Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৪৮

                              
     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











              কালের কারিগর
              

                         অর্ঘ্য ঘোষ 

                        ( কিস্তি --- ৪৮)



তাই তিনিও একটা কান্ড করে বসেন।  খাওয়া দাওয়া না করেই চুপি চুপি চোরের মতো পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসেন। সন্তর্পণে বাড়ির রাস্তার দিকে এগিয়ে চলেন তিনি। খুব আশংকা হয় তার সত্যি সত্যি কেউ চোর ভেবে ধরে আটকাবে না তো ? কেউ দেখে ফেলে ধরে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসিয়ে দেবে না তো ! সে বড়ো লজ্জার ব্যাপার হবে। জবাবদিহি করতে করতে মরমে মরে যাবেন তিনি। তখন আকাশে হুস হাস করে বাজি পুড়েই চলেছে। সেই আলোয় ক্ষণিকের জন্য ভুবনবাবুকে স্পষ্ট দেখা যায়। আর তিনি তত সংকুচিত হয়ে পড়েন। বাড়ি ফিরতে ফিরতেই ভাবেন যাদের অর্থের প্রাচুর্য আছে ,  সেটা লোকের কাছে প্রদর্শনের জন্য জলের মতো তারা তা ব্যয় করতে পারে। সেই বাহুল্যকে একটু কাটছাঁট করে সমাজ উন্নয়নে লাগালে পৃথিবী কত সুন্দর হয়ে উঠত। তারা কলেজ গড়ার জন্য পঁচিশ হাজার টাকা যোগাড় করতে পারছেন না আর এরা কত টাকা শুধু শুধু বাজিতেই পুড়িয়ে দিল নিমেষের মধ্যে। আনন্দ উৎসবের প্রয়োজনীয়তা তিনি অস্বীকার করেন না , কিন্তু শুধু মাত্র লোককে দেখানোর জন্য বাহুল্য প্রদর্শন কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেন না ভুবনবাবু। তবে তাঁর মানা না মানার উপরে কি'ই বা নির্ভর করে ?
কুনালের ছেলের বিয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই এক সময় বাড়ির দোড়গোড়ায় পৌঁচ্ছে যান ভুবনবাবু। আর এক নুতন চিন্তার উদয় হয় তার মনে। সান্ধ্যআসরের বন্ধু ,সাধনা সবাই তো তার কাছে কেমন খাওয়া দাওয়া হোল জানতে চাইবেন। কি করে তিনি তাদের অপমানিত হয়ে না খেয়ে চলে আসার কথা বলবেন ?  তিনি অপমানিত হতে পারেন সেই আন্দাজ করেই সাধনা তো বটেই , সান্ধ্য আসরের বন্ধুরাও তাকে পই পই করে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতে বারণ করেছিল। সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা তো বলেইছিল , ওরা নিজেরা যখন নিমন্ত্রণ করতে আসতে পারে নি তখন নিজে সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেও যেতে হবে না। পরে উপহারটা কারও হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই চলবে। কিন্তু ভুবনবাবু তা কানে তোলেন নি। বন্ধুদের বলেছিলেন , তা হয় না। ওরা রাগ করে আমাকে নিমন্ত্রণ করতে আসে নি বলে আমার না যাওয়াটা খারাপ দেখায়।
তখন সান্ধ্যআসরের বন্ধুরা আর কিছু বলে নি। এখন কি করে তিনি গাল বাড়িয়ে চড় খেয়ে আসার কথাটা তাদের বলবেন ? তাই চিন্তিত মনেই বাড়িতে ঢোকেন তিনি। তার আশংকাই সত্যি হয়।  বাড়ির ভিতরে পা রাখতেই সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের জেরার মুখে পড়তে হয় তাকে।সবাই জানতে চান , রাম - কুণাল তার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করল ? খাওয়া-দাওয়া কেমন হল ? 



                               ওই প্রশ্নের মুখে খুব অসহায় বোধ করেন ভুবনবাবু। তিনি মিথ্যা বলতে পারেন না।ভালো করেই জানেন একটা মিথ্যাকে সত্যি বলে চালাতে গিয়ে আরও অনেক মিথ্যা বলতে হয়।কিন্তু এক্ষেত্রে সত্যি বললে তার কষ্টটা তো আর লাঘব হবে না , মাঝখান থেকে অন্যরা বিশেষ করে সাধনা মনে মনে খুব কষ্ট পাবে। তাই তিনি বলেন , তোমরা মিছেই আশংকা করেছিলে। আমি বলেছিলাম না আমাকে দেখলেই ওরা সব ভুলে যাবে। সেই আমার কথাটাই সত্যি হলো। আমি যাওয়া মাত্রই কুনাল-রাম এগিয়ে এসে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে প্যাণ্ডেলে বসিয়ে দিল।হাজার হোক বন্ধু বলে কথা।আর খাওয়া দাওয়ার কথা কি বলব ভাই ? বোঝই তো বড়লোকের বাড়ির বিয়ে বলে কথা। কোনটা ফেলে কোনটা খাব তা ভেবেই পাচ্ছিলাম। আতসবাজিরই কি বাহার !তারপর কি করে হুস করে রকেট বোমগুলো মাঝ আকাশে উড়ে গিয়ে রঙবেরঙ-এর তারার মতো ঝড়ে পড়ছিল সাতকাহন করে সেইসবের ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন। সেইসব দেখতে দেখতেই তো বাড়ি ফিরে এলাম। সব শুনে সন্তুষ্ট মনে বাড়ি ফিরে যান সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা। কিন্তু স্বামীর কথা শুনে সাধনার মনে কেমন যেন খটকা লাগে। তাই স্বামীর দু'হাত ধরে বলেন , কই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলো তো কি কি খেয়ে এসেছো তুমি ?
স্ত্রীর জেরার মুখে কাচুমাচু হয়ে পড়েন ভুবনবাবু। আমতা আমতা করে বলেন--- কেন বড়োলোকদের বিয়েতে যা-যা খাওয়ায় , ওই তো পোলাও -- কোপ্তা ---। 
---- হয়েছে হয়েছে। আর বলতে হবে না , যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। তুমি কেন বোঝ না সবার দ্বারা সব কিছু হয় না। তোমার মুখে মিথ্যা বলাটা একেবারে মানায় না। আচ্ছা তুমি কি গো ? আমাকেও সত্যি কথাটা বলতে তোমার এত সংকোচ ? খালি পেটে শুয়ে পড়ছিলে ?
স্ত্রীর কাছে আর সত্যিটা গোপন করতে পারেন না ভুবনবাবু।সবটা শুনে স্বামীকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে সাধনা বলেন, বাদ দাও তো ওদের কথা। তুমি তোমার কর্তব্য করেছো। তার প্রতিদানে কে কি করল মন থেকে মুছে ফেলো। হাত মুখ ধুয়ে এসো আমি ভাত বাড়ছি।
সেদিন আর রান্না করেন নি সাধনা। ভেবেছিলেন চাট্টি মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়বেন। কিন্তু স্বামী না খেয়ে ফিরে আসায় তাকে সিদ্ধান্তটা বদলাতে হয়।হাড়িতে জল ছাকা ভাত ছিল। দ্রুত হাতে খানিকটা পোস্ত বেঁটে আর দুটো ডিমের ওমলেট বানিয়ে নেন। তারপর মুখোমুখি দুজনে খেতে বসেন। খেতে খেতেই স্বামীর আনমনা ভাবটা চোখ এড়ায় না সাধনার। তিনি যে এখনও অপমানটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না তা বুঝতে তার অসুবিধা হয় না। এমনিতে খুব নরম মনের মানুষ। রাগ ,দুঃখ, মান ,অপমান বেশিক্ষণ মনে থাকে না। যত তাড়াতাড়ি রাগেন , তার থেকে তাড়াতাড়ি রাগের উপশম হয়। কিন্তু বন্ধুদের কাছে অপমানটা নিশ্চয় বড়ো বেশি বুকে বেজেছে। তাই বোধ হয় সহজে অপমানের 
জ্বালাটা ভুলতে পারছেন না।স্বামীর মনটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য মনো আর ছন্দার প্রসঙ্গ তোলেন সাধনা।উদ্বিগ্ন গলায় বলেন ,  ছেলেমেয়ে দুটো বেলা গড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।ঠিকঠাক পৌছোল কিনা কে জানে ?
---- না পৌঁছানো কি আছে। তোমার মনো আর ছোট্টটি নেই। যথেষ্ট সাবালক হয়েছে। তারপরেও যদি হবু বৌকে নিয়ে নিরাপদে পৌঁছোতে না পারে তাহলে আর কবে পারবে ? ওর মতো বয়সে যে আমি ওর বাবা হয়ে গিয়েছিলাম গো।




                                স্বামীর কথা শুনে রক্তিম হয়ে ওঠে সাধনার মুখ। লজ্জা জড়ানো গলায় বলেন - খুব যেন একটা বাহাদুরির কাজ করে ফেলেছিলে।
স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে মুগ্ধ হয়ে যান ভুবনবাবু। এতদিন পরেও সাধনাকে সেই নোলক পড়া বালিকা বধুটির মতোই লাগে তার। আবেশ বিহ্বল গলায় বলেন , লজ্জা পেলে আজও তোমায় সেই আগের মতোই দেখায়। সেই বিদিশার নিশা , সেই বনলতা সেন। 
---- তোমার আর দেখে বাঁচি না। আর কয়েকদিন পরে বাড়িতে বৌ আসবে , আর উনি এলেন আমার মুখে বনলতা সেন খুঁজতে।
বললেন বটে কিন্তু সাধনার মনটা যেন হারিয়ে যায় অতীতের সেই দিনগুলিতে। ভোলেভালা গোছের হলেও লোকটা কিন্তু দারুন রোমান্টিক। তাকে নিয়ে কত রকম পাগলামি যে করতেন তার ঠিক নেই। সে সব ভাবলে আজও তার গায়ে পদ্মকাঁটা ফুটে উঠে। স্ত্রীকে চুপ করে যেতে দেখে ভুবনবাবু বলেন , মনোর জন্মের দিনটা তোমার মনে আছে।
---- তা নেই আবার ! তোমার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে আমি নয়, তুমিই যেন বাচ্চার জন্ম দিচ্ছ।
এক লহমায় সেদিনের সেই রাতটা যেন চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে ওঠে। রামপুরহাট হাসপাতালে জন্ম হয়েছিল মনোর। জন্মের দিন বিকালে ভর্তি হয়েছিল সে। সঙ্গে মা ছিল। প্রসব যন্ত্রনায়  সে যখন পেয়িং বেডে  ছটফট করছে তখন মা তাকে একা সামলে উঠতে পারছিল না।তাই ভুবনবাবুও তার কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে উদ্বিগ্ন স্বরে বার বার জিজ্ঞেস করছিল -- খুব কষ্ট হচ্ছে ? আর চোখ খুলে স্বামীকে দেখে যেন ব্যাথা ভুলে গিয়েছিল সাধনা। সব মেয়েই তো এই সময় যার সন্তানকে সে পৃথিবীতে আনছে তাকে পাশে দেখতে চায়। তাকে দেখতে পেলেই সে অনেক ব্যাথা ভুলে যায়। সাধনাও স্বামীর সোহাগ পরশে কিছুটা ভুলেছিল প্রসব যন্ত্রণা। আর সেদিনের সেই স্মৃতি আজকের অপমানের জ্বালা ভুলিয়ে দিল ভুবনবাবুকে। তারপর ফেলে আসা দিনগুলির কথাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে।




                    সুধাদির নিশ্চিন্তপুরের বাড়িতে  তখন ছন্দারাও গল্প গুজবে মেতে উঠেছে। সেদিন ছন্দাকে পৌঁচ্ছে দিয়েই হোস্টেলে চলে যেতে চেয়েছিল মনোতোষ। সুধাদিই আটকে দিয়ে বলেন , আজ আর হোস্টেলে ফিরে কাজ নেই। রাতটা এখানেই থেকে যা।কাল ছন্দার পরীক্ষার প্রথমদিন , ওকে একে বারে সেন্টারে পৌঁচ্ছে দিয়ে তারপর  যাবি। সেই জন্য  আর হোস্টেলে ফেরা হয় না তার। বেশ কিছু দিন হয়ে গেল গ্রাম ছেড়ে এখানে এসেছে রুম্পা। তাই গ্রামের সব খবর জানার জন্য এতদিন মনটা যেন ছট ফট করছিল তার। একে একে বাবা-মা-ভাইয়ের খবর নেওয়ার পাশাপাশি গ্রামের অন্য সব বিষয়ে খুঁটিনাটি সে ছন্দার কাছে জানতে চায়।কলেজ গড়ার কথা শুনে খুব খুশী হয় সে।খুশী খুশী গলায় বলে, কলেজটা হলে আমাদের গ্রামের চেহারাটাই বদলে যাবে দেখিস। বিয়েতে আমার হাতে কিছু টাকা যৌতুক পড়েছে। কলেজের জন্য তা থেকে কিছু টাকা যাওয়ার সময় তোদের হাতে দেব। মাস্টারমশাইকে দিয়ে দিবি।
কথায় কথায় এসে পড়ে সৌমেন-রীনার বিয়ের প্রসঙ্গও। শুনে রুম্পা বলে , বিয়ে হয়ে চলে এসে খুব ভালো হয়েছে বাবা। না হলে নিমন্ত্রণ করলে আবার গিয়ে ওদের বড়োলোকী দেখতে হত।
ছন্দা বলে , আগে নিমন্ত্রণ করত কিনা তাই ভাবো। যাই হোক না কেন এক সময় তো মনোদা সৌমেনের বন্ধু ছিল , তাও তাকেই বলে নি। গ্রামের বেশির ভাগ লোকও নিমন্ত্রণ পায় নি। বড়লোকী দেখাতে কাকুকে কার্ড পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ করেছিল মাত্র।
---- নিমন্ত্রণ না করলে গ্রামের লোকের ভারি বয়ে গেল! কবে ওদের বিয়ে হবে সেইজন্য সবাই আদাজল খেয়ে বসেছিল তো !
--- যা বলেছো রুম্পাদি।
গল্প শেষে বই নিয়ে বসে ছন্দা।সকালে কতোটা চোখ বোলাতে পারবে তার ঠিক নেই, তাই রাতেই বইটা একটু চোখ বুলিয়ে নেয় সে।সবাই তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। এক সময় ঘুম নেমে আসে তার চোখেও। পরদিন যথাসময়ে প্রভাত আর মনোতোষ ছন্দাকে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁচ্ছে দেয়। তারপর প্রভাত চলে যায় তার কর্মক্ষত্রে , মনোতোষ কলেজে। ঠিক হয় যে আগে আসতে পারবে সে'ই ছন্দাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু দেখা যায় প্রতিদিনই প্রভাতের আগে সেন্টারে পৌঁছে যায় মনোতোষ। ছন্দাকে কাছে পাওয়ার সুযোগটা কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাই না সে। সাইকেলের সামনে ছন্দাকে চাপিয়ে গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরে তারা। ফেরার পথে কোন কোন দিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে দুজনে ফুচকা কিম্বা কুলপি মালাই খায়। ফুচকা খেতে খেতে ছন্দা ঝালে হু -হা করে , আর তার পাটায় মুক্তোদানার মতো জমে ওঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নিজে খাওয়া  বাদ দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে শুধু ছন্দাকেই দেখে মনোতোষ। 

                             ( ক্রমশ )


নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                      ----০----


No comments:

Post a Comment