তারাশঙ্করের নির্দেশে সেবার ব্রত পালন করছেন বিশুডাক্তার
( ছবি - সংগৃহিত )
অর্ঘ্য ঘোষ
আর পাঁচজন ডাক্তারবাবুর মতোই তিনিও সরকারি হাসপাতালে চাকরি নিয়ে চুটিয়ে শহরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে অনায়সেই বেছে নিতে পারতেন আয়েসী জীবন। কিন্তু সেসব তুচ্ছ করে বেছে নেন সেবার ব্রত। গ্রামের মানুষের চিকিৎসার দায়ভার তুলে নেন নিজের ঘাড়ে। ৯১ বছর বয়সে নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব আজও পালন করে চলেছেন বিশুডাক্তার। সেই দায়বদ্ধতা পালনের জন্যই জীবনকৃতি পুরস্কার লাভ করেছেন।
( সেইসব চিরকুট)
১৯২৯ সালের ২২ নভেম্বর বিশুবাবুর জন্ম। একসময় লাভপুরের মহুগ্রাম ছিল তাঁর বাড়ি। বর্তমানে লাভপুরেরই দত্তপাড়ার বাসিন্দা। বিশুবাবুর পোশাকি নাম সুকুমার চন্দ্র। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তাঁকে বিশুডাক্তার হিসাবেই সমধিক চেনেন। পাড়াটির নামও এখন হয়ে গিয়েছে বিশুডাক্তার পাড়া। বাবা শরৎচন্দ্র চন্দ্র ছিলেন লাভপুর যাদবলাল হাইস্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক। মা অমিয়সুধাদেবী গৃহবধু। পাঁচভাইবোনের চতুর্থ বিশুবাবুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় স্থানীয় কুইনটন ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে। পরে যাদললাল হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ইচ্ছা ছিল বি,এস,সি পাস করে বাবার মতোই আদর্শ শিক্ষক হবেন। কিন্তু একটি ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। একবার তাঁর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেইসময় লাভপুরে এলাকায় তেমন কোন ডাক্তার ছিল না বললেই চলে। তিনি ছুটে যান প্রায় ১০ কিমি দূরে ভোগপুর গ্রামে তদানীন্তন এক নামী ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারবাবু সব কিছু শোনার জানিয়ে দেন , ‘ আজ আর যাবো না। কাল সকালে যাবো।’ অনেক কাকুতি মিনতি করেও কোন লাভ হয় না। বিফল মনোরথে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। সেই দিনই মনে মনে ডাক্তার হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। তাই বি,এস,সি পড়ার পরিবর্তে ভর্তি হন তদানীন্তন কার্ল ম্যাক মেডিকেল কলেজ তথা অধুনা আর,জি,কর মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকেই এম, বি, বি, এস পাশ করেন। উচ্চ শিক্ষার্থে বিলেত যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। একই ইচ্ছা পোষণ করতেন বাবাও। তাই ছেলেকে বিলেত পাঠানোর জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু বিলেত যাওয়ার ইচ্ছাপূরণ হয়নি। আচমকা মৃত্যু হয় বাবার। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ঘাড়ে। সেইজন্য বিলেত যাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করে তাঁকে কাটনির অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির সিন্ধ্রি হাসপাতালে চাকরি নিতে হয়। কিন্তু ন্যায়নীতির সঙ্গে সমঝোতা করতে না পেরে একমাসের মধ্যে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসেন। ফের গোপালপুরে সাউথ ইর্স্ট্রান রেলওয়েতে মোটা মাইনের চাকরি পান।
১৯২৯ সালের ২২ নভেম্বর বিশুবাবুর জন্ম। একসময় লাভপুরের মহুগ্রাম ছিল তাঁর বাড়ি। বর্তমানে লাভপুরেরই দত্তপাড়ার বাসিন্দা। বিশুবাবুর পোশাকি নাম সুকুমার চন্দ্র। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তাঁকে বিশুডাক্তার হিসাবেই সমধিক চেনেন। পাড়াটির নামও এখন হয়ে গিয়েছে বিশুডাক্তার পাড়া। বাবা শরৎচন্দ্র চন্দ্র ছিলেন লাভপুর যাদবলাল হাইস্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক। মা অমিয়সুধাদেবী গৃহবধু। পাঁচভাইবোনের চতুর্থ বিশুবাবুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় স্থানীয় কুইনটন ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে। পরে যাদললাল হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ইচ্ছা ছিল বি,এস,সি পাস করে বাবার মতোই আদর্শ শিক্ষক হবেন। কিন্তু একটি ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। একবার তাঁর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেইসময় লাভপুরে এলাকায় তেমন কোন ডাক্তার ছিল না বললেই চলে। তিনি ছুটে যান প্রায় ১০ কিমি দূরে ভোগপুর গ্রামে তদানীন্তন এক নামী ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারবাবু সব কিছু শোনার জানিয়ে দেন , ‘ আজ আর যাবো না। কাল সকালে যাবো।’ অনেক কাকুতি মিনতি করেও কোন লাভ হয় না। বিফল মনোরথে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। সেই দিনই মনে মনে ডাক্তার হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। তাই বি,এস,সি পড়ার পরিবর্তে ভর্তি হন তদানীন্তন কার্ল ম্যাক মেডিকেল কলেজ তথা অধুনা আর,জি,কর মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকেই এম, বি, বি, এস পাশ করেন। উচ্চ শিক্ষার্থে বিলেত যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। একই ইচ্ছা পোষণ করতেন বাবাও। তাই ছেলেকে বিলেত পাঠানোর জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু বিলেত যাওয়ার ইচ্ছাপূরণ হয়নি। আচমকা মৃত্যু হয় বাবার। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ঘাড়ে। সেইজন্য বিলেত যাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করে তাঁকে কাটনির অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির সিন্ধ্রি হাসপাতালে চাকরি নিতে হয়। কিন্তু ন্যায়নীতির সঙ্গে সমঝোতা করতে না পেরে একমাসের মধ্যে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসেন। ফের গোপালপুরে সাউথ ইর্স্ট্রান রেলওয়েতে মোটা মাইনের চাকরি পান।
কিন্তু সেই চাকরিতে যোগদানে বাধ সাধেন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই দিনটার কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে বিশুবাবুর। তারাশঙ্কর ছিলেন তাঁর বাবার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। উভয় পরিবারে যাতায়াত ছিল। সেই সুবাদে বিশুবাবু ছিলেন তাঁর অত্যন্ত স্নেহভাজন। সেইজন্য গোপালপুরে চাকরিতে যোগ দিতে যাওয়ার আগে হাওড়া স্টেশনে মালপত্র রেখে টালা পার্কের বাড়িতে তারাশঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে যান তিনি। সব শুনে তারাশঙ্কর বলেন , ‘ তোমার চাকরি করতে যাওয়া চলবে না। তুমি চলে গেলে গ্রামের মানুষগুলো দেখবে কে ? ওরা যে সব বিনা চিকিৎসায় মারা পড়বে। যাও গ্রামে ফিরে গিয়ে ওদের সেবা করো।’
মূহুর্তের মধ্যেই তার চোখের সামনে সেদিনের সেই মায়ের রোগ জর্জ্জর মুখখানা ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে আরও অনেক যন্ত্রণাকিষ্ট মুখ। সেইসব মুখের কথা ভেবেই তিনি তারাশঙ্করের নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারেন না। সেবার ব্রত নিয়ে ফিরে আসেন গ্রামে। মাত্র ১ টাকা টিকিটের বিনিময়ে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা শুরু করেন। তারপরও বহুবার বহু লোভনীয় সুযোগ এসেছে।
কিন্তু গ্রাম ছেড়ে যান নি। আজও সেবামূলক মনোভাব থেকে চিকিৎসা করে চলছেন। তাঁর নির্দ্দিষ্ট কোন দর্শনী নেই। ৫০ টাকা থেকে শুরু করে যে যা দেন তাই নেন। না দিলেও ক্ষতি নেই। অর্ধেক রোগীকে বিনা পয়সায় দেখেন। এলাকায় আজ আর ডাক্তারের অভাব নেই। কিন্তু সেদিনের সেই বিশুডাক্তার আজও এলাকার মানুষজনের কাছে অন্যতম ভরসাস্থল হয়ে রয়েছেন।
জনসেবাতেও তার অবদান অনস্বীকার্ । ১৯৭৮ সালের বন্যা বিধ্বস্ত লাভপুর এলাকার বাসিন্দাদের জন্য সেন্ট জনস অ্যাম্বুলেন্সের তদানীন্তন চেয়ারম্যান রুসি বি গিমি’র সহায়তায় যাদবলাল মাল্টি পারপাস ভবনে চালু হয় ফ্রি ক্লিনিক। বিশুবাবু সেখানে স্বেচ্ছাশ্রমে চিকিৎসার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। ১৯৯৩ সালে সমাজকর্মী সুব্রত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় , চিকিৎসক দেবব্রত ভট্টাচার্যের
সহায়তায় নুন্যতম খরচে প্রসবের গড়ে তোলেন সেন্ট জনস প্রসূতিসদন। বিশুবাবু ওই সংস্থার সভাপতি এবং সুব্রতবাবু সম্পাদক ছিলেন। ওই সংস্থার পরিচালনায় গ্রামবাসীদের স্বেচ্ছা অনুদানের বিনিময়ে দীর্ঘ ৫ বছর ধরে বন্যাপ্রবণ শীতলগ্রাম এবং হাটকালুহা , মিরিটি , ব্রাহ্মণপাড়ায় সপ্তাহে একদিন ভ্রাম্যমান
চিকিৎসাকেন্দ্রও চালিয়েছেন। সেন্টজনস অ্যাম্বুলেন্সের উন্নতির জন্য স্বেচ্ছা অনুদানের টাকাটুকুও তুলে দিয়েছেন। একসময় তাঁরই উদ্যোগে প্রতিবছর বিনাখরচে চক্ষু পরীক্ষা এবং অপারেশন অপারেশন শিবিরও হয়েছে। দেওয়া হয়েছে চশমা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র।
গোপনে একটু আধটু লেখালিখিরও অভ্যাস রয়েছে । তবে প্রকাশে আগ্রহ তেমন একটা আগ্রহ নেই। কিন্তু তারাশঙ্করের বিভিন্ন রচনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর নাম। কোথাও তিনি বিশুডাক্তার আবার কোথাও আশুডাক্তার হিসাবে উল্লেখিত হয়েছেন। গরীব দুঃখীদের বিনা পয়সায় ওষুধ- পথ্যের দরবার হলে তারাশঙ্কর তার কাছে চিরকুট লিখে পাঠিয়ে দিতেন। অনেক সময় নিজে এসে ধরেও নিয়ে যেতেন রোগীর বাড়ি। বিশুবাবুকে নিয়ে ওইভাবে রোগীর বাড়ি যাতায়াত করতে করতেই তারাশঙ্কর খুঁজে পান সাহিত্যের অভিনব উপাদান। সেদিনের সেই ঘটনাও বিশুবাবুর মনের মণিকোঠায় অক্ষয় হয়ে রয়েছে।
একদিন ‘ শশে ডোমের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী’র চিকিৎসার জন্য বিশুবাবুকে তার বাড়ি নিয়ে যান তারাশঙ্কর। কিন্তু ‘ শশে ডোমের স্ত্রী ’ ‘ পরপুরুষ ’ ডাক্তারকে কিছুতেই মুখ দেখাতে রাজী হলেন না। খোদ তারাশঙ্কর পর্যন্ত তাকে বিস্তর বুঝিয়ে হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন। অগত্যা ওই বধুর পা দেখে রোগ নির্নয় করে ওষুধ দিতে হলো ডাক্তারকে। ওই ঘটনাকে অবলম্বন করেই তারাশঙ্কর লিখলেন তার বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ এ মেয়ে কেমন মেয়ে।’ শুধু তাই নয় , ‘আরোগ্য নিকেতন ’ উপন্যাস লেখার সময় তারশঙ্কর প্রায়ই টালা পার্কের বাড়িতে বিশুবাবুকে ডেকে পাঠাতেন। বিশুবাবুর সঙ্গে যেতেন তাঁর বন্ধু স্থানীয় চিকিৎসক বিশ্বনাথ রায়। তারাশঙ্কর তাদের কাছে থেকে ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে ব্যবহৃত চিকিৎসা সংক্রান্ত শব্দবন্ধ এবং তার ব্যাখ্যা জেনে নিতেন। ওই পরিচয়ের সূত্র ধরেই পরবর্তী কালে তারাশঙ্করের ছোট মেয়ে বাণীর সঙ্গে বিশ্বনাথবাবুর বিয়ে হয়।
তারাশঙ্করের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ স্বরূপ আজও তাঁর কাছে রয়ে গিয়েছে বেশ চিঠি এবং চিরকুট। তারাশঙ্কর ছিলেন উদার হৃদয়ের মানুষ। কলকাতা থেকে তাঁর বাড়ি ফেরার খবর পেলেই হাজির হতেন গরীব দুঃখী মানুষজন। তাদের অকাতরে সব বিলিয়ে দিয়ে কলকাতা ফেরার টাকাটুকু পর্যন্ত থাকত না তাঁর হাতে। তখন তিনি হয় নিজে হাজির হতেন কিম্বা চিরকুট পাঠাতেন প্রিয় বিশুর কাছে। তাঁর কাছে টাকা ধার করে কলকাতা ফিরে যেতেন।
সেইসব কথা বলতে গিয়ে আবেগে গলা বুজে আসে তাঁর। মায়ের কথা বলতে গিয়েও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেন। ১০০ বছর বয়েস পর্যন্ত বেঁচেছিলেন মা। শেষ দিন পর্যন্ত নিজে হাতে মায়ের সেবা করেছেন। তাঁর মাতৃভক্তির কথা এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তারাশঙ্করের স্মৃতি রক্ষার্থে ধাত্রীদেবতার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি প্রতিদিন তার রোগী দেখার প্রথম দর্শনীর টাকাটা তুলে দেন বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর হাতে।
বিশুবাবুর এক মেয়ে এক ছেলে । তাদের বিয়ে হয়েছে গিয়েছে । ছেলে সৌমিত্রবাবুও বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক। স্ত্রী রাধারানীদেবীকে নিয়ে লাভপুরের বাড়িতে থাকেন বিশুবাবু। এহেন সমাজিক অবদানের জন্য সাপ্তাহিক নয়াপ্রজন্ম পত্রিকা তাঁকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। অন্য একটি পত্রিকাগোষ্ঠী তাঁকে ‘ চিকিৎসা জ্যোতি ’ সম্মাননা এবং রাজ্য সরকার ‘ জীবনকৃতি ’ পুরস্কার
দিয়েছে। বিশুবাবু জানিয়েছেন , জীবনকৃতি পুরস্কার দেওয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রী আমার নাম জানতে চেয়েছিলেন। আমি নাম বলেছিলাম , বিশু ডাক্তার। উনি বলেছিলেন , লোকমুখে আপনার নাম শুনেছি। এর চেয়ে বড়ো প্রাপ্তি আর কি হতে পারে ? লোকের কাছে আমি বিশুডাক্তার হয়েই থাকতে চাই।
---০---
No comments:
Post a Comment