( কিস্তি --- ৩৫ )
সেই ভীড়ের বিভাজনের পর্দা ভেদ করে দুজনেই একে অন্যকে একপলক দেখার জন্য আকুল নয়নে চেয়ে থাকে।ওই ভাবেই আড়চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে ভাইয়ের সঙ্গে স্কুল গেটের দিকে হাঁটতে থাকে রুম্পা। গেটের মুখে সাইকেলে উঠে বাড়ির দিকে রওনা দেয় তারা।নিশ্চিন্তপুরের একই পাড়াতে তো তাদেরও বাড়ি।তাই একটু দুরত্ব রেখে প্রভাতও তাদের অনুসরণ করে। তাদের পাড়াটা মূল শহর থেকে একটু বিচ্ছিন্ন , দুই ধারে শালের জঙ্গল ঘেরা নির্জন রাস্তা পেরিয়ে পাড়ায় ঢুকতে হয়। সেই জায়গাটার কাছে পৌঁচ্ছোতেই ঘটে অঘটনটা।রাস্তায় তখন লোক চলাচল নেই বললেই চলে।বিকেলের আলোও মরে এসেছে। সেই আলোতেই প্রভাত দেখতে পায় কোথা থেকে দুটো লক্কামার্কা ছেলে এসে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে রুম্পাদের আটকায়। ব্যাপারটা কি ঘটতে চলেছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। প্রায়ই ওই রাস্তায় মেয়েদের একা পেলে উত্যক্ত করে কয়েকটা ছেলে।সুযোগ পেলে চরম সর্বনাশও করে। বছর তিনেক আগেই তো টিউশানি পড়ে বাড়ি ফেরার মুখে একটি মেয়েকে জঙ্গলের ভিতরে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের পর গলা টিপে খুন করে চম্পট দেয় দুষ্কৃতিরা। সেইসময় সারা শহর তোলপাড় হয়েছিল। খুনীদের শাস্তির পাশাপাশি নিরাপত্তার দাবিতে পথে নেমেছিলেন সব শ্রেণীর মানুষ।খুনীরা ধরা পড়েছিল।সন্ধ্যার দিকে ওই রাস্তায় পুলিশ পাহারার ব্যবস্থাও হয়।তারপর অন্যান্য জায়গায় যা হয় এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় না। অনিয়মিত হতে হতে একদিন পুলিশ পাহারা পুরোপুরি উঠে যায়।আর সেই সুযোগে ফের শয়তানেরা জাকিয়ে বসে। মেয়েদের হাত ধরে উত্যক্ত করে। লোকলজ্জা
আর পুলিশী হয়রানির ভয়ে অধিকাংশই থানা মুখো হয় না। তাই আগের মতোই আর কেউ চূড়ান্ত সর্বনাশের মুখে পড়েছিল কি জানাও যায় না।কিন্তু এখন কি করবে ভেবে পায় না সে। তাকে দেখে যদি রুম্পাদের আত্মীয়বাড়িতে উল্টো প্রতিক্রিয়া হয় ? রুম্পার সঙ্গে মেলামেশা আটকাতে যদি ওর আত্মীয়বাড়ির লোকেরা তারই বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে পরিকল্পিত ভাবে ওই ঘটনা ঘটনোর অভিযোগ তোলে ? তাহলে সে বড়ো লজ্জার ব্যাপার হবে। তার ভবিষত তো জলাঞ্জলি যাবেই , লজ্জায় অপমানে মা'ও হয়তো আত্মঘাতী হবেন। সে নিজেও কি আর লোকসমাজে মুখ দেখাতে পারবে ? খুব দোটানায় পড়ে যায় সে।রুম্পার ভাই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু দু'জনের সঙ্গে একা এঁটে উঠছে না। রুম্পাও ঘটনার আকষ্মিকতায় যেন প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। রাস্তা দিয়ে মাঝে মধ্যে এক' দুজন লোক যাওয়া আসা করেছে। প্রভাত আশা করেছিল তাদেরই কেউ হয়তো রুম্পার ভাইকে সাহার্য করবে। কিন্তু তার ভাবাটাই ভুল।ঘটনার গুরুত্ব বুঝেও সবাই নিরাসক্তের মতো দ্রুত সাইকেল চালিয়ে চলে যায়। লোকগুলোর উপরে খুব রাগ হয় তার। তাদের বাড়ির মেয়েরা একদিন একই পরিস্থিতির শিকার হতে পারে জেনেও কোন প্রতিবাদ করে না। আর সেইজন্য দুস্কৃতিদের এত বাড়বাড়ন্ত। ততক্ষণে ছেলে দুটো রুম্পার হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। সে আর স্থির থাকতে পারে না।
ভুলে যায় পরিনতির কথা। রুম্পার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা। তখন তার কাছে রুম্পা শুধুই একটি মেয়ে।আর তারই চোখের সামনে একটি মেয়েকে বিপদে পড়তে দেখে সে কি করে দূরে সরে থাকতে পারে ? সে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে জায়গাটার কাছে পৌঁচ্ছে যায়। সাইকেলটা ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলে দুটোর উপর। আচমকা আক্রমনের মুখে ছেলেদুটো কেমন যেন হকচকিয়ে যায়। রুম্পার ভাই তখন আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তাকে দেখে মনোবল ফিরে ওঠে রুম্পাও। তাদের তিনজনের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে পড়ে ছেলে দুটো কিছুটা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। সেই সময় আচমকা
একটি ছেলে প্রভাতের মুখ লক্ষ্য করে ঘুষি চালায়। প্রভাতও মুখ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। ঘুষিটা এসে লাগে তার ঠোঁটে। গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে। তার রক্ত দেখে রুম্পা আর তার ভাই ভয় পেয়ে যায়। সেই সুযোগে ছেলে দুটো ফের তাদের উপর চড়াও হয়। সেই সময় সেখানে এসে থামে একটি সাইকেল।এক হাতে রক্ত বন্ধ করার জন্য কাটা ঠোঁট টিপে ধরে প্রভাত। তারপর তাকিয়ে দেখে সাইকেল থেকে নামছেন ভোম্বলকাকা। রুম্পার আত্মীয়দের পাশেই ভোম্বলকাকাদের বাড়ি। পুরসভায় চাকরি করেন।খুব সাহসী আর প্রতিবাদী হিসাবে তার পরিচিতি রয়েছে। তাকে দেখেই চম্পট দেয় ছেলে দুটো। সব শুনে ভোম্বলকাকা বলেন , কোই বাত নেহি। ওষুধ দিলেই রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে।কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে সারাজীবন হৃদয়ের ভিতরে রক্ত ঝড়বে। সেখানে না চলবে ওষুধ , না চলবে অন্য কিছু। চল দেখি এবার রক্তটা বন্ধ করার ব্যবস্থা করি।
জানাজানির ভয়ে প্রভাত বলে , কিছু লাগবে না এমনিই ভালো হয়ে যাবে।
কিন্তু তার কোন কথা কানেই তোলেন না ভোম্বলকাকা।তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলেন , লাগবে না বললেই হোল।তোদের মতো প্রতিবাদী ছেলেদের রক্তের দাম অনেক। সেই রক্ত তো অযথা বেশি নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। তাহলে যে প্রতিবাদ থেমে যাবে।
ভোম্বলকাকা ওইরকমই। নিজে যেমন প্রতিবাদী, তেমনই অন্য কাউকে প্রতিবাদ করতে দেখলে উৎসাহ দেন , পাশে দাঁড়ান। প্রভাতের কোন আপত্তিই কানে তোলেন না। কার্যত তিনজনকে বগলদাবা করে হাজির করেন রমেন ডাক্তারের চেম্বারে। রুম্পা আর সঞ্জয়ের তেমন কিছু হয় নি। কিন্তু প্রভাতের ঠোঁটে দুটো সেলাই লাগে।সেলাইয়ের পর ঠোঁটে লিউকোপ্লাস্টার লাগিয়ে একটা ইঞ্জেকশানও দিয়ে দেন কম্পাউন্ডারবাবু। ঠোঁটটা প্রচন্ড জ্বালা করতে থাকে প্রভাতের। গাটাও কেমন জ্বর জর লাগে।সবকিছু ছাপিয়ে মাকে কি বলবে সেই ভেবে সব থেকে বেশি দুশ্চিন্তা হয় তার। ছেলেগুলোর সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েছে জানলে মা তো চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে। তার উপরে বিষয়টি জানাজানি হলে রুম্পার উপরে তার কি প্রভাব তার ঠিক নেই।
তাই ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে এসে সে ভোম্বলকাকাকে বলে , কাকা বিষয়টা তুমি আর কাউকে বলো না কেমন।
---- কেন একথা তো সবাইকে ঢাক পিটিয়ে বলার মতো কথা। তবেই না অন্যরা প্রতিবাদ করার সাহস পাবে।
---- মাকে তো জানোই তো কাকা , সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকেন। এই কথাটা শুনলে সেটা আরও বেড়ে যাবে।
---- বেশ আমি না হয় নাই বললাম , কিন্তু সূর্য উঠলে কি আলো চাপা থাকে রে ?
তারপরই যে যার নিজের বাড়ির পথ ধরে। যাওয়ার আগে রুম্পা অস্ফুটে বলে যায়, ওষুধগুলো ঠিকঠাক খেও। সম্মতি সূচক ঘাড় নেড়ে প্রভাতও সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখে।বাড়ির চৌকাঠে পা রাখতেই ছেলেকে দেখে আতকে উঠে সুধাদেবী।দ্রুত কাছে গিয়ে ছেলের হাত দুটো ধরে তিনি বলেন , একি রে , কি করে হলো এমন ?
মায়ের প্রশ্নের মুখে দোটানায় পড়ে প্রভাত। কি বলে সে এখন মাকে ? পারতপক্ষে সে মাকে মিথ্যা বলে না। কিন্তু এখন সত্যিটা বলা মানেই মাকে দুশ্চিন্তায় ফেলা ছাড়া আর কিছু নয়।
ওই ছেলে দুটো একা পেয়ে আবার চড়াও হবে কিনা সেই চিন্তায় মায়ের রাতে আর ঘুম হবে না। তাই কথা বলতে গিয়েও থমকে যায় সে। কিন্তু তাকে চুপ থাকতে দেখে
মা বলেন, কি রে চুপ করে আছিস কেন , বল হয়েছে বল ?
মায়ের জেরার চোটে শেষ পর্যন্ত সে বলে বসে , সাইকেল থেকে পড়ে পাথরে কেটে গিয়েছে।
ছেলের কথা শুনে যেন কিছুটা স্বস্তি ফেরে সুধাদেবীর মনে। মনে মনে ভাবেন যাক , ঝামেলা ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার নয় তাহলে! তবু তার গলায় উদ্বেগ ঝড়ে পড়ে -- এতখানি বয়েস হলো , একটু সাবধানে সাইকেল চালাতে পারিস না ? বাড়াবাড়ি কিছু একটা যদি হয়ে যেত ?
প্রভাত আর কোন প্রত্যুত্তর করে না। এমনিতেই মাকে মিথ্যা বলার জন্য মনের মধ্যে একটা অপরাধ বোধ কাজ করছিল। তার উপরে আবার বেশি কথা বলতে গিয়ে যদি বেফাঁস কিছু বলে ফেলে ? কথায় আছে একটা মিথ্যাকে ঢাকার জন্য অনেক মিথ্যা বলতে হয়। কিন্তু মাকে আর সে মিথ্যা বলতে পারবে না। তাই মাকে এড়াতে সে নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে।মনে মনে ভাবে, এবারের মতো খুব বাঁচা বেঁচে গেল সে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment