শিকড় সন্ধানী আদিত্য
অর্ঘ্য ঘোষ
বাউলের আখড়া থেকে পটুয়ার পর্ণকুটির। ব্রাহ্মণী নদীর আঁচল ছোঁয়া পল্লী থেকে শান্তিনিকেতনের খোয়াই। সাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতির সংকৃতির শিকড়ের সন্ধানে সেই বালক বয়েস থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন আদিত্য মুখোপাধ্যায়। সেই সন্ধান আজও চলছে নিরন্তর। প্রবীণ বয়সে আজও শিকড়ের সন্ধান পেলেই ঝোলা কাঁধে বেড়িয়ে পড়েন তিনি।
বর্তমানে ময়ূরেশ্বরের কোটাসুরের বাসিন্দা হলেও নলহাটি থানার ধরমপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। ১৯৫৮ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁর জন্ম। বাবা মঙ্গলময়বাবু ছিলেন পেশায় হাতুড়ে ডাক্তার। মা বিদ্যুৎলতাদেবী গৃহবধু। তিন ভাইবোনের বড়ো আদিত্যবাবু। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিকের পাঠ শেষ করে স্থানীয় কুরুমগ্রামের মিত্রভূম উচ্চতর বহুমুখী বিদ্যালয় থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেন। তারপর রামপুরহাট কলেজ থেকে বি,এ , বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম,এ পাশের পর মজঃফরপুরের আম্বেদকর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি,এইচ,ডি এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট উপাধি লাভ করেন। রামপুরহাটের নারায়ণপুর হাইস্কুলে অস্থায়ী শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু হয়। সেখান থেকে কিছুদিন নিজের স্কুল কুরুমগ্রামে অস্থায়ীভাবে শিক্ষকতার পর ময়ূরেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থায়ী শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। বছর খানেক আগে সেখান থেকেই অবসর নিয়েছেন। মাঝে সাড়ে তিনবছর অতিথি শিক্ষক হিসাবে ময়ূরেশ্বরেরই লোকপাড়া মহাবিদ্যালয়েও শিক্ষাকতা করেছেন। ওই কলেজের প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসটি তিনিই নেন।
বাল্যকাল থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি তাঁর লেখালিখির সুত্রপাত। দাদু প্রয়াত ত্রিপুরেশ্বরবাবু ছিলেন বরলার জমিদারদের নায়েব। নিয়মিত প্রবাসী-ভারতবর্ষ পত্রিকা পড়তেন। আদিত্যবাবুর জন্মের আগেই অবশ্য তার দাদু মারা যান। কিন্তু তার সেই পত্রিকাগুলো থেকে যায়। সেইসব পত্রিকা পড়েই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ জন্মায় আদিত্যবাবুর। বাবা ‘জীবনপ্রদীপ ’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। সেই বই প্রকাশিত হয় নি। কিন্তু সেই বই দেখে লেখালিখির নেশাটা আদিত্যবাবুকে পেয়ে বসে। অষ্টম শ্রেনীতে পড়ার সময় স্কুল ম্যগাজিন ‘ মিত্র রথ ’ এ শিক্ষক জয়গোপাল মন্ডলের উৎসাহে লেখেন প্রথম কবিতা। সেই কবিতার নাম আজ আর মনে নেই তাঁর। কেবল “ পথের কাঁটা সরিয়ে যারা চলে সমুখ পানে / একদিন তো জয়ের মালা তারাই জিতে আনে ’ চরণ দুটি মনে আছে।
আদিত্যবাবু মুলত কবি। কিন্তু কবিতার পাশাপাশি সমানতালে গল্প , উপন্যাস , প্রবন্ধও লিখেছেন। বলা যেতে পারে সাহিত্যের প্রতিটি ধারাই তাঁর সাবলীল বিচরণক্ষেত্র। দেশ , আনন্দবাজার , আজকাল , একুশ শতক , প্রসাদ , কোরক , নবকল্লোল , প্রতিক্ষণ , সৃজণ , শুকতারা , লোকশ্রুতি, কলেজ স্ট্রীট , স্বদেশ , নয়াপ্রজন্ম , দিদিভাই , প্রগতি সহ প্রায় ২ হাজার পত্রপত্রিকায় ৩ হাজারেরও বেশি লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
পাশাপাশি নিজেও ১৯৭৪ সালে দীপালি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেই পত্রিকাই পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণী এবং ব্রাহ্মণীর কাগজকুচি নামে প্রকাশিত হতে থাকে। অনিয়মিত হলেও এখনও সেই পত্রিকার প্রকাশ অব্যহত রয়েছে। ওই পত্রিকায় বহু নবীণ প্রতিভা আত্মপ্রকাশের সুযোগ লাভ করেছেন। প্রগতি , লোকমানস প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনার কাজও করে চলেছেন।
আনন্দ পাবলিশার্স , অমরভারতী , পুনশ্চ , পাণ্ডুলিপি , করুণা , নাথ , বোনা প্রভৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ৩৭ টি প্রবন্ধ , ১৮ টি কবিতা , ৩ টি উপন্যাস সহ ৬৭ টি বই। তার মধ্যে তারাশঙ্করঃ সময় ও সমাজ , অশ্বনামা , বাংলার বহুরূপী , লোকগানের শিকড় সন্ধান , আরশিনগর , ফুলমনি , বাংলার ডোকরা শিল্প অন্যতম। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি আকাশবানী কলকাতা কেন্দ্রে ৮৭ টি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য সংস্কৃতি ও মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগের অর্থানুকুল্যে বাউল ফকির , পট ও পটুয়া , রায়বেঁশে , বহুরূপী , ঘোড়া নাচ সহ সাতটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। আলোচক কিম্বা ‘ কী পার্শন ’ হিসাবে আদিবাসী সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি কেন্দ্র , সাহিত্য অ্যাকাডেমির , রাজ্য এবং উড়িষ্যার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি অনুষ্ঠান, দিল্লির শিশু সাহিত্য কর্মশালায় তার মুল্যবান আলোচনা কিম্বা বক্তব্য প্রশংসিত হয়েছে। বিভিন্ন সময় তার সম্পর্কে সুধীর চক্রবর্তী ‘ বাউলের বিশ্বকোষ ’ , দেবরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ‘তারাশঙ্কর গবেষণার পথিকৃত ’ , রামদুলাল বসু ‘ বাংলা সাহিত্যে আদিত্য থাকবে ’ সহ বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম মন্তব্য করেছেন।
সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক অবদানের জন্য সব মিলিয়ে তিনি ১৫০ টি পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে ‘ সি সি এ আই বাসভূমি পত্রিকা লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ’ , ‘তারাশঙ্কর সম্মাননা’ , ‘ ভ্রমণ সম্মাননা ’ , ‘ নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ সম্মাননা ’ , ‘ লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা সম্মাননা ’ উল্লেখযোগ্য ।
সুদীর্ঘ এই যাত্রাপথে প্রেরণাদাতা হিসাবে পেয়েছেন লক্ষ্মীনারয়ণ দত্ত , সুনীলবরণ বন্দ্যোপাধ্যায় , দিব্যজ্যোতি মজুমদার , সন্তু সেনগুপ্ত , বারিদবরণ ঘোষ , মঞ্জুলী ঘোষ , সৌমিত্র লাহিড়ি প্রমুখ শুভানুধ্যায়ীদের। সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চার সুবাদে পবিত্র সরকার , পবিত্র মুখোপাধ্যায় , রামকুমার মুখোপাধ্যায় , রেবতীমোহন সরকার , প্রেমেন্দ্র মিত্র , কবিতা সিংহ , আশুতোষ ভট্টাচার্য , প্রবোধ সান্যাল , হীরেন্দ্রনাথ দত্ত , প্রবোধচন্দ্র সেন , শান্তিদেব ঘোষ , কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় , অশোকবিজয় রাহা , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , শক্তি চট্টোপাধ্যায় , রামকিঙ্কর বেইজ , শিবনারায়ণ রায় , প্রকাশ কর্মকার প্রমুখ প্রথিতযশা মানুষজনের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। ওইসব ব্যক্তিদের লেখা হাজার খানেক অপ্রকাশিত চিঠি তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। ওইসব চিঠি সাহিত্যের মুল্যবান দলিল হতে পারে বলে তাঁর দাবি।
স্ত্রী বাসন্তীদেবী , দুই মেয়ে প্রার্থিতা আর পর্ণিকাকে নিয়ে আদিত্যবাবুর ছোট্ট সংসার। কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু সাহিত্য এবং সংস্কৃতিচর্চা থেকে ছুটি নেন নি। বরং আরও আঁকড়ে ধরেছেন। শিল্পসংস্কৃতির শিকড়ের সন্ধানে ক্ষেত্র সমীক্ষায় ছুটে যান পটুয়ার পর্ণকুটির থেকে বাউলের আখড়ায়। ওইভাবে শিকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে অনেক সময় বিপাকেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। একবার জামুরিয়ার কাছে একটি গ্রামে বহুরুপীদের সন্ধানে গিয়ে কয়লা মাফিয়াদের খপ্পড়ে পড়েন। কয়লা মাফিয়ারা তাঁকে সাংবাদিক ভেবে গুপ্তঘরে নিয়ে গিয়ে কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে ক্যামেরা , ব্যাগ , ডায়েরি সব কেড়ে নেয়। তারপর ডায়েরিতে তাঁর নামের আগে ‘ ডক্টর ’ লেখা দেখে বলে , অঃ আপনি ডাক্তার মানুষ তা আগে বলবেন তো।
আমরা ভাবলাম বুঝি চোরাই কয়লার খবর করতে এসেছেন। তাদের কাছে আর খোলসা করেন নি এই ‘ডক্টর’ সেই ‘ ডক্টর ’ নয়। সে যাত্রা ডিগ্রীর দৌলতে রক্ষা পান। ওইরকম বহু অভিজ্ঞতায় তাঁর ঝুলি ভর্তি হয়ে আছে। তবুও শিকড়ের সন্ধানের ছেদ ঘটে নি। পাশাপাশি সাহিত্যসভা থেকে বিভিন্ন সমাজকর্মে তাঁর দেখা মেলে। জেলায় একটি প্রত্ন সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করতে চান। সেই লক্ষ্যে প্রানপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর কথায় , লোকায়ত মানুষজনই আমার লেখার প্রেরণা। তাই লোকায়ত মানুষের শিকড়ের সন্ধানে আমি নিরন্তর ছুটে চলেছি। তাঁদের যেমন দেখেছি তেমনই লিখেছি। তাই আমাকে বানিয়ে কিছু লিখতে হয় নি। জেলার সাহিত্য কর্মীদের মতে , সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ক্ষেত্রসমীক্ষামূলক গবেষণাধর্মী লেখা এবং লোকসংস্কৃতির শিকড় সন্ধানে আদিত্য মুখোপাধ্যায় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পথিকৃত স্বরূপ।
No comments:
Post a Comment