Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৩৪





     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 












                 কালের কারিগর
              

                             অর্ঘ্য ঘোষ
                                 
                           ( কিস্তি -- ৩৪ ) 


অনেকদিন পর সেই রাতে যেন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। দেখতে দেখতে মনোতোষদের পরীক্ষা এসে পড়ে। ভুবনবাবুর মতোই গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও রামপুরহাটে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। মেয়ে বলতে রয়েছে একমাত্র রুম্পা। আর ছেলে রয়েছে ৫ জন। মনোতোষদের সংগে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ৬ জন। তার মধ্যে সৌমেন কম্পার্টমেন্টাল পেয়েছিল। ভুবন ভেবেছিলেন তিন মাসের মাথায় কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিয়ে হয়তো আবার মনোতোষদের সঙ্গে নেবে সৌমেন। কিন্তু সে আর সেই ধারে পাশে মাড়ায় নি। খুব খারাপ লেগেছিল ভুবনবাবুর। আগে হলে হয়তো ওদের বাড়ি গিয়ে একবার অন্তত বলতো পরীক্ষাগুলো দেওয়ার জন্য। কিন্তু রাম সেই ঘটনার পর ওদের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ায় সৌমেনের বাবা কুনালও তাকে দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রামও তো আর তার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখে। অথচ এখন প্রায়ই মেয়েকে নিয়ে সৌমেদের বাড়ি আসে। তার স্ত্রীও নাকি বার কয়েক ঘুরে গিয়েছেন। এর তার মুখে খবর পাই সৌমেন নাকি রীনাকে নিয়ে মোটর বাইকে চাপিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বারকয়েক তার চোখেও পড়েছে সেটা। সৌমেনও তাকে দেখে লজ্জা পাওয়া দুরে থাক , আরও ধোঁওয়া ছেড়ে বাইক হাকিয়ে দিয়েছে। যেন তাকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্যই এসব করেছে। সেই সময় মেয়েটাও ওর কোমর আঁকড়ে ধরেছে। খুব কষ্ট হয়েছে তার। কিন্তু কাউকে কিছু বলেন নি। শুনেছে সৌমেনের সংগে মেয়ের বিয়ে ফাইন্যাল করে ফেলেছে রাম।সৌমেনও নাকি এখন বাবার  পাথর খাদানের ব্যবসায় যাতায়াত শুরু করেছে। কোনটাই তার ঠিক মনে হয় নি। এই বয়সে পড়াশোনা ফেলে সৌমেনকে ব্যবসায় জুড়ে দিয়ে ওর বাবা ঠিক কাজ করেন নি বলেই মনে হয় তার। আর রামই বা কোন বিবেচনায় এই রকম মানসিকতার একটি ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিচ্ছে কে জানে ? কিন্তু অত ভাবার অবকাশও নেই তার। রামপুরহাটে যাওয়ার তাড়া রয়েছে। তারই মধ্যে আবার যাওয়ার আগে রুম্পাকে নিয়ে হাজির হন তার বাবা। তাকে দেখেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চান তিনি। কি হলো আবার ? সেটা লক্ষ্য করে রুম্পার বাবা বলেন , আপনাকেই  রুম্পাকে নিয়ে গিয়ে আমাদের আত্মীয় বাড়িতে পৌঁচ্ছে দিতে হবে। আসার সময় একেবারে নিয়েও আসবেন।
---- কেন তোমার যাওয়ার কি হলো ? 
---- আর বলবেন না , হঠাৎ করে একটা কাজ পড়ে গেল। তাই দেখলাম আপনি যখন যাচ্ছেন তখন আমি না গেলেও অসুবিধা হবে না। 
ভুবনবাবু মনে মনে বলেন , কাজ তো নয় রাজকাজ। কাজটাই বড়ো হল ? আসলে সব বাহানা। দেখছে ভুবনমাস্টার যখন মেয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েইছে , তখন দে সব ওর ঘাড়ে চাপিয়ে। দায়িত্ব নিতে অবশ্য তার আপত্তি নেই। কিন্তু সব ছেলেমেয়েই মনে মনে চায় পরীক্ষার সময় বাবা মা পাশে থাকুক। পরক্ষণেই মনে হয় , বাঁচা গ্যাছে। এও এক মন্দের ভালো হলো। সুধাদির বাড়িতে তাদের দেখতে পেলে কি প্রতিক্রিয়া হত কে জানে ? 



                 রুম্পার বাবাকে আশ্বস্ত করে বলেন, ঠিক আছে ওকে নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।তারপর আগের মতোই সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের দায়িত্বে সাধনা আর ছন্দাকে রেখে রামপুরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেখানে পৌঁচ্ছেই আগে রুম্পাকে ওদের আত্মীয় বাড়িতে পৌঁচ্ছে দিয়ে আসেন। তারপর নিজে ওঠেন সুধাদির  বাড়িতে। তারমধ্যেই  মনোতোষও সেখানে এসে পৌঁচ্ছে গিয়েছে। ছেলের পরীক্ষার প্রস্তুতি খতিয়ে দেখে মনে মনে খুশীই হন। কিন্তু প্রকাশ করেন না। ছেলেকে মুখে কেবল বলেন , খুব ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিবি তাহলেই হবে। জবাবে ঘাড় নাড়ে মনোতোষ। ছন্দার মতোই সুধাদি মনোতোষের জন্যও সকাল সকাল মাছের ঝোলভাত রান্না করে দেন , বাড়ি থেকে বেরনোর মুখে কপালে দইয়ের ফোটা দিয়ে আর্শিবাদ করেন। ভুবনবাবু অবশ্য আর বাজার করার বোকামি করতে যান নি। একে তো সাধনার হাতে একটা অস্ত্র তুলে দিয়েছে , তার উপরে ছেলের সামনে যদি আবার বোকামি ধরা পড়ে তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। মনোর মাধ্যমে সেটা অবধারিতভাবেই সাধনার কানে যাবে। আর সে তখন তার পিছনে লাগতে ছাড়বে না। সাধনার কথা মনে পড়তেই মনটা উদাস হয়ে যায় ভুবনবাবুর। কি করছে এখন সে কে জানে। সেও নিশ্চয় কবে পরীক্ষা শেষ হবে সেই প্রতীক্ষায় দিন গুনছে।পরীক্ষা শেষ হলে তো মনোকে নিয়েই বাড়ি ফেরার কথা আছে তার। সেও তো একই প্রতীক্ষায় দিন গুনছে।সাধনাকে ছেড়ে সে বিশেষ একটা কোথাও থাকে নি।একমাত্র মনো আর ছন্দার পরীক্ষা ছাড়া। মনোর জন্য আর আসার দরকার হবে না , কিন্তু ছন্দার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য তাকে আর একবার সাধনাকে ছেড়ে আসতেই হবে।  একই শহরে হলেও রুম্পার আর মনোর পরীক্ষার সেন্টার হয়েছে দুটি ভিন্ন স্কুলে। তাই কিছুটা দোটানায় পড়তে হয় ভুবনবাবুকে। কোনখানে থাকবেন তিনি ? ছেলের মতোই রুম্পার দায়িত্বও তিনি ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেন না। রুম্পার আত্মীয়দের তো পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁচ্ছে দিয়ে আসাতেই দায়িত্ব খালাস। তাই ভুবনবাবু পরীক্ষা শুরুর প্রথমদিকটা রুম্পার কেন্দ্রে থাকেন তারপরই চলে আসেন ছেলের কেন্দ্রে। তাই রুম্পার খুব অভিমান হয়।উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে আসার সময় দেখেছে দ্বিতীয় হাফের পরীক্ষা শুরুর আগে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনে উদ্বিগ্ন মুখে ডাব কিম্বা সরবত হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল তারই কেউ নেই। থাকবেই বা কি করে ? তার বাড়ির লোকেরা তো চান নি সে পরীক্ষা দিক। তাই মনের অভিমান মনে চেপে সে প্রথম হাফের পরীক্ষা দেওয়ার পরে টিফিন করার জন্য পা বাড়িয়ে ছিল। আচমকা পিছন থেকে হাতে টান পড়তেই সে থমকে যায়।




                              ঘাড় ঘুরিয়ে চাইতেই খুশীতে মন ভরে যায় তার।  দেখে অন্যান্য ছেলেমেয়ের বাবা মায়ের মতোই তার জন্যও হাতে ডাব নিয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাতদা। মুহুর্তের মধ্যে তার সমস্ত অভিমান গলে জল হয়ে যায়।
খুশী খুশী গলায় রুম্পা বলে -- তুমি ?  আসবে বলো নি তো ? 
---- বলার আর সুযোগ পেলাম কোথাই ? হয় ভুবনকাকু কিম্বা তোমার মাসতুতো ভাই থাকে। ওদের সামনে কথা বললে যদি তুমি আরও চাপে পড়ে যাও, সেইজনই কিছু বলার সাহস পায় নি।
খুব ভালো লাগে রুম্পার। প্রভাতটা তার জন্য কত ভাবে। প্রভাতদার জন্যই সে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিজের লোক না আসার দুঃখটা ভুল যায়। প্রথম হাফের পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বেরিয়েই তার তৃষ্ণার্ত চোখদুটো প্রভাতদাকে খোঁজে। আর প্রতিদিনই দেখতে পায় হাতে কিছু না কিছু নিয়ে হাসিভরা মুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাতদা। প্রভাতদাদের আর্থিক অবস্থার কথা রুম্পার অজানা নয়। তাই সে বলে , তুমি রোজ রোজ আমার জন্য এসব আনতে যাও কেন বলতো ? আমার খিদে পায় না।
প্রভাতদা তখন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পরীক্ষার্থীদের বাবা-মায়ের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, কি দেখছো ? কারও হাত খালি আছে ? পরীক্ষা তুমি একা দিচ্ছ না , ওদের ছেলেমেয়েরাও দিচ্ছে। তাদের খিদে পাই বলেই না বাবা-মায়েরা খাবার নিয়ে আসে। আর তারা যদি পারে তাহলে আমিই বা পারব না কেন ?
রুম্পা আর কোন কথা বলতে পারে না। প্রভাতদার কথা যেন রুম্পার কানে মধু ঢালে।  প্রভাতদা সব সময়ই এভাবেই যুক্তি দিয়ে কথা বলে। তাই সে আর তাদের অর্থাভাবের কথাটা তুলে মাধুর্যটা নষ্ট করতে চায় না। প্রভাতদা তার জন্য যেদিন যা আনে মুখোমুখি বসে দুজনে ভাগ করে খায়। গল্প করতে করতেই দ্বিতীয় হাফের পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়।তখন প্রভাতদাকে ছেড়ে যেতে মন খারাপ হয়ে যায় রুম্পার। সময়টা তার খুব কম মনে হয়। এভাবে পরীক্ষা ক'দিনেই তারা আরও কাছাকাছি চলে আসে। তা ই শেষ পরীক্ষার দিন দুজনেরই মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। শেষের দিন একটাই পরীক্ষা ছিল। সেদিন একটু আগেই সে পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বেরিয়েছিল। তার ভাই তখনও এসে পৌঁছোয় নি।তাই প্রভাতদা আর সে স্কুলের নির্জন ছাতিম গাছটার নিচে এসে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন প্রভাতদা তার হাতে তুলে দিয়েছিল বেশ কয়েকটা গল্প আর কবিতার বই। বইগুলো দেখে তার মনটা খুশীতে ভরে যায়। তার গল্পের বই পড়তে খুব ভালো লাগে। কিন্তু তাদের গ্রামে তো লাইব্রেরী নেই। বই কিনে পড়ার চলও নেই। কারও বিয়ে উপলক্ষ্যে কেউ কোন বই উপহার দিলে সেটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে সবাই। কথাটা একদিন সে প্রভাতদাকে বলেছিল। কিন্তু প্রভাতদা যে সেটা মনে করে তার জন্য এতগুলো বই নিয়ে আসবে তা সে ভাবতেও পারে নি। তাই বইগুলো উল্টে দেখতে শুরু করে। আর প্রথম পাতা উল্টাতে গিয়েই তার চোখ আটকে যায়। দেখে প্রতিটি বইয়ের প্রথম পাতায় তার নাম লেখা আছে। করছে কি প্রভাতদা ? তারজন্য এতটাকা খরচ করে বইগুলো কিনে এনেছে ? এবারে আর চুপ করে থাকতে পারে না সে। রেগেমেগে বলে , তোমার এসব করার কি দরকার ছিল ?
---- কেন , তুমি পড়তে ভালোবাসো বলেই বইগুলো নিয়ে এলাম। কেন খুশী হও নি ? 
---- না , হইনি। টাকা খরচ করে এতগুলো বই কিনে আনার কি দরকার ছিল ?
এবারে হো - হো করে হেসে ওঠে প্রভাতদা।  তারপর হাসি থামিয়ে বলে , আরে না না বইগুলো আমি কিনে আনি নি। সেই সামর্থ্যও আমার নেই।
---- তবে ? 
---- সব স্কুল আর কলেজ থেকে পাওয়া। স্কুলে তো আমি বরাবর এক থেকে তিনের মধ্যে থাকতাম , খেলাধুলো  , আবৃত্তিতেও অংশ নিতাম। কলেজেও তাই।  তাতেই বিভিন্ন সময় প্রাইজ হিসাবে বইগুলো পেয়েছি। প্রথমপাতায় আমার নাম লেখা ছিল।কিন্তু তোমার বাড়ির লোকেদের চোখে পড়ে যেতে পারে বলে কাগজ চিটিয়ে তোমার নাম লিখে দিয়েছি।কথাগুলো শুনে বেশ কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারে না রুম্পা। প্রভাতদার কথা ভেবে গর্বে বুকটা ভরে যায় তার। এত প্রাইজ পেয়েছে তার প্রভাতদা ? নিজের নাম চাপা দিয়ে তার নাম তার নাম লিখে দিয়েছে ? বইয়ের পাতাতে চাপা দিলেও মনের পাতাতে তো প্রভাতদার নামই জ্বলজ্বল করবে। বইগুলো পড়ার সময় সে প্রভাতদারই স্পর্শ অনুভব করবে। মনে মনে  চুমুয় চুমুয় সে প্রভাতদার সারা মুখ ভিজিয়ে দেয়। সেইসময় ভাইয়ের সাইকেলের পরিচিত ঘন্টি শুনে বইগুলো দ্রুত ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। তারপর দ্রুত দু'জনে দুদিকে ছিটকে যায়। প্রভাত মিশে যায় অভিভাবকদের ভীড়ে। সেই ভীড়ের বিভাজন রেখা ভেদ করে দুজনই একপলক দেখার জন্য আকুল নয়নে চেয়ে থাকে।




                           ( ক্রমশ ) 


 নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                     ( ১ ) 
                                  


                            ( ২) 





                                       

                        ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                        ( ৪ )

            



                         ( ৫ )

                               ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                     ----০----





No comments:

Post a Comment