুদের নিয়ে বোলপুর আদালতে যাবে। ওই কথা শুনেও কোন ভাবান্তর ঘটে না স্বাতীর। সুরোপিসিরা চেষ্টা করেও তাকে কিছু খাওয়াতে পারে না।এক সময় খিদে ক্লান্তিতে রান্নাশালেই এলিয়ে পড়ে সে। মায়ের ওই অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে ছেলেমেয়েরা। তারা মাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়।
আর্যরও মনটা ভালো নেই। তার চোখের সামনে প্রিয়র আকুতি ভরা মুখটা বার বার ভেসে ওঠে। লাঞ্ছনা - যন্ত্রণা ছাপিয়ে সেই মুখে ফুটে উঠেছিল তাকে নিয়ে খবর না আকুতি। গাড়িতে আসার সময় সে মনে মনে ঘটনাটি পর্যালোচনা করে। ওসি'র কথা উড়িয়ে দিতে পারে না। এফ, আই, আর'কেই তো তারা খরব করার একমাত্র ছাড়পত্র হিসাবে গণ্য করে এসেছে এতদিন। কেউ কারও বিরুদ্ধে এফ, আই, আর করে দিলেই হলো। তার ভিত্তিতেই খবর লিখে দিয়েছে তারা। কোনদিন এফ, আই, আর, এর সত্যাসত্য যাচাই করে দেখার প্রয়োজনও বোধ করে নি। ভাবে নি তাদের খবরের জেরে একটি পরিবারের সামাজিক অবস্থান কি হয়ে যেতে পারে ? কি
মাসুল দিতে হয় সেই পরিবারকে ? ওইভাবে খবর করা কি আদৌ ঠিক কাজ হয়েছে ? এতদিন এই আত্মজিজ্ঞাসার মুখে পড়তে হয় নি আর্যকে। এই প্রথম প্রিয়ই তাকে সেই আত্মজিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই সে ঠিক করে এবার থেকে অন্তত দায়বদ্ধতার সঙ্গে খবর করার বিষয়টি বিবেচনা করবে। অন্যান্য সাংবাদিকদেরও কথাটা বলে।প্রিয় দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত খরব না করার অনুরোধও জানায়। অনুরোধ জানায় জেলা প্রেস ক্লাবের সম্পাদক উমাশংকর মজুমদারকেও। সবাই বলে , হ্যা ব্যাপারটা ভেবে দেখা উচিত। সেই কথা শুনে মনে যেন কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পায় সে। প্রিয়র আর্জি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা সম্ভব হতে চলেছে ভেবে মনে জমে থাকা অপরাধ বোধ কিছুটা যেন হালকা হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ফের অপরাধ বোধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তার মন।
No comments:
Post a Comment