( কিস্তি -- ৮)
পাহাড়ে পাহাড়ে সেই গান প্রতিধ্বনিত হয়ে অপূর্ব এক সুরের মুর্ছনা সৃষ্টি করে। ভালো লাগার আবেশ নিয়ে বাড়ি ফেরে সকলে। পিকনিকের রেশ কাটতে না কাটতেই ছন্দা -- মনোতোষদের বুকে ধুকপুকুনি শুরু হয়ে যায়। কয়েকদিন পরেই ছন্দাদের বার্ষিক পরীক্ষা। তাদের পরীক্ষা শেষ হলেই মনোতোষের মাধ্যমিক পরীক্ষা। তাই তাদের এখন শিরে সংক্রান্তির মতো অবস্থা।এমনিতে সব ঠিকই আছে। ছন্দার অঙ্কটা নিয়ে একটু দুর্বলতা রয়েছে। অঙ্কে সে বরাবরই কাঁচা। কাকুও সেটা ভালো করেই জানেন। তাই ঠিক হয় পরীক্ষার আগে এই ক'টা দিন ছন্দা আর বাড়ি যাবে না। কাকুদের বাড়িতেই থেকে যাবে সে। স্কুলে যাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে কাকু তাদের দুজনকে নিয়ে বসবেন। ছন্দাকে ভালোভাবে পাশ করানো যেন কাকুর কাছে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ। সে ভালোভাবে পাশ করতে না পারলে কাকুর নিন্দে হবে।
ছন্দা সেটা ভালোভাবেই জানে। তাই সেও প্রানপাত পরিশ্রম শুরু করে দেয়। মনোতোষের অবশ্য সেই দুশ্চিন্তা নেই। সে স্কুলের সেরা ছেলে। মাষ্টারমশাইরা বলা কওয়া করছেন মনোতোষ এবার রেকর্ড ভেঙে দেবে।ছন্দাও চায় তার মনোদা সবার সেরা হোক। মনে মনে সে মনোদাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখে। পুরোহিতদাদুর কথাটা তার মনে পড়ে যায়। গ্রামের অনেকেও বলেন মনোদার সঙ্গে তার মুখের নাকি অনেকখানি মিল রয়েছে।কাকু - কাকীমা, তার বাবা- মাও কথাটা মাঝে মধ্যে বলেন। সেও জানে। কিন্তু মনোদা ? সে কি কিছুই জানে না ? সে কি জানে না আমি যে তাকে মনপ্রাণ সপে দিয়ে বসে আছি। নিজের ভালোবাসার কথা তো সে মরে গেলেও মুখ ফুটে বলতে পারবে না। কথায় আছে
মেয়েদের বুক ফাটলেও মুখ ফোটে না। তাছাড়া কাকু-কাকীমাই বা বিষয়টি কেমন ভাবে নেবেন কে জানে ? তাই তার মনের মধ্যে একটা সংশয় কাজ করে।কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য সংশয়টা কেটে যায়। ততদিনে তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মোটামুটি ভালোই হয়েছে তার পরীক্ষা। কাকুও প্রশ্নপত্র ধরে ধরে মিলিয়ে দেখে নিয়ে সেই রকমই বলেছেন। আর কাকুর মুখ রাখতে পারবে ভেবে সেও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সে বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু কাকীমাই বলেছিল, আর ক'টা দিন থেকেই যা না মা। এই ক'টা দিন মনো রাত জেগে পড়াশোনা করবে। তাই একটু গরম চা কিম্বা হরলিক্স দিতে না পারলে ও পড়বে কেমন করে ? তুই চলে গেলে আমি যে সব একা হাতে পেরে উঠব না মা। আমি বরং তোর বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে নিচ্ছি।অনুমতি নেওয়ার কোন দরকারই হবে না ছন্দা জানে।
বাবা- মা তো কাকু-কাকীমার কথা বেদবাক্য বলে মানেন। তাই সেদিনের সান্ধ্য আসরে চা দিতে গিয়ে কাকীমা কথাটা তুলতেই বাবা বলেন , হ্যা - হ্যা এতে বলার কি আছে ? থাকুক না যতদিন খুশী। আপনাদের কাছে ও থাকলে আমরা নিশ্চিন্ত। আপনারা ওর যতটা খেয়াল রাখেন বাবা-মা হয়েও মেয়ের অত খেয়াল রাখা বোধহয় আমাদের পক্ষেও সম্ভব হয় না। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে জন্ম না দিলেও আপনারাই তো ওর আসল বাবা-মা।
বাবা যে ওইরকম কথা বলবেন তা জানাই ছিল ছন্দার। তারও এ সময় মনোদার পাশাপাশি থাকার ইচ্ছে ছিল। কি যে হয়েছে তার কে জানে। মনোদাকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে হয় না।তাই মনে মনে খুশীই হয় সে। সেদিন থেকেই মনোদাদের বাড়িই তার ঠিকানা হয়ে ওঠে। ছন্দা মনে মনে ভাবে ভাগ্যিস হয়েছিল, না হলে তো তাকে নিয়ে কাকু--কাকীমায়ের মনোভাবের কথাটা অজানাই থেকে যেত তার। সেদিনের কথাটা তার কাছে সুখস্মৃতি হয়ে আছে।
অন্যান্য দিনের মতো সেদিন রাতেও সে পাশের ঘরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ কাকু-কাকীমার গলা পেয়ে তার ঘুম ভেঙে যায়। এমনিতে লুকিয়ে অন্যের কথা শোনার মতো মনোবৃত্তি তার নেই। কিন্তু কাকু - কাকীমার মুখে নিজের নাম শুনে কৌতুহল চাপতে পারে না সে। কি হলো আবার তাকে নিয়ে ? সে কেন কাকু- কাকীমার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল তা ভেবে কিছু কুল-কিনারা পায় না।
তাহলে কি পিকনিকের দিন মনোদার সঙ্গে একা একা মন্দিরে যাওয়া ভালো চোখে দেখেন নি কাকু-কাকীমা ? মনোদা কি তার অবর্তমানে কাকীমাকে পুরোহিতদাদুর সেই কথাটা বলে দিয়েছে ? তাতেই রুষ্ট হয়েছেন কাকু কাকীমা ? দুজনেই তাকে স্নেহ করেন ঠিকই , কিন্তু ছেলের বৌ
হিসাবে হয়তো উপযুক্ত মনে করেন না। সেইজন্য তাদের অবশ্য বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। তাদের একমাত্র ছেলে মনোদা রূপে-গুণে, আচার-আচরণে এই এলাকার সবার সেরা। সেইদিক থেকে সে অনেকটাই পিছিয়ে। তাই কাকু-কাকীমাও ছেলের বিয়ের জন্য সেরা কাউকে চাইতেই পারেন। কিন্তু সে যে মনোদাকে মনেপ্রানে ভালোবেসে ফেলেছে। কি করবে সে এখন ? তাই কাকু-কাকীমা তাকে নিয়ে কি আলোচনা করছেন তা শোনার জন্য কান খাড়া করে থাকে সে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে শুনতে পায় কাকু কাকীমাকে চাপা গলায় বলছেন , পরের মেয়েটাকে এতদিন ধরে এখানে আটকে রেখেছো , এরপর লোকনিন্দে হলে কি হবে শুনি ?
--- পরের মেয়েটা যে চিরদিন পরেরই থাকবে তা তোমাকে কে বলেছে ?
---- মানে ?
---- নিন্দে মন্দ হবার আগেই ওকে আমি ছেলের বৌ করে ঘরে তুলব।
--- তুমি কি সিরিয়াস ?
---- হ্যা,নিশ্চয়। মেয়েটা বলতে গেলে আমার হাতেই তৈরি। আমাকে মায়ের মতোই দেখে। আমারও ওকে নিজের মেয়েই মনে হয়। ওকে বাদ দিয়ে আবার কাকে ঘরে তুলতে যাব ? সে কেমন হবে , আমাদের কেমন চোখে দেখবে তার ঠিক নেই। তাই আমি বাপু ওকে ছেলের বৌ করে কাছে রাখতে চায়।
--- তোমার চাওয়ার উপরেই তো সব কিছু নির্ভর করেছে না।
---- সে কি আর আমি জানি না। ছন্দার বাবা মায়ের আপত্তি হবে বলে মনে হয় না।
ছন্দার চোখ মুখের ভাব দেখেই বুঝতে পারি সে তার মনোদাদাকে মন দিয়ে বসে আছে। আর মনোতো তোমারই ছেলে , একটু ভোলেভালে গোছের। তবে তার চোখেও অনুরাগের ছোঁওয়া আমার চোখ এড়ায় নি।
---- ভালো বললে তো তুমি ! ছেলের কথা বলতে গিয়ে তুমি আমাকে ধরে টানাটানি শুরু করে দিলে ? আমাকে ভোলেভালে বলে দিলে ?
--- অন্যায় কি এমন বলছি ? তুমি কি ভোলেভালে নও ?
---- আমি একজন শিক্ষক। ভোলেভালে হলে শিক্ষকতা করা যায় ?
---- অঃ শিক্ষকেরা বুঝি ভোলেভালে হয় না ? ফুলশয্যার রাতের সেই কথাটা বুঝি ভুলে বসে আছো ?
---- কোন কথাটা ?
---- সেই যে গো , আমার মুখের দিকে চেয়ে আছো তো চেয়েই আছো। বার বার ঠোঁটের কাছে ঠোঁট এনেও চুমু আর খেতে পারো না। শেষে কাজটা আমাকেই করত হলো।
---- ওঃ সেই কথাটা তুমি এখনও মনে রেখেছো ?
---- হ্যা, মশাই। মেয়েরা তাদের ফুলশয্যার কথা জীবনে ভোলে না। কেন তোমার খুব লজ্জা পাচ্ছে বুঝি ?
--- আসলে তোমার আগে তো আমি মেয়েদের সঙ্গে সেভাবে মিশি নি। তাই সেদিন কেমন আড়ষ্টতায় পেয়ে বসেছিল।
---- আমার অবশ্য এই ভোলেভালেটাকেই সেদিন খুব ভালো লেগেছিল।
বলেই কাকীমা কাকুকে চকাশ চকাশ শব্দে কয়েকটা চুমু খেয়ে নেন। কাকুও তার প্রত্যুত্তর দেন। বিছানাতে শুয়ে শুয়েই সেই শব্দ সে শুনতে পায়। কাকুকে যে কাকীমা খুব ভালোবাসেন তা সে জানে , কিন্তু এই বয়েসে এখনও যে দুজনের মধ্যে এতটা অনুরাগ রয়েছে তা জানা ছিল না।
শরীরটা কেমন শিরশির করে ওঠে তার। সারা শরীরে যেন পদ্মকাঁটা ফুটে ওঠে। এসময় মনোদাকে কাছে পেতে খুব ইচ্ছে করে তার। তীব্র পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। জল খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু উঠতে পারে না। নিঃশব্দে পড়ে থাকে বিছানায়। কারণ সে জেগে আছে জানলে কাকু-কাকীমা খুব লজ্জায় পড়ে যাবেন। সেও কি কম লজ্জায় পড়বে ?জেগে জেগে চুরি করে কাকু-কাকীমার কথা শোনার জন্য সে মুখ দেখাতে পারবে না। তাই
বিছানায় চুপটি করে পড়ে থাকে সে। তার আর মনোদা সম্পর্কে কাকু-কাকীমাদের কথাগুলো ভাবতে থাকে। আর এক অনাস্বাদিত পুলকানুভূতিতে তার মন ভরে যায়। বাবা মায়ের মনোভাবের কথাও বেশ কিছুদিন আগে প্রায় একই ভাবে জানা হয়ে গিয়েছে তার। সেদিন সে আর খুঁকী ধানের গোলার আড়ালে রান্নাবাটি খেলছিল। বাবা - মা আর ঠাকুমা
রান্নাচালায় বসে চা খাচ্ছিলেন। রান্নাবাটি খেলতে খেলতেই সে শুনতে পায় মা বাবাকে বলছেন , মেঘে মেঘে বেলা অনেক হোল। এবার তো মেয়েটাকে পার করতে হবে। আর বেশিদিন ঘরে ধরে রাখা ঠিক হবে না।
--- আগে ও মাধ্যমিক পরীক্ষাটা তো দিক তারপর দেখা যাবে।
--- সে তো মাঝে আর একটা বছর। কিন্তু এখন থেকে চেষ্টা চরিত্র না করলে ভালো পাত্রের সন্ধান মিলবে ? তবে আমি মনে মনে একটা কথা ভাবছিলাম জানো ?
--- কি কথা ?
--- আমাদের মনোর হাতে যদি মেয়েটাকে তুলে দিতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হত। দাদা--দিদি তো ওকে মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। আর আমাদেরও একটাই মেয়ে। চারিদিকে যা হচ্ছে শুনছি, বাইরে কোথাও বিয়ে দিয়েও শান্তি পাব না। মনোর সঙ্গে বিয়ে দিলে কেমন চোখের সামনে থাকবে। শ্বশুরবাড়ি-বাপেরবাড়ি একই সঙ্গে করতে পারবে। হ্যা গো হয় না এমন ?
প্রত্যুত্তরে বাবা কিছু বলার আগেই ঠাকুমা বলে ওঠেন , এর মতো ভালো আর হয় না। আমারও দিদিভাইকে বাইরে কোথাও পাঠাতে মন চায় না। তাছাড়া দুটিতে মানাবেও ভালো। মনোদাদু একটু নরম-সরম প্রকৃতির আর দিদিভাই শক্ত ধাতের। সংসারে এমনই তো চায়। একজন নরম হলে অন্যজনকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হয়। তুই বাবা মনোর বাবা- মায়ের সঙ্গে এই বিষয়ে একটু কথা ছাইয়ে রাখিস। তাহলে আমাদের আর মেয়ের বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে।
সে বিয়ে যেদিন দেওয়ার ওরা নিজের সুযোগ সুবিধা মতো দেবেন।
--- এর চেয়ে ভালো যে আর কিছু হয় না সে আমিও মানি মা। আমার মনেও দীর্ঘদিন ধরে একই ইচ্ছে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু প্রস্তাবটা যদি ওরা অন্যভাবে নেন, যদি আমাদের এতদিনের বন্ধুত্বে চিড় ধরে সেই আশঙ্কাই মনোর বাবা-মায়ের কাছে কথাটা আমি তুলতে পারি নি।
--- মনোর বাবা - মাকে আমি যতদুর চিনি, প্রস্তাবটা মনঃপূত না হলেও তোদের বন্ধুত্বে তার কোন প্রভাব পড়বে না। তবে তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। দিদিভাই মাধ্যমিকটা দিক, তারপর না হয় বলবি। এমনি তো এখন ছেলেমেয়ের ২১আর ১৮ বছর বয়েস না হলে বিয়েও দেওয়া যায় না। তখন তুই না পারিস আমিই না হয় বলব।সেদিনের সেই কথাগুলো ভাবতেই ভাবতেই এক সময় ছন্দার চোখে ঘুম নেমে আসে।
No comments:
Post a Comment