( কিস্তি ---- ৩৩ )
তাস্বত্ত্বেও জেনে শুনে কেন যে মানুষ বেআইনী কাজ করে কে জানে ? আসলে না ঠকলে তো মানুষের শিক্ষা হয় না।কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে ঠকার মাসুল গুনতে হয় অনেক বেশি। তাই কোথাও বিয়ের রাতেই বিয়ে ভাঙার কথা কানে এলে খুব খারাপ লাগে। অথচ সময়ে কাউকে সজাগ করাও যায় না। বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর যে কাউকে কিছু বলতে গেলে উল্টো ধারণা করে বসে থাকে। সবাই ধরেই নেন তার মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে হচ্ছে বলে হিংসায় বাগড়া দেওয়ার জন্য ওইসব আইনের কথা বলতে এসেছে। তারপর যদি চাইল্ড লাইনের কর্তারা অন্যভাবে খবর পেয়ে এসে বিয়ে ভেঙে দেয় তাহলে তো আর কথাই নেই। তারা ধরেই নেয় পিছন থেকে কলকাঠিটা সেই গায়ে পড়ে শুকনো উপদেশ দিতে আসা লোকটাই নেড়েছে। তারপর যত ক্ষোভ , অভিসম্পাত আছড়ে পড়ে সেই লোকটার উপরে।
মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। আক্রোশের আগুনে পুড়ে যায় ধানের পালুই। মাছের পুকুরে বিষ ঢেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে রুম্পার বাবা-মাকে অবশ্য কথাটা বুঝিয়ে বলতেই কাজ হয়। প্রথমে তো কথা পাড়তেই দেয় নি তারা। রুম্পার মা তো পড়ার কথা তুলতেই এক কথায় না করে দেয়। সাফ জানিয়ে দেয় , ঢের হয়েছে , আর লেখাপড়া করে কাজ নেই। এইবার দেখে শুনে একটা বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই বাঁচি।
জবাবে ভুবনবাবু বলেন , কিন্তু চাইলে তো এখনই মেয়ের বিয়ে তোমরা দিতেও পারবে না। ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেওয়ার কথা জানতে পারলেই প্রশাসন কিম্বা চাইল্ড লাইনের লোকেরা মাঝপথে তা আটকে দেবে। তখন কি হবে একবার ভাব তো ? খরচপত্র সব জলে তো যাবেই , মেয়েটার আর ভালোভাবে বিয়ে দিতে পারবে ?
কথাটা শুনেই কিছুটা দমে যান রুম্পার বাবা -- মা। মা বলেন , সরকারের আর দেখে বাঁচি না। নিয়মের বলিহারি। আমার মেয়ের বিয়ে আমি ইচ্ছামতো দিতেও পারব না ? কই আমাদের সময় তো এমন অদ্ভুত নিয়মকানুন ছিল না।সরকারের মেয়ে তো আর গলার কাঁটা হয়ে লেগে নেই। মেয়ের বাবা--মায়ের যন্ত্রনা ওরা বুঝবে কি করে ?
-- নিয়মটা কিন্তু অদ্ভুত নয় , বরং সময় এবং বাস্তবোচিত। অল্প বয়সে বিয়ে দিলে মেয়ের স্বাস্থ্যহানিই শুধু নয় ,পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা পায় না।
বাবাকে তো কাজের সন্ধানে বাইরে ঘুরে বেড়াতে হয় , তাই মাকেই সন্তানের শিক্ষার পাঠটুকু দিতে হয়। কিন্তু মা'ই যদি অশিক্ষিত হন , তাহলে সেই পাঠটা দেবেন কে ? তাছাড়া অল্প বয়সে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে আকছার প্রসুতি মা আর সদ্যজাত সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। সেইসব ভেবেই তো সরকার এই নিয়ম করেছে।সরকার যারা চালান তাদের বাড়িতেও ছেলেমেয়ে রয়েছে। তারাও আইন আওতার বাইরে নন।
একটানা কথাগুলো শুনে রুম্পার বাবার কিছুটা মনে ধরে। সে কিছু বলে না। কিন্তু রুম্পার মা বলে ওঠেন -- তাহলে বরং দু"বছর থাক। তারপরই না হয় বিয়ের ব্যবস্থা করা যাবে।
---- শুধু শুধু মেয়েটাকে ঘরে বসিয়ে রাখবে ?
--- তাছাড়া উপায়ই বা কি ?
--- আমি বলি কি দুবছরের আগে যখন বিয়েই দেওয়া যাচ্ছে না তখন ও বরং উচ্চমাধ্যমিকটা পাশ করুক।এখন ভালো ঘরে বিয়ে দিতে গেলে শিক্ষিত মেয়ে চাইছে। সব থেকে বড়ো কথা চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ তো রয়েইছে , আশা - অঙ্গনওয়ারির মতো বেশ কিছু প্রকল্পে শুধু মেয়েদেরই নিয়োগ করা হয়। খুব একটা বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা ওইসব কাজে লাগে না। কিন্তু ওইসব কাজে নিজের পায়ে দাঁড়ানো মেয়েরাও আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। তাদের বিয়ে নিয়েও বাবা-মা'কে বেশি ভাবতে হয় না।
এবারে মুখ খোলেন রুম্পার বাবা। নিরাসক্ত গলায় তিনি বলেন , সবই তো বুঝলাম মাস্টারমশাই। কিন্তু এ তো আর আমাদের গাঁয়ের ইস্কুলের পড়া নয় , বাড়িতে খেলো আর লেখাপড়া করে চলে এল। এবার পড়তে হলে তো সেই নলহাটি কিম্বা রামপুরহাট। একা সেখানে মেয়েকে রেখে কি করে পড়ায় বলুন তো ?
সমস্যাটা ভুবনবাবুও উপলব্ধি করেন।কাছাকাছি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবও নারী শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম বড়ো বাধা। সেই কবে থেকে তাদের স্কুলে উচ্চমাধ্যমিকের পঠনপাঠন চালু হওয়া কথা শুনছে , কিন্তু হল কই? মনোর পরীক্ষার পর বিষয়টি নিয়ে কিছু করা যায় কিনা একবার দেখবেন। তার বন্ধু অম্লান বিশ্বাস শিক্ষা দফতরে আছে। তাকে ধরে কিছু করা যায় কিনা দেখতে হবে। সমস্যার কথা স্বীকার করে নেন ভুবনবাবু। কিন্তু সহজে হাল ছাড়ার পাত্র তিনি নন। তাই তাকে আশ্বস্ত করে বলেন , বাইরে না গিয়েও পড়াশোনার বিকল্প ব্যবস্থা কিন্তু আছে। শিক্ষাদফতরের অনুমতি নিয়ে স্কুলে না গিয়েও এক্সটারনাল হিসাবে পরীক্ষা দেওয়া যায়।
---- কিন্তু কে ওইসব হ্যাপা পোহাবে ? আমি চাষাভুষো মানুষ। দম ফেলার ফুরসত পাই না। ওইসব দৌড়ঝাঁপ আমার পক্ষে করা সম্ভব হবে না।
--- আচ্ছা আমি যদি সব ব্যবস্থা করে দিই তাহলে ?
---- তাহলে আপত্তি নেই। আপনাকেই দায়িত্ব নিয়ে সব কিছু করতে হবে।
অগত্যা নিজের কাঁধেই সব দায়িত্ব তুলে নেন ভুবনবাবু। নলহাটি স্কুলের সঙ্গে কথা বলে আর অম্লানকে ধরে শিক্ষা দফতরের অনুমতি যোগাড় করে রুম্পার এক্সর্টান্যাল হিসাবে পরীক্ষা দেওয়ার সব ব্যবস্থা করেন তিনি। তাতে তাকে বিস্তর দৌড়ঝাঁপ করতে হয় বটে , কিন্তু রুম্পার আবদারটা রাখতে পেরে সেই ধকলটা কিছুই মনে হয় না। বিশেষ করে সেদিন ফেরার সময় একান্তে রুম্পা যখন তাকে প্রনাম করে বলে , আমি জানতাম স্যার আপনি আমার পড়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন। কথা শুনে বুকটা ভরে উঠেছিল তারা। যে ছাত্রছাত্রীরা তাকে এত ভরসা করে , যেকোন মুল্যেই তাকে সেই ভরসার জায়গাটা বজায় রাখতেই হবে। সেই রুম্পাকেই এবার তো তাকে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে।ঠিক মাধ্যমিকের মতোই রুম্পা এবারও তার সেই আত্মীয় বাড়িতেই থাকবে।সেটাই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভুবনবাবুর।
ওই পাড়াতেই আবার প্রভাতদেরও বাড়ি। মাধ্যমিকের পরীক্ষার সময় তো এতসব জানা ছিল না। তাই কোন সমস্যাও ছিল না। কিন্তু এবারে তো মনোকে নিয়ে সে প্রভাতদের বাড়িতেই থাকবে। সেক্ষেত্রে রুম্পাও হয়তো তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ওই বাড়িতে আসতে পারে। বিষয়টি যদি রুম্পার বাবা-মায়ের কানে যায় তাহলে তো তাকে দোষ পেতে হবে। ওদের মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগও ঘাড়ে চাপতে পারে। সে বড়ো বিড়ম্বনার ব্যাপার হবে। প্রসঙ্গটা সেদিন রাতে স্ত্রীর কাছে তোলেন ভুবনবাবু। সব শুনে সাধনা বলেন , এখন থেকেই অত ভাবছ কেন ? হয়তো দেখা যেতে পারে ওই যাওয়া আসাটাই তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার রাস্তা খুলে দিতে পারে। তুমি সুধাদি আর প্রভাতের সম্পর্কে যা বললে তাতে তো মনে হয় সব শুনলে রুম্পার বাবা-মাও শেষ পর্যন্ত ওদের বিয়েতে অমত করবেন না।
--- সত্যি গো ওরা সত্যিই খুব ভালো মানুষ। তাও তো তোমাকে আর একটা কথা বলা হয় নি। সেই কথাটা শুনলে তো তুমি ভাবতেই পারবে না সুধাদি কত বড়ো মনের মানুষ।
--- কি কথা গো , বলোই না শুনি।
স্ত্রীর পিড়াপিড়িতে তার বাজার করা আটকাতে সুধাদির সেই কৌশলটা সবিস্তারে খুলে বলতে হয় ভুবনবাবুকে। আর ঘটনাটা শুনেই হো-হো করে হেসে ওঠেন সাধনা। স্ত্রীর হাসি দেখে বিষ্মিত হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন ভুবনবাবু। নাইট ল্যাম্পের নীল আলোয় স্ত্রীকে কেমন যেন রহস্যমময়ী মনে হয় তার। কিছু বুঝতে না পেরে বলে বসেন , এতে হাসির কি হলো ?
---- আচ্ছা হয়েছে। ঠিক করেছেন সুধাদি।
---- মানে ?
--- মানে আমি একাই বোকা নয় মশাই। আমার স্বামীটাও একটা বুদ্ধুরাম। একজন মহিলাও তাকে আচ্ছা বোকা বানিয়ে দিয়েছেন।
বলেই স্বামীর বুকের কাছে আরও ঘন হয়ে তার নাকটা আলতো করে মুলে দিয়ে আবার হেসে ওঠে সাধনা। ভুবনবাবু আর কোন কথা বলতে পারেন না। সেদিন সুধাদির কাছে বোকা বনেছিলেন , আর আজ স্ত্রীর কাছে সত্যি কথাটা বলতে গিয়ে আরও একবার বোকা বনে গেলেন।
সাধনা চোখ পাকিয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন -- কথাটা ছন্দারা জানে ?
ভুবনবাবু না সুচক ঘাড় নাড়তেই সাধনা ফের হেসে বলে ওঠে -- তাহলে ভালোই হলো।
--- কি ভালো হল ?
--- এবার থেকে আমার পিছনে লাগলেই ছেলে মেয়েদের কাছে তোমার বুদ্ধু বনে যাওয়ার কথাটা ফাঁস করে দেব।
ওইভাবে সেদিন অনেক রাতপর্যন্ত খুনসুটি চলে দুজনের। ভুবনবাবু যেন সেদিন রাতে ফিরে পান তার সেই বালিকাবধূটিকে। সাধনাও সেই মুখচোরা লাজুক ছেলেটিকে নতুন করে আবিস্কার করেন। অনেকদিন পর সেই রাতে যেন অঝোর ধারায় সারা শরীর জুড়ে বৃষ্টি নামে।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment