বহুরূপী দেখিয়ে তাক লাগিয়েছেন সুবল দাসবৈরাগ্য
অর্ঘ্য ঘোষ
গতানুগতিক বংশীধারী রাখালরাজা কিম্বা মুলো দাঁতেরতারকা রাক্ষসী নয় । নয় হাল আমলের হঠাৎবাবু কিম্বা ‘ ইয়াং লেডিও। ’ গতানুগতিকতার বেড়া ভেঙে বহুরূপী বিশ্ব দরবারে প্রশংসা অর্জন করেছেন সুবল দাসবৈরাগ্য। তার কখনও একই অঙ্গে কৃষ্ণকালী , কখনও বা নারী-পুরুষের বহুরূপী সাজ মানুষকে চমকে দেয়।শুধু এদেশেই নয় , বাইরের বহু দেশেও প্রভূত প্রশংসা পেয়েছে। তার ওইসব অভিনব সাজের কথা মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
১৯৪৩ সালের ৩ জুলাই জন্ম সুবলবাবুর।বর্তমানে নানুরের কুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা তিনি।কিন্তু একসময় তাদের আদি বাড়ি ছিল নানুরেরই শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামে। জন্মের চার মাস আগেই অকাল মৃত্যু হয় বাবা ষষ্ঠী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সমাজের নানা ঘাত প্রতিঘাত থেকেসন্তান এবং নিজেকে রক্ষা করতে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেন মা প্রয়াত দয়াময়ী দাস। নানান প্রতিকূলতায় চতুর্থ শ্রেনীর বেশি পড়াশোনা এগোয় নি তার।পেটের তাগিদে পনেরো বছর বয়সে নাম লেখাতে হয় যাত্রাদলে।সেই সময় যাত্রাদলগুলিতে মহিলাদের অভিনয়ের চল ছিল না।পুরুষেরাই মহিলা সেজে অভিনয় করতেন। তাতে যথসামান্য পারিশ্রমিক মিলত। সেই পারিশ্রমিকের জন্য সুবলবাবু নাম লেখান স্থানীয় গোপালনগরের মনসামাতা নাট্যসংঘে। সর্বপ্রথম ওই যাত্রাদলে ‘ চাঁদের মেয়ে ’ পালায় নায়িকা স্বর্ণময়ীর ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। তারপর বোলপুরেরমহামায়া অপেরা , শ্রীদুর্গা অপেরা সহ বিভিন্ন যাত্রাদলে মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কুমারী , মা থেকে দিদিমা সহ সব ধরণের মহিলা চরিত্রেই অভিনয় করেছেন তিনি। সব মিলিয়ে তার অভিনীত যাত্রাপালার সংখ্যা শতাধিক।
তিরিশ বছর বয়স পর্যন্ত যাত্রাদলেই মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেই কেটে যায়।যাত্রাদলে অভিনয় করতে করতেই কাকতালীয় ভাবে বহুরূপীদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।সেই দিনটার স্মৃতি আজও তার মনের মণিকোঠায় উজ্বল হয়ে আছে। সেবারে দলের সঙ্গে কোন একটি গ্রামে অভিনয় করতে গিয়েছিলেন। শিল্পীদের থাকার জন্য ক্লাবঘরে জায়গা বরাদ্দ হয়েছিল। সেই ক্লাবঘরেই তার হাতে আসে শরৎচন্দ্রের শ্রীনাথ বহুরূপীর গল্পের বই। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর অন্যান্য শিল্পীরা যখন নিজের নিজের পাঠ মুখস্থ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তখন তিনি সময় কাটাতে বইটার পাতা উল্টোতে থাকেন।
পড়ে ফেলেন পুরো গল্পটি। শ্রীনাথ বহুরূপীর চরিত্র তাকে আকৃষ্ট করে। সেদিনই মনে মনে ঠিক করে ফেলেন বহুরূপী সাজবেন তিনি। যাত্রাদলে রঙ মেখে সঙ তো সাজতেই হয় , কিন্তু তাতে পেট ভরে না। তার উপরে দল মালিকের ধমকধামক তো আছেই। তাহলে স্বাধীনভাবে বহুরূপী সাজতে দোষ কোথাই ? বরং সে ক্ষেত্রে যাত্রাদলে রঙ মেখে সঙ সাজার অভিজ্ঞতা সহায়ক হতে পারে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। যাত্রাদলে ইস্তফা দিয়ে চারকলগ্রামের কানাইলাল চক্রবর্তীর কাছে বহুরূপী সাজার হাতেখড়ি হয় তার। দীর্ঘদিন তার তত্ত্বাবধানে গ্রামে গ্রামে বহুরূপীর সাজ দেখিয়ে বেড়িয়েছেন। নিজে স্বাধীনভাবে প্রথম সাজেন মা দুর্গা। তারপর কখনও কালী কখনও রঘু ডাকাত সেজে মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন। শুধু গ্রামে গ্রামে বহুরূপীর সাজ দেখানোই নয় , বহুরূপীর সাজে স্বাক্ষরতা , পণপ্রথা , পরিবার পরিকল্পনা , বাল্যবিবাহের মতো সমাজ সচেতনতামূলক প্রচারও করেছেন। লিখেছেন সংলাপ , বেঁধেছেন গানও। তার নিজের জীবন নিয়ে লেখা স্বাক্ষরতা বিষয়ক গান ‘ আমি লেখাপড়া শিখছি বুড়ো বয়েসে / তাই তো ঘুরে বেড়ায় দেশ-বিদেশে / শিক্ষার কতই না মানসম্মান / শিক্ষা দেয় আলোর সন্ধান / শিক্ষা না হলে কেমনে যাবি বিদেশে / তাই বলি লেখাপড়া পড়া করগে বুড়ো বয়সে ’ একসময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
গ্রামগঞ্জে বহুরূপীর সাজ দেখিয়ে বেড়াতে বেড়াতেই বিশ্ব দরবারে লোকায়ত শিল্পটিকে তুলে ধরার তাগিত অনুভব করেন তিনি। কিন্তু গতানুগতিক বহুরূপীর সাজ দেখিয়ে যে বাইরের দেশের মানুষকে খুশী করা যাবে না তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। তাই তিনি মাথা খাটিয়ে উদ্বাবন করেন ভিন্নধারার বহুরূপীর সাজ। একই অঙ্গে একদিকে নারী-পুরুষ , কৃষ্ণ-কালী , দেবতা-দানব , নবীন-প্রবীণ সেজে তাক লাগিয়ে দেন। তার ওই অভিনব সাজের কথা শুনে খড়দহ লিভিং সেন্টারের কর্ণধার প্রবীর গুহ বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের ডাইরেক্টর রাজীব শেঠির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। রাজীববাবু তাকে ভারত উৎসবে বহুরূপী প্রর্দশনের জন্য নির্বাচন করেন।
১৯৮৫ সালে প্রথম ওয়াসিংটনে আয়জিত ভারত উৎসবে এদেশের লোকায়ত শিল্পটিকে তুলে ধরেন সুবলবাবু। সেবারে অর্ধ নারীশ্বর সাজ দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। তারপর ১৮৮৮ সালে দিল্লীর সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি , ১৯৮৯ সালে লন্ডনের গ্লাসগো , ১৯৯১ সালে জার্মানি , তাসখন্দ , ১৯৯২ সালে মস্কো সহ বিভিন্ন দেশে তার উদ্ভাবনী সাজ দেখিয়ে বিশ্বের দরবারে এদেশের লোকশিল্পকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী থেকে শুরু করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রেগনের মতো বহু নামীদামী লোকের স্বাক্ষরিত শংসাপত্র এবং পুরস্কার আজও শোভা পায় তার বাড়িতে। ১৯৮৯ সালে স্বাক্ষরতা বিষয়ক সমাজসচেতনতা প্রচার অভিযানে বিশেষ ভূমিকা পালনের জন্য রাজ্যতথ্য সংস্কৃতি দফতর , ২০১১ সালে গ্রামীণ লোকশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।২০১৪ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে নিয়েছেন লালন পুরস্কার।
কুলিয়া গ্রামে সুবলবাবুর স্ত্রী , ছেলে , পুত্রবধু আর নাতিকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের অভাবের সংসার। দুই মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে ঘটিবাটিটুকু পর্যন্ত বিকিয়ে গিয়েছে। অর্থাভাবে ছেলে ধনেশ্বরের মাধ্যমিকের বেশি পড়া এগোয় নি। নাতি রাঘব চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। বিঘে দেড়েক জমি শেষ সম্বল ছিল। নাতনীর বিয়েতে সম্প্রতি তাও ঘুচে গিয়েছে। মাসিক এক হাজার টাকা শিল্পী ভাতাই তাদের গ্রাসাচ্ছাদনের একমাত্র অবলম্বন। তাই এই বয়সেও ছেলের পাশাপাশি সুবলবাবুকে গ্রামে গ্রামে বহুরূপী দেখিয়ে বেড়াতে হয়।তবুও তার কোন আক্ষেপ বা অনুযোগ নেই। তার আক্ষেপ কেবল একটাই , বহুরূপী শিল্পীদের এহেন দুরবস্থা দেখে বর্তমান প্রজন্ম লোকায়ত ওই শিল্পটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এর ফলে শিল্পটির অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। তাই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে তিনি নিজের ছেলে এমন কি নাতিকেও তালিম দিচ্ছেন। খেলার ছলে মাঝে মধ্যে নাতিকেও সাজিয়ে দেয় বালগোপাল কিম্বা রাখাল রাজা।
সুবলবাবু নিজেও রাজা বাদশা অনেক সেজেছেন।কিন্তু দিন কেটেছে নিতান্তই নিরন্ন ফকিরের মতো। একসময় তাদের এমন দিনও গিয়েছে গ্রামে গ্রামে বহুরূপী দেখিয়ে চাল নিয়ে ফিরেছেন তারপর ভাতের হাঁড়ি চেপেছে।কিন্তু হাজার অভাব - অনটনেও বহুরূপী দেখিয়ে বেরানোর নেশা ছাড়াতে পারেন নি।ছেলেকেও প্রায়ই বলেন , যাই করিস না কেন , বহুরূপী দেখানো ছাড়িস না। সবাই যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে একদিন শিল্পটাই হারিয়ে যাবে।
বহুরূপী দেখিয়ে পেট না ভরুক , বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে তার ঝুলি। সেসব আজ তার কাছে স্মৃতির সঞ্চয় হয়ে রয়েছে। শ্রীনাথের গল্প পড়ে বহুরূপী হয়েছিলেন তিনি। শ্রীনাথের মতো বাঘ সেজে ‘ হালুম – হালুম ’ করতে গিয়ে তার লেজ কাটা যায় নি ঠিকই , কিন্তু তাকেও কম বিড়ম্বনার মুখেও পড়তে হয় নি।নানুরেরই ছাতিনগ্রামে একবার পাগলের সাজ দেখাতে গিয়ে গণপ্রহারের হাত থেকে কোন রকমে বেঁচে যান। সেবারে ওইগ্রামের লোকরা ছেলেধরা সন্দেহে তাকে গাছে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেন। সুবলবাবু হাত জোড় করে যত বোঝানোর চেষ্টা করেন ছেলেধরা নন , তিনি বহুরূপী। গ্রামের লোক তত মারমুখী হয়ে ওঠেন। তারা বলতে থাকেন , ধরা পড়ে অমন কথা সবাই বলে।
অগ্যতা হাল ছেড়ে ইষ্টনাম জপ করতে থাকেন তিনি। সৌভাগ্যক্রমে সেইসময় সেইদিকে যাচ্ছিলেন পরিচিত এক স্কুলশিক্ষক। জটলা দেখে কাছে গিয়ে তিনি গ্রামবাসীদের বলেন , আরে করেছেন কি ? এ আমাদের যে সুবলদাস বহুরূপী। তার কথা শুনে ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে সুবলবাবুর। গ্রামবাসীদের তখন অনুতাপের অন্ত নেই। বাড়ি থেকে সরবত করে এনে খাইয়ে সুবলবাবুর কাছে মার্জনা চেয়ে নেন তারা। এমনই হাজার স্মৃতি তার ঝুলি থেকে উঁকি মারে।
নিজের আর্থিক দৈন্যতা নিয়ে তার নিজের কোন অনুযোগ নেই।তার মতো শিল্পীদের অভাব নিত্যসঙ্গী হয় তা তিনি ভালো করেই জানেন। তাই তা নিয়ে তার কোন আক্ষেপ নেই।শুধু নতুন প্রজন্ম ওই শিল্পটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন , যারা টিকে রয়েছেন তারাও শিল্পটিকে ভিক্ষার মাধ্যম ছাড়া কিছু ভাবতে পারেন না বলেই তার আক্ষেপের অন্ত নেই। নিত্যনতুন ভাবনায় বহুরূপীকেও যে শিল্পসমৃদ্ধ করা যায় সেটাই কেউ ভাবেন না। তাই বহুরূপী আজও ভিক্ষার মাধ্যম হয়েই থেকে গেল। জ্বালাটা কুড়ে কুড়ে খায় তাকে।
----০----
No comments:
Post a Comment