Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

পুজোর পাঁচালি - রকমারি






                                                                        



 প্রয়োজন ফুরোলেও বীরভূমের বহু পুজোয় টিকে আছে প্রচলিত রীতি 


                                                                         




                         অর্ঘ্য ঘোষ 





দিন ফুরিয়েছে । ফুরিয়েছে প্রয়োজনও। তবুও বীরভূমের বহু পুজো ঘিরে প্রচলিত রয়েছে নানা সাবেকী রীতি। ওইসব সাবেকীয়ানাই জেলার দুর্গাপুজোর প্রাচীন ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে। জেলার দুর্গাপুজোয় চমকপ্রদ রীতিটি প্রচলিত রয়েছে নানুরে। ওই এলাকায় একত্রে সমস্ত পুজোর ঘট ভরার আগে একটি শুয়োর বলির প্রথা রয়েছে। কথিত আছে , একদা নানুর ছিল ধর্মবিদ্বেষী এক রাজার অধীনে। পুজো পন্ড করার জন্য ওই রাজার নির্দেশে তার অনুগামীরা অশুচি অবস্থায় ভরা ঘট ছুঁয়ে দিতেন। তার ফলে পুজো বন্ধ হয়ে যেত। রাজার ওইসব অনুগামীদের কাছে শুয়োর অস্পৃশ্য হিসাবে গণ্য হতো। ওই অস্ত্রকে কাজে লাগিয়েই পুজো পন্ড করার অপচেষ্টা রুখে দেন তদানীন্তন পুজো কর্তারা। তারা পুকুর পাড়ে একটি শুয়োর বলি দেন। তারপর সেই শুয়োরের পায়ে ধরে  মাথার উপরে ঘোরাতে থাকেন। চক্রাকারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে শুয়োরের রক্ত। রক্ত গায়ে লেগে যাওয়ার আশংকায় রাজার অনুগামীরা দূরে সরে যেতে থাকেন। সেই সুযোগে ঘট ভরে মন্ডপে ফেরেন পুজো কর্তারা।



   
                                        রাজা নেই , নেই সেই রাজরোষ। বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহে পুজো হয় নানুরে । কিন্তু শুয়োর বলির সেই প্রথাটি আজও রয়ে গিয়েছে। সেদিনের সেই প্রথাটিই এলাকার পুজো কমিটিগুলিকে একাত্ম করে রেখেছে। আজও সপ্তমীর সকালে শুয়োর বলির পর দ্যাওতা পুকুরে এলাকার সমস্ত পুজোর ঘট ভরে নিয়ে আসা হয়।ওই প্রথার মতোই নানুরে ভট্টাচার্য পরিবারের পুজোর একটি প্রথাও এলাকার অন্যান্য পুজোগুলিকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। তিন শতাধিক বছরের প্রাচীন ওই পারিবারিক পুজোয় জল ঘড়ি দেখে সন্ধিপুজোর ক্ষণ নির্ধারিত হয়। ওই পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে , এক সময় ঘড়ির অভাবে সন্ধিপুজোর ক্ষণ নির্ধারণ করার জন্য জলঘড়ির প্রচলন হয়েছিল। ওই পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে , ওই ভাবে সময় নির্ধারণের জন্য একটি জল ভর্তি গামলায় একটি ছোট্ট ছিদ্রযুক্ত তামার বাটি ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ছিদ্রটির পরিমাপ এমন ভাবে করা আছে যাতে প্রতি ২৪ মিনিটের মাথায় সেটি জলপূর্ণ হয়ে ডুবে যায়। ফের সেটিকে তুলে জল খালি করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবার বাটি তুলে ভাসানোর সময় একটি করে ঘণ্টাধ্বনি করা হয়। ওইভাবে ঘণ্টাধনি করতে করতে সন্ধিপুজোর ক্ষণ নির্ধারণ করেন বাটি পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি। ওই প্রক্রিয়াটি বলা হয় ‘ তামি ধরা। ’  নানুরে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পুজো হলেও সবার বলিদান হতো বিশালাক্ষী তলায়। জলঘড়ির নির্ধারিত সময় অনুযায়ী প্রথম বলিদানটি হতো ভট্টাচার্য পরিবারে। তারপর অন্যান্য পরিবারে। আজ আর ঘড়ির অভাব নেই। কিন্তু জলঘড়ি দেখে সন্ধিপুজোর ক্ষণ নির্ধারণের প্রথাটি রয়ে গিয়েছে। আর সেই সময় অনুযায়ী একই ভাবে বিশালাক্ষী তলায় রয়ে গিয়েছে বলিদানের প্রথাটিও।



                                      সন্ধিপুজোর ক্ষণ নির্ধারণের সাবেকী প্রথা প্রচলিত রয়েছে ময়ূরেশ্বরের কুন্ডলা মুখোপাধ্যায় পরিবারে। তিন শতাধিক বছরের প্রাচীন ওই পুজো এলাকায় জমিদার বাড়ির পুজো হিসাবে পরিচিত। একসময় ওই পরিবারে নিরাপত্তা এবং আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হতো বন্দুক। সেইজন্য একসময় একযোগে ১০/১২ টি বন্দুক দেগে সন্ধিপুজোর ক্ষণ নির্ধারিত হতো। বর্তমানে ওই পুজো তিন শরিকে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। আর অত বন্দুকও নেই। কিন্তু আজও বড়ো তরফের পুজোয় একটি বন্দুক দেগেই সন্ধিপুজোর ক্ষণ নির্ধারিত হয়। একই ভাবে বন্দুক দেগে সন্ধিপুজোর ক্ষণ নির্ধারণের প্রথা রয়েছে নানুরের আলিগ্রাম রায় পরিবারেও।



                               আমোদপুরের দে পরিবারে পুজো ঘিরে রয়েছে এক প্রচলিত বিশ্বাস। পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে , ১৭০২ সালে স্বপ্নাদেশ পেয়ে ওই পুজোর প্রচলন করেন মহানন্দ দে। স্বপ্নে দেবী নাকি তাকে স্বয়ং পুজো নিতে মন্ডপে হাজির থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। তার প্রমাণ স্বরূপ অষ্টমীর সন্ধিতে মন্ডপে সিঁদুর ছড়িয়ে রাখলে তাতে তার পদচিহ্ন ফুটে উঠবে বলে জানান। সেই মতো মণ্ডপে ছড়িয়ে রাখা সিঁদুরে নাকি দেবীর পদচিহ্ন ফুটে ওঠে বলে পরিবারের সদস্যদের দাবি। সেই বিশ্বাসে আজও অষ্টমীর সন্ধিতে মন্ডপে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সিঁদুর। সেই সিঁদুরে দেবীর চরণচিহ্ন ফুটে ওঠা দেখতে ভীড় জমান দূরদূরান্তের মানুষজন। সাড়ে তিন শতাধিক বছর আগে স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুজোর প্রচলন করছিলেন কীর্ণাহারের জমিদার কিশোরকুমার সরকার। ওই পুজো বর্তমানে সরকারবাড়ির পুজো হিসাবে পরিচিত। স্বপ্নাদেশ মতো ওই পরিবারের মুর্তিতে রয়েছে অভিনবত্ব। দেবীর দুটি হাত স্বাভাবিক হলেও অন্য হাতগুলি ছোট। দেবীর বাহন নরসিংহ। যার শরীর সিংহের মতো হলেও মুখটি ঘোড়ার মতো। দেবী ছাড়া একমাত্র কার্তিকের বাহন রয়েছে। স্বপ্নে দেখা সেই মূর্তিই আজও বহাল রয়েছে ওই পরিবারে। পুজো হয় তালপাতার প্রাচীন পুঁথিতে। ভোগেও রয়েছে অভিনবত্ব। ভাত , ডাল , ভাজাভুজি, পায়েস মিস্টির পাশাপাশি দেওয়া হয় কচু ডাঁটার শাক , মাছের টক আর আমড়ার চাটনি। 



                                     ভোগে অভিনবত্ব রয়েছে ময়ূরেশ্বরের সেকপুরের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে পুজোয়। প্রচলিত রয়েছে , ওই গ্রামের জমিদার রাখালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রা ছিলেন বৈষ্ণব। তাদের নিজে হাতে মুর্তিপুজোর চল ছিল না বলে অন্যান্য পুজোর মতো ওই গ্রামে দুর্গাপুজোও ছিল না। একবার দুর্গাপুজোয় অষ্টমীর দিন বিষ্ণুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির দরজায় একটি দুর্গাপ্রতিমার কাঠামো বন্যায় ভেসে এসে আটকে যায়। কাঠামোটি দেখে বিষ্ণুবাবু পড়েন মহা দুশ্চিন্তায়। কাঠামো দেখে বুঝতে পারেন পুজো অসম্পূর্ণ অবস্থায় ভেসে এসেছে ওই কাঠামো। বিধিমতে কাঠামো পুজোর মাধ্যমে দেবী আরাধনা সম্পুর্ণ করা উচিত। কিন্তু পুজো করবেন কি করে ? সবার ঘর গৃহস্থালি ভেসে গিয়েছে বন্যায়। অন্যান্য উপকরণ দুরের কথা ভোগ রান্না করে দেওয়ার মতোও পরিস্থিতি নেই। অগত্যা কাঠামো আটকে রেখে বিষ্ণুবাবু ছোটেন জমিদার বাড়িতে। জমিদারবাড়ির অবস্থাও তথৈবচ। সব শুনে জমিদারবাবু বলেন , বাড়িতে পান্তাভাত , কলাই আর পোস্তবাঁটা রয়েছে। আমরা তো মায়েরই সন্তান। আমরা যদি ওই খেয়ে থাকতে পারি তাহলে মাকেও ভোগ হিসাবে তাই দেওয়া যেতে পারে। সেইমতো জমিদার বাড়ি থেকে পাঠানো হয় পান্তাভাত , পোস্ত আর কলাই বাঁটা পাঠানো হয়। সেই ভোগ দিয়েই নবমীতে কাঠামো পুজো করেন বিষ্ণুবাবু। পান্তাভাতের ভোগ দেওয়ার সেই প্রথাটি আজও রয়েছে।  



                     রাজা নেই , কিন্তু রাজার প্রচলিত পুজো রয়েছে ময়ূরেশ্বরের কুমারপুরে। প্রচলিত আছে , সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ময়ূরেশ্বরের ঢেকায় দুর্গা এবং কালীপুজোর প্রচলন করেছিলেন প্রজাবৎসল রাজা রামজীবন রায়। সেই পুজোর স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে একটি ভাঙা খাঁড়া। রাজা কালি এবং দুর্গাপুজোয় বলিদানের জন্য যমদণ্ড এবং কালদন্ড নামে দুটি বিশালাকার খাঁড়া তৈরি করিয়ে ছিলেন। সেই খাঁড়া দুটির মধ্যে পূর্ণাঙ্গটি রয়েছে জেলা প্রশাসনের হেফাজতে। ভাঙ্গাটি রাজপরিবারের বংশধর লাভপুরের হাতিয়া রায়চৌধুরী পরিবারে। ইতিহাস বলে , প্রথম বছরেই বলিবিভ্রাটের কারণে রাজপরিবারে দুর্গাপুজো বন্ধ হয়ে যায়। রাজা তার কুলপুরোহিত মৃত্যুঞ্জয় মিশ্রকে ওই পুজোর দায়িত্ব দেন। পুজো পরিচালনার জন্য বরাদ্দ করেন দেবোত্তর জমিও। রাজত্বের অবসানের পর রাজার বংশধররা ময়ূরেশ্বরের নওয়াপাড়া, লাভপুরের হাতিয়া এবং মুর্শিদাবাদের এঁড়োয়ালি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েন। সেখানে তারা স্বতন্ত্রভাবে পুজোর প্রচলন করলেও ঢেকায় তারপর থেকে আর কোন দুর্গাপুজো হয় না। কিন্তু রাজার দিয়ে যাওয়া সেই পুজোর দায়িত্ব আজও নিষ্ঠা ভরে করে চলছেন তারই কুলপুরোহিতের বর্তমান বংশধর ময়ূরেশ্বরের কুমারপুর গ্রামের মিশ্র পরিবার।


                               ---০---


     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                    


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  







দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে -----







                   ----০---






No comments:

Post a Comment