Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর - ১



      নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


      শুরু হল ধারাবাহিক উপন্যাস -- 








                     ভূমিকা 



শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। কালে কালে তাদেরও ভূমিকা পাল্টে যায়। পাল্টে যায় মানুষ গড়া এবং মানুষ হওয়ার সংজ্ঞাও। তার মাঝেও কেউ কেউ চিরন্তনী নীতি নিষ্ঠা আঁকড়ে থাকেন সারাজীবন। বৃহত্তর সমাজ তাদের ভাবাদর্শের কানাকড়ি মুল্য দেয় না। তবুও তারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে পারেন না। নিজস্ব ভাবাদর্শে মানুষ গড়ে চলেন। খুব কাছে থেকে দেখা তেমনই এক মানুষ গড়ার কারিগরের জীবনযন্ত্রণার কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে। শুধুমাত্র একজন শিক্ষকের জীবনযন্ত্রণাই নয় , বলা যেতে পারে একই জীবনযন্ত্রণার শিকার আরও অনেক মানুষ। যাদের কাছে ছেলেমেয়েদের মানুষ করার মুলমন্ত্রই ছিল শিক্ষা। সেইজন্য তারা সর্বস্ব পণ করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কিন্তু সমাজ তাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ বলে মান্যতা দেয় নি।  সমাজের চোখে কর্মসংস্থানের মাপকাঠিতে শিক্ষার সার্থকতা নির্ধারিত হয়। বাকিদের গায়ে সেঁটে দেওয়া হয় ব্যর্থতার লেবেল। স্রেফ টাকা কিম্বা প্রভাব প্রতিপত্তির দৌলতে চাকরি হাতিয়ে নেওয়া ছেলেমেয়েরা সমাজের চোখে তথাকথিত মানুষ হিসাবে পরিগনিত হয়। আর দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে পড়াশোনা করা মেধাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা সেই সুযোগের নাগাল না পাওয়ায় মুল্যহীন হয়ে যায়। তাদের শিক্ষার কোন গুরুত্বই থাকে না। সারাজীবন নীতি আর্দশ আঁকড়ে থাকা শিক্ষকটি মর্মে মর্মে সেই সার সত্যটি অনুভব করেন। তবুও নীতি আর্দশ বিসোর্জন দিতে পারেন না। তাই গোপনে চোখের জল ফেলেন। তারই মতো নীরবে চোখের জল ফেলে চলেন আরও অনেক বাবা-মা। লেখাপড়া শিখে মানুষ হওয়ার কথা শুনেছেন তারা। তাই ছেলেমেয়েকে মানুষ করার জন্য সর্বস্ব পণ করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কিন্তু চাকরি না পাওয়ায় সেইসব ছেলেমেয়েরা সমাজের চোখে মানুষের মতো মানুষ হয় নি। তাহলে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার প্রকৃত সংজ্ঞাটা  কি ? প্রকৃত শিক্ষা না চাকরি ? নিরন্তর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন অনেকে। তাদেরই কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। পেরেছি কতটুকু তা আপনারা বলবেন। ভুলত্রুটি হলে মার্জনা করবেন। নমস্কার। 





                            বই সম্পর্কে 



কালের কারিগর একটি শিক্ষক পরিবারের কাহিনী। পরিবারের কর্তা একজন নীতিনিষ্ঠ শিক্ষক। কর্ম নয়, শিক্ষাদান তার কাছে ধর্ম। সেই ভাবাদর্শে নিজের ছেলে-মেয়েকে মানুষ করেছেন। কিন্তু যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও  ছেলে একটা চাকরি জোটাতে পারে না। অথচ মামা-কাকা কিংবা টাকা পয়সার দৌলতে ছেলের বন্ধুরা চাকরি জুটিয়ে নেয়। সমাজ , সংসার এমন কি তার প্রেমিকাও তাই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পাড়াপড়শিরা তাকে ধর্মের ষাঁড় বিশেষণে আখ্যায়িত  করে। দিনের পর দিন সেই কথা শুনতে শুনতে একদিন ছেলেটিও নিজেকে অযোগ্য ভাবতে শুরু করে। অবশেষে সে মানসিক অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। সেই সময় সে জানতে পারে কর্মরত অবস্থায় বাবার মৃত্যু হলে মৃত শিক্ষকের পোষ্য হিসাবে চাকরিটা পাওয়া যেতে পারে। সেই পন্থাই সে অবলম্বন করে। কিন্তু ভাগ্যের জোরে বাবা বেঁচে যান। শেষ পর্যন্ত আদালতের হস্তক্ষেপে তার যোগত্যা প্রমাণিত হয়। মেলে শিক্ষকতার নিয়োগপত্রও। ততদিনে বাবা-ছেলে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ  হয়ে পড়েন। তাই তারা সরকারের দেওয়া চাকরি হেলায় 
প্রত্যাখ্যান করে শুরু করেন প্রকৃত মানুষ গড়ার কাজ।





               কালের কারিগর

              

                             অর্ঘ্য ঘোষ

                                                             
                  (  কিস্তি --- ১ )







শেষ পৌষের রাতে ঠান্ডাটা যেন জানিয়ে দিচ্ছে। ঘরের বাইরে পা রাখলেই মালুম হচ্ছে শীতের কামড় কাকে বলে। তাই বোধহয় আজ  নিত্যদিনের সান্ধ্য আসরের সঙ্গীরা কেউ আসে নি। একাই ঘরের ভিতরে চাদর মুড়ি দিয়ে বসেছিলেন মনোতোষবাবু। ঘরের ভিতর থেকেই শুনতে পান হরিমন্দিরের সামনে মধুছন্দা  সুর করে পৌষ আগলাচ্ছে --
এসো পৌষ, বসো পৌষ না যেও ছাড়িয়ে।
ছেলেপুলে ভাত খাবে সোনার থালা দিয়ে।।
সুরটা তাকে যেন মোহাচ্ছন্নের মতো টেনে নিয়ে যায় হরিমন্দিরের দিকে। সেই ছেলেবেলা থেকেই মেয়েদের সুর করে পাঁচালি, রামায়ণ পড়া তার খুব ভালো লাগে। মা -- ঠাকুরমারা যখন পড়তেন তখন সে চুপটি করে শুনত। সেই টানেই চুপি চুপি গিয়ে স্ত্রীর পিছনে দাঁড়ান তিনি। মধুছন্দার  গায়ে কোন শীতবস্ত্র নেই। পরণের কাপড়টাকে কোনরকমে গায়ে জড়িয়ে পৌষ আগলাচ্ছে।  আর শীতে হু হু করে কাপছে। মেয়েদের এই এক অভ্যাস। মাকেও ওইভাবে  শীতের রাতে  কাঁপতে কাঁপতে  পৌষ আগলাতে দেখেছেন মনোতোষ। ততক্ষণে স্ত্রীর পৌষ আগলানো শেষ হয়ে এসেছে। স্বামীর উপস্থিতি টের পেয়ে মধুছন্দা  বলে -- ওমা তুমি কখন এলে ?
মনোতোষ কোন কথা বলেন না। নিজের চাদরটা খুলে স্ত্রীর গায়ে জড়িয়ে দেন। আর গায়ে যেন চাদর নয়,  আসিড পড়েছে এমন মুখের ভাব করে মধুছন্দা  বলে ওঠেন - আহা করো কি, করো কি, দিলে তো  সব আকাচা করে।
--- হোক আকাচা , ঠান্ডায় বসে ঠক ঠক করে কাঁপছে। গায়ে একটা কিছু নিতে কি হয় ? এরপর ঠাণ্ডা লাগলে ভুগতে তো সেই আমাকেই হবে।
--- আর ওনার ঠাণ্ডা লাগলে বুঝি ভিন্ন গ্রহ থেকে সেবাদাসী এসে শুশ্রূষা করবে ?  এমনিতেই ঠাণ্ডা লাগার ধাত। সারারাত খুক খুক করে কাশবে। কতবার বলেছি সকালে একটু করে মধু আর তুলসীর পাতা খাও। তা কে শোনে কার কথা। আমি পরের বাড়ির মেয়ে বই তো নয়। নেহাত যাওয়ার সময় মা বলে গিয়েছিলেন , আমার ভোলেভালে ছেলেটাকে তুমি সামলে সুমলে রেখো মা। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে বলি। নাহলে কে আর রোজ রোজ এক কথা বলে মুখ বেকানি দেখতে যায়।
বলে মধুছন্দা  চাদরটা ফের স্বামীর গায়ে জড়িয়ে দেন। এবারে মোক্ষম ওষুধটা প্রয়োগ করতে হয় মনোতোষকে। তিনি বলেন, তুমি ঘরে যাবে ? না আমি পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাব তোমাকে ? ছেলেমেয়ে দুটো এখনও ঘুমোয় নি কিন্তু। তারা দেখে হাসাহাসি করলে আমি কিছু জানি না।
মনোতোষ জানতেন এই ওষুধের এক ডোজেই কাজ হবে। স্বামীর কথাটা শুনেই শশব্যস্ত হয়ে ওঠেন মধুছন্দা। আবেগ আপ্লুত গলায় বলে, সেটা যে তুমি ভালোই জানো তা কি আর আমি জানি না? সেই তো বিয়ের আগে থেকেই দেখে আসছি। চলো চলো ঘরে চলো, আমি আসছি।
বলে দুহাতে ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তুলসি তলায় প্রদীপ দেখান মধুছন্দা। তারপর  একহাতে বাতাস আড়াল করে প্রদীপটাকে  নিয়ে ঠাকুরঘরের দিকে ফেরেন। স্ত্রীর পিছনে পিছনে ফেরেন মনোতোষও। প্রদীপের আলোয় স্ত্রীর মুখটা দেবী প্রতিমার মতো লাগে তাঁর। ঠিক যেন ঘোষেদের ঘামতেল মাখানো দুর্গা প্রতিমার মতো মুখখানা।
       

               
                 মধুছন্দাকে  আদর করে ছন্দা  নামেই ডাকেন তিনি। মধুছন্দাও একান্তে তাকে মনো বলেন। কি আশ্চর্য মিল তাঁদের। কবেই তো ছেলেমেয়ের মা-বাবা হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। তবু আজও বিয়ের আগের মতোই একে অন্যকে চোখে হারান। বিয়ের আগে একদিন দেখা না হলেই  মনে হতো দিনটা যেন বৃথা গেল। আজও মনোতোষ বাইরে কোথাও গেলে শোবার ঘরে ডেকে ছন্দাকে আদর না করে যান না। আজও স্বামীর আদরে রাঙা হয়ে ওঠে মধুছন্দার  মুখ। আর সেই মুখখানা তুলে ধরে কিশোর বেলার মতো চেয়ে থাকেন মনোতোষ। মধুছন্দাও  স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে যেন ফিরে পান কিশোরী বেলা। 

     ঝাড়খণ্ড লাগোয়া মাধুনিয়া গ্রামে ছিল তাঁদের বাড়ি। নামের মতোই মাধুর্য্যে ভরা ছিল গ্রামখানি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে সুরবতী নদী। গ্রামের লোকের মুখে সুরবতী কবেই সুরমতী হয়ে গিয়েছে। তাঁরাও সুরমতীই বলতেন। ঝাড়খণ্ডের ধরণী পাহাড় থেকে সুরমতীর উৎপত্তি। এসব কথা ভূবনস্যারের কাছেই মধুছন্দারা  প্রথম শুনেছিলেন। ভূবনস্যার ছিলেন মহুরাপুর হাইস্কুলের শিক্ষক। ভূবনস্যারের কাছে টিউশানিও পড়ত মধুছন্দা। এমনিতে ভূবনস্যার টিউশানি করতেন না। কিন্তু কোন ছাত্রছাত্রী কোন বিষয়ে আটকে গেলে তাকে দেখিয়ে দিতে কার্পণ্য করতেন না। কিন্তু তার বাবা আর ভূবনবাবু ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। তাই অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার পরই বন্ধুর মেয়েকে পড়ানোর অনুরোধ ফেরাতে পারেন নি তিনি। নিজের বাড়িতেই ছেলে মনোতোষ আর তাকে একই সঙ্গে পড়াতেন। সেই থেকে মনোতোষকে সে মনোদা বলে ডাকত। মনোদা তখন পড়ত ক্লাস নাইন। টিউশানি পড়তে যাওয়া আসার সুবাদে ততদিনে মধুছন্দা  মনোতোষদের বাড়িরই একজন হয়ে উঠেছে। স্কুলে ভূবনবাবুকে স্যার বললেও বাড়িতে শুধুই কাকু বলত। মনোদার মা সাধনাকাকী থেকে শুধুই কাকীমা হয়ে যান। টিউশানি পড়া শেষ হলে কাকীমাকে সে সংসারের কাজে টুকটাক সাহার্য করত। স্কুলের রান্না করতে করতে কাকীমা বলতেন ,  আমার হাত জোড়া,  যা তো  তোর কাকুকে তেলটা ভালো করে মাখিয়ে দে তো মা।  নাহলে আর তেলই মাখবে না। শুধু গায়ে জল ঢেলেই স্কুলে ছুটবে।
সেও পরম যত্নে ঘষে ঘষে কাকুকে তেল মাখিয়ে দিত। কাকু তেল মাখা শেষ হলে কাকীমার উদ্দেশ্যে বলতেন , শুনছো, মায়ের আমার তেল মাখানোর হাতখানা খুব ভালো গো। ঘুম চলে আসছিল। তোমাকে হারিয়ে দেবে কিন্তু।
কাকীমা বলতেন , সে তো ভালোই হবে। মেয়ের কাছে হার যে মায়ের বড়ো গর্বের গো।
ওইসব টুকটাক কাজ সামলে  তার আর সবদিন বাড়ি ফেরা হত না। মাঝে মধ্যেই তাকে কাকীমার কাছেই খাওয়া-দাওয়া করে সরাসরি স্কুলে যেত হত। তাই একপ্রস্থ স্কুল ড্রেস মনোদাদের বাড়িতে রাখাই থাকত। তারপর খাওয়া-দাওয়া করে মনোদার সঙ্গে স্কুলে যেত সে।


             
   
           গ্রাম থেকে আরও অনেকেই যেত।  মনোদা অবশ্য সেসময় তাকে বিশেষ পাত্তা-টাত্তা দিত না। ক্লাসে বরাবর ফার্স্ট হত। তাই সবাই তার সংগে যেচে কথা বলত। মনোদাও তাদের সংগে হেসে হেসে কত কথা বলত।  তাই তার খুব অভিমান হত। রাগও হত। বিশেষ করে রুম্পাদির সংগে কথা বলতে দেখলে তো তার গায়ে জ্বালা ধরে যেত।
রুম্পাদি মনোদাদের সঙ্গেই পড়ত।পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু বেশ বড়ো সড়ো হয়ে উঠেছিল। আর কেমন যেন একটা গায়ে পড়া ভাবও ছিল। মনোদা অবশ্য প্রশয় দিতে না। আবার কিছু বলতও না। তাতেই রাগের পারদ আরও চড়ে যেত তার। তারই বহ্বিপ্রকাশ ঘটত টিউশানিতে। পড়তে বসার আগে মনোদা হয় অংকের খাতা খুঁজে পেত না , নয়তো জ্যামিতির বাক্স। তার তখন ভয়ে মুখ শুকিয়ে যেত। কারণ কাকু এমনিতে খুব ভালোমানুষ , কোন কিছু বুঝতে না পারলে বারবার দেখিয়ে দিতেন। কিন্তু পড়ার সময় পড়ার সরঞ্জাম না দেখতে পেলে ছেড়ে কথা কইতেন না। তাই মনোদা তখন তাকে খুব তোয়াজ করে বলত -- খুঁজে  একটু দেখতো   ছন্দা , কোথাই যে রেখেছি কিছু মনে করতে পারছি না। এরপর বাবার কাছে বকুনি খেতে হবে।
সে বলত, বকুনি খাওয়াই ভালো। রুম্পাদির সঙ্গে অত গল্প করলে তো কোথাই কি রেখছো তা প্রতিদিনই ভুলে যাবে।
তারপর রান্নাঘরের তাকে লুকিয়ে রাখা খাতা কিম্বা জ্যামিতির বাক্স বের করে এনে মনোদার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলত -- আর হারালে কিন্তু খুঁজে দিতে পারব না। মনোদা তখন তার দিকে সন্দিহান চোখে তাকালেও কিছু বলত না। কিন্তু বার কয়েক একই ঘটনা ঘটার পর কিছু হারালেই মনোদা তাকেই চোটেপাটে ধরত। সে যত অস্বীকার করত তত রেগে
যেত মনোদা। একসময় তার চুলে ধরে হিড়-হিড় করে রান্নাশালে কাকীমার কাছে টেনে নিয়ে যেত। সে তখন ' কাকীমা বাঁচাও , বাঁচাও বলে চিৎকার করে উঠত। কাকীমা রান্না করতে করতেই খুন্তি হাতে ছুটে আসতে আসতেই বলতেন , আবার দুটোতে হুটোপাটি শুরু করেছিস ? ওর চুল ছাড় , ছাড় বলছি ছিঁড়ে যাবে যে।
মনোদা বলত ,  না ছাড়ব না। ও আগে বলুক প্রতিদিন আমার বইপত্র লুকিয়ে রাখবে না।
সে বলত , না ও আগে বলুক, ও আর রুম্পাদির সঙ্গে কথা বলবে না।
---- না বলবো না, কথা বললাম তো তোর কি ?
----- বলবে তো বলবে, এরপর কিছু হারালে কিন্তু আমাকে আর কিছু খুঁজে দিতে বলো না যেন।
----- তুমি সরিয়ে না রাখলে হারাবে না।
---- সরিয়ে রাখতে আমার বয়েই গ্যাছে।
তাদের কথা শুনে অবাক হয়ে কাকীমা বলতেন , কেন কথা বললে ক্ষতি কি? ওরা তো একসঙ্গে  পড়ে।
--- না, আমার ভালো লাগে না। পড়ে তো আরও অনেকেই। কিন্তু তাদের সঙ্গে তো কই রুম্পাদিকে অত কথা বলতে দেখি না। রুম্পাদির সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনোদা আমার সঙ্গে একটাও কথা বলে না। কিন্তু আমিই তো মনোদার পড়ার ঘর গুছিয়ে দিই। খাবার সময় জলের গ্লাস এগিয়ে দিই। দিই না বলো ? কই রুম্পাদি তো এসব করতে আসে না। তাহলে তার সঙ্গেই বা এত কথা কেন। আর রুম্পাদিকে আমার মোটেও ভালো লাগে না।
তার কথা শুনে মুখ টিপে হাসতেন কাকীমা। তারপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতেন  , সত্যিই তো যে মেয়ে ঘর গুছিয়ে দেয়, জলের গ্লাস এগিয়ে দেয় তার সঙ্গে বেশি কথা না বলে অন্য মেয়ের সঙ্গে কথা বলাটা মনোর ভারী অন্যায়।
---- তবে বলো, আমার রাগ হবে না ?
--- হবেই তো, মনো অন্য কারও সঙ্গে কথা বললে তোর বুঝি খুব রাগ হয় ?
--- হু, খুবই রাগ হয়।
ফের মুখ টিপে হেসে কাকীমা বলেন , ঠিক আছে এখন পড়তে যা। তোর কাকাবাবু বসে পড়েছেন। পরে আমি সব ঠিক করে দেব।


                       পরে সব ঠিক করে দেওয়ার ঠিকঠাক মানেটা সেদিন  অবশ্য বুঝতে পারে নি ছন্দা । বুঝেছিল বেশ কয়েক বছর পর। কতদিন আগেকার কথা , অথচ মনে হচ্ছে এই তো যেন সেদিন কাকীমা কথাগুলো বললেন।
রুম্পার কথা মনে পড়তেই মধুছন্দার  মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। স্বামীর কোল ঘেঁষে  বসে সে বলে, হ্যা গো তোমার সেই রুম্পাদির কথা মনে আছে ?
---- মনে নেই আবার ? যা একখানা কান্ড করেছিলে তুমি।
সেই ঘটনার কথা মনে পড়তেই ফের লজ্জারাঙা হয়ে ওঠে ছন্দার  মুখ। চোখের সামনে সেদিনের সেই ঘটনা যেন ছবির মতো ভেসে ওঠে। রাগে অন্ধ হয়ে কি পাগলামিই না করেছিল সেদিন। গ্রামের প্রায় সব ছেলে মেয়েই সেসময় একসঙ্গেই স্কুলে যেত তারা। সুরমতী নদী পেরিয়ে স্কুলে যেতে হত তাদের।  নদীতে কোন সেতু ছিল। নদী পারাপারের মাধ্যম ছিল বাঁশের সাঁকো। একটা বাঁশ দিয়ে তৈরি সেই সাঁকো একে একে পার হতো তারা। সেদিন আগেই পেরিয়ে গিয়েছিল মধুছন্দা। রুম্পাদি যেই সাঁকোতে পা রেখেছে অমনি উল্টো দিক থেকে সাঁকোটা নাড়াতে শুরু করে সে। বলে , দেব দেখবি ফেলে ? তার ওই কান্ডে সেদিন সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। এমন কি রুম্পাদি নিজেও বুঝতে পারে নি তার ওই রকম করার কারণ। ভেবেছিল হয়তো সে মজা করছে। তাই বলেছিল ,  ওইরকম করিস না , এবার কিন্তু সত্যি সত্যি পড়ে যাব। কথায় আছে, পাগলকে কখনও সাঁকো না নড়ানোর কথা বলতে নেই। তাতে নাকি তার সাঁকো নড়ানোর উৎসাহ বেড়ে যায়। তারও বোধহয় তখন মাথায় পাগলামি ভর করেছিল। তাই সে আরও প্রবল বেগে সাঁকো নাড়ানো শুরু করে। আর ঠিক সেই সময় তার গালে এসে পড়ে এক থাপ্পড়। অজান্তেই মধুছন্দার  হাতটা গালে চলে যায়।



                              (  ক্রমশ )




     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                              ( ১ ) 
                                  


                                        ( ২) 





                      ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                   ( ৪ )


         



                       ( ৫ )

                            ( খেলার বই )


                                                                                 


                       ----০----


               





No comments:

Post a Comment