( কিস্তি --- ৪৯ )
নিজে খাওয়া বাদ দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে শুধু ছন্দাকেই দেখতে থাকে মনোতোষ। ছন্দাও খেতে খেতে তার দিকে চেয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসে। কারণ ততক্ষণে মনোতোষের খাওয়া থেমে গ্যাছে। সে একেবারেই ঝাল খেতে পারে না বলে হাতে শুধু শালপাতার ঠোঙাটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আর তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে একের পর এক ফুচকা খেয়েই চলে ছন্দা। তখন তাকে আরও ভালো লাগে মনোতোষের। এমন একটা দুষ্টুমিষ্টি মেয়ে তার জীবন সাথী হবে ভাবতেই ভালো লাগে তার।
ছন্দার পরীক্ষাগুলো প্রত্যাশা মাফিক হওয়ায় ওইভাবেই মহানন্দে দুজনের দিনগুলো কেটে যায়। শেষ পরীক্ষার দিন সেটা চরমে ওঠে। গ্রামাঞ্চলে বিনোদন বলতে তো তেমন কিছু নেই। গ্রামের ছেলেমেয়েদেরও অধিকাংশেরই শহরে বড়ো একটা আসা হয় না। সাধারনত মাধ্যমিক কিম্বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রথম শহরে আসার সুযোগ পায়। তাই শেষ পরীক্ষার দিন অনেকেই শহরে সিনেমা , সার্কাস দেখে বাড়ি ফেরে। সেই মতো মনোতোষ ছন্দাকে বলে , কালই তো তোর পরীক্ষা শেষ। সিনেমা হলে হংসরাজ বই হচ্ছে। সিনেমা দেখতে যাবি ?
সিনেমা দেখার কথা শুনে আনন্দে নেচে ওঠে ছন্দার মন।মা - ঠাকুরমাদের মুখে সে সিনেমার গল্প শুনেছে। ঠাকুমারা অবশ্য সিনেমাকে বলেন টকি। একসময় নাকি তাদের গ্রামের শিবরাত্রির মেলায় ম্যাজিক, সার্কাস, পুতুলনাচ, কলকাতার যাত্রার পাশাপাশি চটের ঘেরা করে টকিও বসত। মেলা ভেঙে গেলেও বর্ষা না নামা পর্যন্ত সেই টকি থেকে যেত। তারপর বালুচরের ডাঙায় খলপা বেড়া দিয়ে জয় টকিজ নামে টকিঘর করেছিলেন নবগ্রামের ধীরেন মন্ডল। সন্ধ্যাবেলায় রান্নাবান্না সেরে নিয়ে পাড়ার মেয়েরা সবাই দল বেঁধে টকি দেখতে যেতেন।
ঠাকুমায়ের মুখেই সে শুনেছে সে সব টকির নাম ছিল বিল্বমঙ্গল, আমি সে ও সখা, অচেনা অতিথি, নিমাই সন্ন্যাস, পিকনিক, রাগ-অনুরাগ, অজস্র ধন্যবাদ প্রভৃতি। ১৯৭৭ সালের বন্যায় সেই টকিঘর ভেঙে যায়। কিন্তু সেইসব সিনেমা দেখার স্মৃতি আজও উজ্বল হয়ে রয়েছে ঠাকুমায়ের মনিকোঠায়। মনোদার মুখেও সে সিনেমার গল্প শুনেছে। কিন্তু তার দেখার সৌভাগ্য হয় নি। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় কাকু ছিলেন। তাই ইচ্ছে হলেও মুখ ফুটে সাহস করে সিনেমা দেখার কথা বলা হয় নি। মনোতোষের কথা শুনে ছন্দা বলে, তাহলে খুব ভালো হবে মনোদা।
--- তা তো হবে , কিন্তু সুধাকাকীমাকে একবার বলতে হবে। ওনার অনুমতি নেওয়াটা জরুরী। নাহলে পরে বাবা-মা শুনে মনোক্ষুন্ন হতে পারেন। তুই পারবি ওনার অনুমতি আদায় করতে ?
--- সেটা হয়ে যাবে মনে হয়। আমি বললে কাকীমা না করতে পারবেন না। তাছাড়া রুম্পাদি-প্রভাতদাদেরও আসতে বলব। সবাই মিলে খুব মজা হবে।সেই মত সুধাদেবীর কাছে কথাটা পাড়ে ছন্দা। কথা শুনেই রুম্পাদিও লাফিয়ে ওঠে।
সুধাদিকে জড়িয়ে ধরে বলে , যাই না মা। আমাদেরও অনেকদিন সিনেমা দেখা হয়নি। আজ তো শনিবার। আপনার ছেলে সকাল সকাল ফিরে যাবে।
দুজনের পীড়াপীড়িতে মত দেন সুধাদেবী। প্রভাত ফিরলেই শুরু হয়ে যায় সিনেমা দেখতে যাওয়ার তোড়জোড়।যাওয়ার আগে সুধাদেবী প্রভাতের হাতে কিছু টাকা তুলে দেন। প্রভাত চাকরি করে বটে কিন্তু নিজের হাতে টাকা পয়সা বিশেষ একটা রাখে না। চাকরি পাওয়ার পর থেকে আজও প্রতিমাসে মাইনের টাকাটা তার হাতেই তুলে দেয়। বিয়ে হওয়ার পর সুধাদেবী কতবার বলেছেন , ওরে এবার থেকে মাইনের টাকাটা হয় নিজের কাছে নয়তো রুম্পার কাছে রাখ। রুম্পারও টুকিটাকি কেনা কাটার প্রয়োজনে টাকার দরকার লাগতে পারে। তা সে কথা কানে তুললে তো ! শোনা মাত্রই বলে ওঠে , তুমিই আমাদের ব্যাংক মা। আমাদের যখন যা দরকার পড়বে তোমার কাছেই চেয়ে নেব।
ছেলের কথা শুনে গর্বে বুক ভরে উঠেছে সুধাদেবীর। এমন সন্তান ভাগ্য ক'জন মায়ের হয় ? তিনি অবশ্য ছেলেকে গোপন করে প্রতিমাসেই কিছু কিছু করে টাকা বৌমায়ের হাতে তুলে দেন।নিজের ব্যক্তি অভিজ্ঞতা থেকে তিনি মনে করেন প্রতিটি মানুষের আর্থিক স্বাধীনতা থাকাটা জরুরী। তাছাড়া এমন কিছু কেনাকাটা আছে তার জন্য সব সময় অন্যের কাছে টাকা চাইতে কেমন যেন বাধো বাধো লাগে। রুম্পাকে তিনি কোনদিনই সেই পরিস্থিতির মুখে পড়তে দেবেন না।সন্ধ্যার মুখেই দুটি সাইকেলে ওরা সিনেমা দেখতে বেরিয়ে যায়। ছন্দাকে আজ একেবারে অন্যরকম লাগছে। আজ তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে রুম্পা।নিজের বাসন্তী রঙের একটি শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে।
চোখে কাজল, ঠোটে হালকা লিপস্টিক , রজনীগন্ধা সেণ্টের মিস্টি সুবাস। শাড়ি পড়া অবস্থায় ছন্দাকে অবশ্য এই প্রথম দেখছে না মনোতোষ। তবে সে ছিল স্কুলের নির্ধারিত লাল পাড় সাদা শাড়ি। সেই শাড়িতেও যেদিন ছন্দাকে প্রথম দেখেছিল সেদিনও ভালো লেগেছিল। কেমন যেন সরস্বতী সরস্বতী মনে হয়েছিল তখন। আর রঙিন শাড়িতে এই প্রথম দেখছে ছন্দাকে। কেমন যেন নববধুর মতো লাগছে তাকে। ছন্দাকে এভাবে সাজিয়ে দেওয়ার জন্য মনে মনে রুম্পাকে ধন্যবাদ জানায় মনোতোষ।সিনেমা হলে পৌঁচ্ছেই ছন্দা লক্ষ্য করে প্রভাতদাকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে রুম্পাদি কানে কানে কিছু বলে। তারপরই কাউন্টারে টিকিট কাটতে চলে যায় প্রভাতদা। কিছুক্ষণ পরেই মনোদার হাতে দুটো টিকিট ধরিয়ে দিয়ে বলে , তোদের বাঁ দিকের কোনে আর আমাদের ডানদিকের কোনে সিট নিলাম।
শুনেই ছন্দা বলে , তা কেন ? একসঙ্গে চারটে সিট নিলে কি হোত ?
---- তাহলে যদি আবার সাঁকো উল্টানোর মতো সিনেমা হলের সিটটাও উল্টে দিস !
বলে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে রুম্পাদি। তখন প্রভাতদাকে ডেকে রুম্পাদি যে আলাদা টিকিট কাটার কথাই বলছিল তা আর বুঝতে বাকি থাকে না ছন্দার।তাই ছন্দাও লজ্জা জড়ানো গলায় বলে , রুম্পাদি তুমি না--।
---- কি তুমি না ?
---- তুমি একটা যাচ্ছেতাই ? আজও সেই কথাটা ভুলতে পারলে না ?
---- কি করে ভুলি বল ? ওই ঘটনাটা না ঘটলে যে তোর ভুল ভাঙত না রে।
মুখে কপট রাগের ভাব দেখালেও রূম্পাদির বিবেচনায় খুশীই হয় ছন্দা। তার সঙ্গে মনোদার ভাবী সম্পর্কের কথা রুম্পাদিদের জানা হলেও তাদের সামনে সে কিছুতেই মনোদার পাশে বসে আড়ষ্টতা কাটাতে পারত না। অস্বস্তির মধ্যেই থাকতে হত সব সময়। তার মনের ভাবটা বোধ হয় পড়তে পারে রুম্পাদি। তাই বলে , উপরে উপরে যাই বলিস না কেন , মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ খুশীই হয়েছিস।
---- রুম্পাদি তুমি না ---।
সেই সময় বেজে উঠে সিনেমাহলের প্রথম ঘন্টি। রুম্পাদি তাড়া লাগায় -- চল চল , এবার আলো নিভে গেলে সিটে পৌঁছোতে অসুবিধা হবে।
রুম্পাদির তাড়া খেয়ে হলে ঢুকে আপন আপন সিটে বসে বাদাম চিবোতে শুরু করে তারা। তারই মধ্যে আলো নিভে আসে। সিনেমা শুরু হতেই মনোতোষ ছন্দার হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয়।সিনেমা দেখতে দেখতে একাত্ম হয়ে পড়ে দুজনেই। নায়িকা টিয়ার সঙ্গে ছন্দার মিল খুঁজে পায় মনোতোষ। আর নায়ক হংসরাজের নয়, যেন তার মনোদাই শহরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে একের পর এক প্রতারিত হচ্ছে ভেবে কেঁদে ভাসায় ছন্দা। সিনেমাহল থেকে বেরনোর পরও যেন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে তারা। সেটা লক্ষ্য করে রুম্পাদি টিপন্নী কাটে , কি রে বাড়ি টাড়ি যাবি না, নাকি আর একবার দেখবি ?
তখন ঘোর কাটে দুজনের।ছন্দা বলে , সত্যি বলছি আবার দেখতে ইচ্ছে করছে।
---- তা তো করবেই। নিজেদের যে টিয়া হংসরাজ ভেবে বসে আছো। সে যাই ভাব না কেন, এবারের মতো ক্ষমা দাও। এর পরে শ্রীমতি হংসরাজ হয়ে যত পারো সিনেমা দেখো। আমার তো বাড়িতে শাশুড়ি আছে। তাই সময়মতো ফিরতে ভাই। নাও এবার চলো।সিনেমার গল্প করতে করতেই যেন একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফেরে সবাই। বাড়ি ফিরেই ছন্দাকে নিয়ে পড়ে ওরা। সবাই ওর পিছনে লাগে। প্রথম মুখ খোলে প্রভাতদা। ছন্দার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বলে , যাই বলো না কেন, ছন্দাকে কিন্তু আজ সত্যিই টিয়ার মতোই দেখাচ্ছে। মনো কি বলছিস ?
---- সে আর বলতে ?
তারপর তার দিকে চেয়ে মনোদা চোখটা ট্যারা করে সুর ধরে, টিয়া - টিয়া অজপাড়া গায় থাকে / ট্যারা চোখে তাকায় টিয়া নোলক পড়া নাকে। '
ছন্দা রাগ দেখিয়ে তেড়ে যায় মনোতোষকে। মনোতোষ ছুটে কিছুটা দূরে গিয়ে আরও জোরে জোরে গাইতে শুরু করে।
ছন্দা সেদিকে ছুটে যেতেই উল্টো দিক থেকে রুম্পাও সুর ধরে -- ' হংসরাজা বর যে তারই / টিয়া চলে শ্বশুরবাড়ি।' তাদের মজা দেখে হাততালি দিয়ে ওঠে সুধাদেবী। আর তত রেগে ওঠে ছন্দা। একসময় আলতো করে মনোদা চুলের মুঠি ধরে সুধাদির কাছে টেনে আনতে থাকে ছন্দা। আর মনোতোষ বলে , হাত জোড় করছি, আর বলব না। লাগছে লাগছে। ছাড় প্লিজ।
সেই সময় ছন্দার হাতটা একটু আলগা হতেই মনোতোষ ছুটে গিয়ে সুধাদেবীর পিছনে দাঁড়িয়ে ফের ছন্দাকে রাগাতে শুরু করে। ছন্দাও ছুটে যায় তাকে ধরার জন্য। সুধাদিকে ঘিরে দুজনেই পাকে পাকে ঘুরতে থাকে। তা দেখে কপট শাসনের সুরে সুধাদেবী বলেন , ছেলেমেয়ে দুটো কি করে দেখ দেখি বাপু। তোদের হুটোপুটিতে আমি পড়ে যাব যে। বলি হলো টা কি শুনি ?
অভিমানী মেয়ের মতো ছন্দা ঠোঁট ফুলিয়ে বলে , দেখ না কাকীমা, সিনেমা দেখে এসে সবাই আমার পিছনে লাগছে। খালি ট্যারা বলে খ্যাপাচ্ছে।
--- তুই ই বা ওদের কথা কানে তুলছিস কেন ? তুই কি ট্যারা ?
--- কিন্তু ওরা রাগাচ্ছে যে ---।
--- বলুক গে। তুই তো আর ট্যারা নোস।
সেই সময় ফুট কাটে রুম্পা। সুধাদেবীকে উদ্দেশ্য করে বলে,, মা তুমি বলছো বটে ছন্দার ডান চোখটা কিছুটা ট্যারাই মনে হচ্ছে। এতদিন আমরা হয়তো সেইভাবে লক্ষ্য করি নি বলেই ধরতে পারি নি। তারপর প্রভাতকে সাক্ষী মেনে বলে , কি গো তোমার কি মনে হয় ?
প্রভাতও যেন জবাব দেওয়ার জন্য মুখিয়েছিল। রুম্পার কথা শেষ হতেই বলে উঠে , আমার তো মনে হচ্ছে বাঁ চোখটাই ট্যারা।
ফোড়ন কাটতে বাকি থাকে না মনোতোষও। সে বলে , ইঃ মা, দুটো চোখই ট্যারা নাকি ?
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ছন্দা। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে উঠে , একদম ভালো হবে না বলে দিচ্ছি কিন্তু।
অমনি সবাই হো-হো করে হেসে উঠে। আর ছন্দা আচমকা ছোটমেয়ের মতো ভ্যা করে কেঁদে ওঠে। সুধাদেবী তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, বোকা মেয়ে ওরা তো তোর সঙ্গে মজা করছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, আর তুই পারলি না। তোর মতো মেয়ে বাইশ লাখ, না -- না সাড়ে বাইশ, না -না পুরোপুরি তেইশ লাখে একটা মেলে।
সুধাদেবীর বলার ধরণে ফিক করে হেসে ওঠে ছন্দা।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment