Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৪৬




                              
     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











             কালের কারিগর
              

                          অর্ঘ্য ঘোষ 



                            
                     (  কিস্তি --- ৪৬ ) 



কিন্ত স্কুলে গিয়ে ফের তাকে চাপের মুখে পড়তে হয়। কিছুদিন আগেই  প্রধান শিক্ষক নবকিশোরবাবু অবসর নিয়েছেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক অরিজিৎ দে আছেন বটে কিন্তু তিনি কোনও কাজের নন।স্কুল পরিচালনা থেকে প্রশাসনিক সংযোগ রক্ষা সবেতেই এতদিন  প্রধান শিক্ষকের ভরসা ছিলেন ভুবনবাবু।উচ্চ মাধ্যমিকের অনুমোদনে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার পর থেকে শুধু স্কুলেই নয় , স্থানীয় জনমানসেও ভুবনবাবুর প্রতি সেই ভরসাটা আরও বেড়ে গিয়েছে। প্রধান শিক্ষক  অবসর নেওয়ার পর সেই ভুবনবাবুই প্রভাতের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে স্কুল এতদিন জোড়াতালি দিয়ে চলছিল। তাই বিয়ের পাট চুকিয়ে স্কুলে যোগ দিতেই পরিচালন সমিতির সদস্যরা তার ঘাড়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব চাপানোর জন্য উঠে পড়ে লাগেন। তার জেরে ভুবনবাবু পড়েন মহা বিড়ম্বনায়। স্কুলে তার চেয়ে প্রবীণ এবং শিক্ষিত অনেক শিক্ষক রয়েছেন। সে প্রধান শিক্ষক হয়ে বসলে তাদের আত্মসম্মানে ঘা লাগতে পারে। আবার পরিচালন সমিতির কথা অমান্য করলে তারাও ক্ষুন্ন হতে পারেন। তার দোনামনাভাব লক্ষ্য করে পরিচালন সমিতির সভাপতি সুহৃদ ঘোষ বলেন , ভুবনবাবু প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব আপনাকে নিতেই হবে। না বললে শুনছি না। ভুবনবাবু সবিনয়ে বলেন , আপনাদের নির্দেশকে সম্মান জানিয়েই বলছি আমার থেকে আরও অনেক প্রবীণ এবং যোগ্য শিক্ষক রয়েছেন। দয়া করে আপনারা তাদের কথা ভাবুন। যিনিই প্রধান শিক্ষক হোন না কেন , স্কুলের কাজে তাকে আমি সর্বোতভাবেই সাহায্য করব।পরিচালন সমিতির সভাপতি নির্মলবাবু বলেন , আপনার দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।আমরা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে সব দিক ভেবেই আপনার কাছে প্রস্তাবটা রেখেছি।এই তো এখানেই দুজন প্রবীণ শিক্ষক রয়েছেন, আপনি নিজেই জিজ্ঞেস করে তাদের মতটা জেনে নিন। 
ভুবনবাবুকে জিজ্ঞেস করতে হয় না।নির্মলবাবুর কথা শুনে নিজে থেকে মুখ খোলেন স্কুলের দুই প্রবীণ শিক্ষক সাধনবাবু আর সত্যবাবু।তারা বলেন , আমরা তো আর কয়েক মাস পরেই অবসর নেব।তুমিই এই মুহুর্তে স্কুলের প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার মতো যোগ্য শিক্ষক। তোমার নেতৃত্বেই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরও উন্নত হবে। তুমি আর না কোর না ভাই।




               এরপর আর না করতে পারেন না ভুবনবাবু। সবার অনুরোধে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে হয় তাকে।খবরটা শোনার পর সাধনা তো খুব খুশী। খুশীর চোটে পরদিন সত্যনারায়ণের পুজো দিয়ে বসেন। আর সেদিন সন্ধ্যায় স্বামীর সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের হাতে তুলে দেন প্রসাদ। প্রসাদ হাতে নিয়ে সবাই হঠাৎ করে পুজো আয়োজনের কারণ জানতে চান। সাধনা তাদের কারণটা বলেন। আর সেটা শুনেই সবাই হই হই করে বলে উঠেন -- না না এত বড়ো সুখবরে শুধু সত্যনারায়ণের সিন্নিতে হবে না। পেট পুরে মাংস ভাত খাওয়াতে হবে। অগত্যা সেই আবদার রাখতে হয় সাধনাকে। এমনিতেই ওদের একটা খাওয়া পাওনা রয়েছে। যারা ভোজের বাড়িতে কাজ করেন তাদের সেদিন ভালো করে খাওয়া দাওয়া হয় না। সেইজন্য তাদের বিয়ের পরে  কর্মীভোজন বলে একদিন খাওয়ানোর রীতি প্রচলিত আছে গ্রামাঞ্চলে। সেই হিসাবে প্রভাতের বিয়ের কর্মীভোজনে তো ওদের খাওয়াতেই হত , তাই একসংগেই সেই আয়োজনের ব্যবস্থা করে সাধনা। সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের সঙ্গে ডাক্তারকাকা, ছন্দা, রুম্পাদের বাড়িতেও বলা হয়। খাওয়া-দাওয়া পর সবাই সাধনা-ভুবনবাবুর খুব সুখ্যাতি করেন। সবাই বিদায় নেওয়ার পর সেদিন রাতে স্ত্রীকে আবার যেন নতুন করে খুঁজে পান ভুবনবাবু। আদরে সোহাগে ভেসে যেতে যেতে তারা যেন ফেলে আসা দিনগুলিতেই ফিরে যান। স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে ভুবনবাবু বলেন , হ্যা গো আমি পারব তো ? 
স্বামীকে ভরসা দেন সাধনা , আমি বলছি দেখো তোমার হাতে স্কুলের আরও উন্নতি হবে। সবাই তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। স্ত্রী হিসাবে আমার সেদিন গর্বে বুক ভরে যাবে। 
স্ত্রীর কথায় অনুপ্রাণিত হন ভুবনবাবু। সাধনা প্রথম থেকেই সব কাজে তাকে এ ভাবেই অনুপ্রেরণা যুগিয়ে এসেছে। স্ত্রীকে বুকের কাছে টেনে তিনি। সাধনাও স্বামীর ঠোঁটে মিলেয়ে দিন নিজের ঠোঁট। অনুরাগের বৃষ্টিতে ভিজে যান দুজনে। 





                               প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর থেকে অবশ্য খুব চাপে পড়ে যান ভুবনবাবু। স্কুল - প্রশাসনিক সংযোগ রক্ষা তো ছিলই , অভিভাবেকেরা একটি কলেজের স্থাপনেরও দাবি তোলেন। একদিন সুহৃদবাবুরাও স্কুলে এসে তাঁকে ধরেন। তারা বলেন , মাস্টারমশাই আমাদের এই স্কুল প্রাইমারী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক হয়েছে। এবার আমরা একটা কলেজ চাই। আর আপনাকেই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। আমাদের বিশ্বাস আপনি লাগলেই কলেজ হবে।আমরাও অবশ্য আপনার পাশেই থাকব। এলাকায় কলেজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করেন ভুবনবাবুও। মেয়েরা তো বটেই , দরিদ্র পরিবারের ছেলেদেরও ইচ্ছা স্বত্ত্বেও কাছে পিঠে কলেজ না থাকায় উচ্চ মাধ্যমিকের পর আর পড়া হয় না। এখান থেকে কাছাকাছির মধ্যে কলেজ রয়েছে সেই ৪০ কিমি দূরে রামপুরহাটে। প্রতিদিন অত দূরের কলেজে তো যাওয়া আসা করে পড়াশোনা করা সম্ভব নয়। অধিকাংশেরই হোস্টেল কিম্বা মেসে ছেলেমেয়েকে রেখে পড়ানোর মতো আর্থিক সামর্থ্যও নেই।তাই এলাকায় উচ্চ শিক্ষা বিস্তার বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রসার ভীষণ ভাবে ব্যাহত হয়ে পড়েছে। এই তো কিছুদিন পরেই ছন্দা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করবে। তার ইচ্ছে ছন্দা বি,এ পাশ করুক। কিন্তু রামপুরহাটে রেখে কি তাকে পড়ানো আদৌ সম্ভব হবে ? শুধু তো আর্থিক সমস্যাই নয় , একটি মেয়ের বাইরে থাকার আরও তো পারিপার্শ্বিক কিছু সমস্যা আছে। সেই ভেবেই কেউ মেয়েদের পড়াতে চায় না।  কিন্তু ঘরের খেয়ে পড়া সম্ভব হলে সেই ধারণার অনেকখানিই অবসান হবে বলেই মনে হয় ভুবনবাবুর। তাই তিনি সুহৃদবাবুদের অনুরোধ ফেরাতে পারেন না। কলেজ স্থাপনের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নেন। 



    
                     প্রথমেই বিষয়টি নিয়ে অম্লানের সঙ্গে কথা বলেন ভুবনবাবু। তার কাছে থেকেই জানতে পারেন কলেজ স্থাপনের জন্য কলেজেস মানি হিসাবে প্রাথমিক প্রয়োজন পঁচিশ হাজার টাকা এবং পাঁচ একর জমি।টাকা এবং জমি যোগাড় হলে তবেই কলেজ স্থাপনের যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখে সরকার। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও সরকারি সদিচ্ছার উপরেই নির্ভর করে কলেজের অনুমোদন। সেই মতো একদিন স্কুলে মিটিং ডেকে সবার সামনে বিষয়টি খুলে বলেন তিনি। সেদিনই এলাকার শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের নিয়ে একটি কমিটি গড়া হয়। সেই সংগঠক কমিটির সম্পাদক করা হয় ভুবনবাবুকে। জমি নিয়ে অবশ্য বেশি দুশ্চিন্তা করতে হয় না উদ্যোক্তাদের।স্কুলেরই প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেক জমি পড়ে রয়েছে। এ লাকার শিক্ষানুরাগী মানুষজন একদিন ওইসব জমি দান করেছিলেন। ফুটবল মাঠের পিছনেই সেই রকম বেশ কিছু জায়গা পড়ে রয়েছে স্কুলের। সেই জায়গা থেকেই পাঁচ একর জায়গা দান করার প্রতিশ্রুতি দেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। জায়গা তো যোগাড় হলো , কিন্তু টাকার কি হবে ? এলাকার অধিকাংশ মানুষই চাষাভুষো। দিন এনে দিন খাওয়া হতদরিদ্র ওই পরিবারের পক্ষে অর্থ সাহায্য করা সম্ভব নয়।হাতে গোনা যেসব স্বচ্ছল পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে তাদের আবার সামগ্রিক শিক্ষার ব্যাপারটি না পচ্ছন্দের। তাদের যুক্তি, সবাই স্কুল কলেজে ছুটলে বাড়ির ঝি-  চাকর- মাহিন্দার জুটবে না। তাদের প্রকাশ্যেই বলতে শুনেছেন , ছোটলোকের ব্যাটাবেটিগুলো বই বগলে স্কুলে ছুটলে ভদ্রলোকের ছেলেগুলো কি গরু ছাগলের পিছনে ছুটবে ? 
ভুবনবাবু ভাবেন , কি অদ্ভুত যুক্তি। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সমাজের একটা অংশকে বংশানুক্রমে শিক্ষা সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখার কি নিলজ্জ প্রচেষ্টা ! এরা কবে বুঝবে বালির বাঁধ দিয়ে বেশিদিন প্লাবন রোখা যায় না। মানুষ যেদিন নিজে থেকে শিক্ষার গুরুত্ব উপলদ্ধি করবে সেদিন শিক্ষার অধিকার আদায় করে নেবে। 



                             
                                              আক্ষেপের বিষয় তার মাঝে কয়েকটা প্রজন্ম হয়তো শিক্ষাঙ্গনের বাইরেই থেকে যাবে। তাই অবস্থাপন্নদের সাহায্য মিলবে না বলে খুব দুশ্চিন্তায় পড়েন ভুবনবাবু। এবারেও তার মুসকিল আসান করে দেন সাধনা। একদিন রাতে টাকার চিন্তায় কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলেন না তিনি। কেবলই মনে হচ্ছিল এতদুর এগিয়ে এসেও কি পিছিয়ে যেতে হবে ?  এত লোকের আশা পূরণ হবে না ? সেইসব কথা ভাবতে ভাবতে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন আর বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছিলেন ভুবনবাবু। সেটা টের পেয়েই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন সাধনা। স্বামীর বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন -- কি গো কি হলো , অমন করছো কেন ?
তখন স্ত্রীকে তার দুশ্চিন্তার কথা খুলে বলেন ভুবনবাবু। সব শোনার পর সাধনা বলেন , এখনই এত উতলা হয়ে পড়ছ কেন ? তোমরা গ্রামে গ্রামে যাও। সবার কাছে তোমাদের সমস্যার কথা বলো। কলেজ হলে তো সবারই উপকার হবে। দেখবে সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। তাতে হয়তো তোমাদের একটু বেশি ঘুরতে হবে আর সময়টা একটু বেশি লাগবে , কিন্তু দেখবে বিন্দু বিন্দু করে সিন্ধু ভর্তি হবেই হবে।
স্ত্রীর কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন ভুবনবাবু। কি সুন্দর করে গুছিয়ে কথাগুলো বলল সাধনা। তার কথা শুনেই মনে অনেকখানি জোর পেলেন তিনি। অথচ এই সাধনাদের মতো মেয়েরা স্কুল- কলেজ অভাবে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় নি। সেই সুযোগ পেলে হয়তো সাধনাদের মতো মেয়েরাই সমাজের দশদিক আলোয় ভরিয়ে দিতে পারত। না , পিছিয়ে গেলে চলবে না। সাধনাদের মতো মেয়েদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য কলেজ তাকে গড়তেই হবে। এক অনমনীয় জেদের জন্ম হয় ভুবনবাবুর মনে।

                            ( ক্রমশ )


 নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                      ----০----



No comments:

Post a Comment