( কিস্তি --- ৫০ )
সুধাদেবীর বলার ধরণে ফিক করে হেসে ওঠে ছন্দা। হাসি - ঠাট্টা আর গল্প-গুজবেই সেদিনের রাতটা কেটে যায়। সেদিনও আর হোস্টেলে ফেরা হয় না মনোতোষের। সকালেই সে ছন্দাকে বাড়িতে পৌঁচ্ছে দিতে যাবে। তাই আনন্দের মাঝেও সবার মনে যেন বিষাদের সুর বাজে। সকালেই মনোদের বাস। তাই সুধাদেবী ভোর ভোর উঠে ওদের চা জল খাবারের ব্যবস্থা করেন। বেরোনোর আগে সুধাদিরা তিনজনেই আলাদা আলাদা ভাবে কলেজের চাঁদা বাবদ দুশো টাকা করে ছন্দার হাতে তুলে দেন। তারপরই সুধাদেবীকে প্রনাম করে , রুম্পাদির কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখে তারা দুজনে। প্রভাতদা তাদের বাসে তুলে দিয়ে যায়। বাসে আসতে আসতে সুধাকাকীমাদের জন্য মন কেমন করে ছন্দার। খুব আনন্দেই দিন ক'টা কেটে গেল সুধাকাকীমায়ের স্নেহছায়ায়।
রুম্পাদির সঙ্গে খুনসুটি , প্রভাতদার আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারের কথা খুব মনে পড়ছে ছন্দার। সবথেকে বড়ো কথা এই ক'দিন মনোদার সঙ্গে খোলাখুলি মিশতে পেরেছে সে। তার মধ্যে সিনেমা দেখার কথাটা সে জীবনে ভুলতে পারবে না। মনোদারা তাকে রাগালেও তার মনে হয় সে যেন টিয়া আর মনোদা যেন তার হংসরাজ। ওইসব কথা ভাবতে ভাবতেই ছন্দা যেন কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। মনোদার নাড়া খেয়ে বাস্তবে ফেরে। মনোদা তাকে নাড়া দিয়ে বলে, কি রে , কি ভাবছিলি এতক্ষণ ?
ততক্ষণে মনোদার হাতের মুঠোয় ঘেমে উঠেছে তার হাত। সেটা লক্ষ্য করে সে হাতটা টেনে নেওয়ার চেষ্টা করতেই মনোতোষ বলে , থাক না মধু।
মনোদার মুখে মধু ডাকটা যেন তার কানে মধু ঢালে। এই প্রথম মনোদা তাকে মধু নামে ডাকল। সে আবেশভরা দৃষ্টিতে মনোদার দিকে চেয়ে থাকে।খুব ইচ্ছে করে মনোদার মাথাটা বুকে জড়িয়ে চুলোগুলো এলোমেলো করে দেয়।চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় তার সারাটা মুখ । কিন্তু বাসে তো আর তা সম্ভব হয় না । তবে মনে মনেই সে মনের ইচ্ছে গুলো পূরণ করে নেয়।
মনোদার কানের কাছে গলা নামিয়ে বলে -- কি সুন্দর !
---- কিসের কি সুন্দর ?
---- ওই যে মধু ডাক।
--- তোর ভালো লেগেছে ?
--- খুউব। তুমি আমায় ওই নামেই ডেকো না গো মনোদা।
---- সবার সামনে ওই নামে ডাকা যে বড়ো লজ্জার হবে রে।
---- তাও বটে। আচ্ছা বিয়ের পরও কি তুমি আমাকে তুই তোকারি করবে নাকি ?
--- তাই তো রে ! এত দিনের অভ্যাস। হঠাৎ করে তুই ছেড়ে তুমি বলতেও খুব লজ্জা করবে। বিশেষ করে বাবা মায়ের সামনে। তুই বললে তোর কি আপত্তি আছে ? তুই কি রাগ করবি ?
---- এঃ মা তাই কখনো হয় ? বউয়ের সঙ্গে কি কেউ তুই-তোকারি কথা বলে ?
--- তা কিন্তু বলে। আমাদের গ্রামের ভজনকাকা , মদনদাদুরা তো তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে তুই তোকারি করেই কথা বলে।
---- সে যারা বলে তারা বলে। তুমি বললে আমি তোমার সঙ্গে কথাই বলব না যাও।
---- বেশ বাবা বেশ তাই হবে। একদিনে পারব না হয়তো, অভ্যাস করতে হবে।
--- তাই করবে। আজ থেকেই শুরু করে দাও।
---- বেশ তাই করছি। মধু এবার ওঠো , নামতে হবে।
মনোদার খুনসুটিতে কখন যে বাসটা তাদের স্টপেজের কাছে পৌঁছে গিয়েছে তা টের পায় নি ছন্দা। মনোদার হাত ধরে বাস থেকে নামে সে।বাড়িতে পা রাখতেই সাধনা এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরেন ছন্দাকে। তারপর তার মাথায় চুমু খেতে খেতে বলে , ওরে মা রে সাতদিন ছিলি না। মনে হচ্ছিল যেন সাত যুগ।
ছন্দা একে একে কাকু - কাকীমাকে প্রনাম করে। তারপর ভুবনবাবুর হাতে সুধাকাকীমাদের দেওয়া টাকাগুলো তুলে দেয়।টাকাগুলো পেয়ে অভিভূত হয়ে পড়েন ভুবনবাবু। উচ্ছস্বিত গলায় বলেন , কি কাকতালীয় ব্যাপার ! পঁচিশ হাজার পূর্ণ হতে এই টাকা ক'টার ঘাটতি ছিল আমাদের। এলাকার সমস্ত গ্রামের প্রায় সব বাড়ি ঘোরা হয়ে গিয়েছে। তাই কি করে ঘাটতি পূরণ হবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। সর্বোপরি টাকার অংকটা বড়ো কথা নয় , আমাদের গ্রামের কলেজের জন্য সুধাদিদের এই সাহায্য আমার মনোবল আরও বাড়িয়ে দিল। সেই মনোবলের জোরেই তারপর থেকে দিনরাত এক করে কলেজের সরকারি অনুমোদনের জন্য নেমে পড়েন ভুবনবাবু। স্কুল আর প্রস্তাবিতই কলেজই তখন তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। তেমন সংসার মনস্ক কোনদিনই ছিলেন না ভুবনবাবু। বেতনের টাকাটুকু সাধনার হাতে তুলে দিয়েই খালাস।
সংসারের সব হায় দায় সামাল দিতে হত সাধনাকে। তবু সে সময় ছুটির দিনগুলিতে স্বামীকে কাছে পেতেন সাধনা। কিন্তু এখন কাজের দিনে তো বটেই , অধিকাংশ ছুটির দিনেও ফাইল বগলে শিক্ষা দফতরের নেতা মন্ত্রীদের বাড়িতে ছোটাছুটি করতে হয় ভুবনবাবুকে। কিছুটা অভিমান হলেও এলাকার মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে তা ভুলে যান সাধনা। যখনই সবাইকে বলতে শোনেন আমাদের কলেজটা কিন্তু তোমাকে করতেই হবে মাস্টার তখন সব ভুলে যান তিনি। মনে হয় নেতা মন্ত্রীরা থাকতেও যাকে মানুষ এত ভরসা করে তাকে সংসারের মাঝে না'ই বা পেল সে ! কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের মতো যেদিন কলেজটাও হয়ে যাবে সেদিন যে তার স্বামী মানুষের নয়নের মণি হয়ে উঠবে। সেই আশাতেই সাধনাও স্বামীকে অনুপ্রেরণা যোগান। নিজের ঘাড়েই তুলে নেন সংসারের যাবতীয় ঝামেলা। এতটুকু আঁচ লাগতে দেন না স্বামীর গায়ে। কেবল কোন বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে আলোচনার জন্য স্বামীর স্মরণাপন্ন হতে হয় তাকে।
সেইরকমই একটি বিষয়ে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করাটা জরুরী হয়ে পড়ে তাঁর। দিন কয়েক আগেই ছন্দার উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে।প্রত্যাশা মতো সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছে সে। সবাই খুব খুশী হয়েছে। কলেজের ব্যস্ততার মাঝেও ভুবনবাবুরও খুশীর বহ্বিপ্রকাশের ঘাটতি দেখা যায় না। খবরটা শোনার পরই নিজে থেকেই বলেন , এই উপলক্ষ্যে একদিন তো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয় নাকি ? বলেই ছন্দার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন ভুবনবাবু। ছন্দা কিছু জবাব দিতে পারে না। কিন্তু তার খুব ভালো লাগে। মনোদার পরীক্ষা পাশের সময়ও খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাকেও যে কাকু মনোদার মতোই ভালোবাসেন , মেয়ে বিশেষ করে পরের মেয়ে ভাবেন না তা জেনেই তার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায় ছন্দার।
কিন্তু এখন কাকুর আর্থিক অবস্থার কথা তার অজানা নয়। কয়েক মাস আগেই রুম্পাদির বিয়েতে ভালোই খরচ হয়ছে। কলেজ নিয়ে ঘোরাঘুরিতেও কাকুর পকেট থেকেই খরচ হচ্ছে। উদ্যোক্তারা অবশ্য বার বার কাকুকে চাঁদার টাকা থেকেই খরচ করতে বলেন।কিন্তু কাকু সে রকম মানুষই নন। চাঁদার টাকা থেকে তিনি একটা পয়সাও খরচ করবেন না। যেদিন কোথাও যান কাকীমার কাছে থেকে টাকা চেয়ে নেন। তার উপরে মনোদার পড়ার খরচ তো আছেই। এই পরিস্থিতিতে তার পরীক্ষা পাশের জন্য খাওয়া-দাওয়ার জন্য খরচ করতে হলে সংসারের সবদিক সামাল দিতে গিয়ে কাকীমা মহা চাপে পড়ে যাবেন। কিন্তু এ বিষয়ে তার কিছু বলাটাও শোভা পায় না। তাহলে ছোট মুখে বড়ো কথা বলা হয়ে যাবে তার। তাই সে অসহায়ের মতো মনে মনে ছটফট করতে থাকে। কাকুর সান্ধ্য আসরের বন্ধুরাই ওই পরিস্থিতি থেকে তাকে রক্ষা করেন। তারাই বলেন , দাদা যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা বলি ?
--- কি কথা ?
--- এই তো একটা বড় খরচ থেকে উঠলে। তারপর কলেজ , মনোর পড়াশোনায় খরচ তো লেগেই আছে।খাওয়া দাওয়া তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আমরাও পালিয়ে যাচ্ছি না। তাই সবদিক একটু সামলে নিয়ে আয়োজন করলে ভালো হতো না ?
সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের কথাটার যৌক্তিকতা অস্বীকার করতে পারেন না ভুবনবাবু। সাধনা অবশ্য আর্থিক সংকটের আঁচ তার গায়ে লাগতে দেন না।তাই তিনি সংকটের ব্যাপারটা বুঝতেও পারেন না।কিন্তু সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের কথায় তার মনে হয় সত্যিই তো এই অবস্থায় আরও একটা খরচের ধাক্কা সামলাতে হলে সাধনাকে আরও চাপের মধ্যে পড়তে হবে। কিন্তু বড়োমুখ করে বলার পরও বন্ধুদের খাওয়াতে না পারায় অক্ষমতার গ্লানি যেন তাকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে।
সেটা আন্দাজ করে মনে মনে খুব কষ্ট পায় ছন্দা।কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য তার বাবাই সেই কষ্টটা দুর করে দেয়।ভুবনবাবুর অক্ষমতার জ্বালাটা সম্ভবত মলয়ও উপলব্ধি করতে পারে। তাই বিনয়ের সঙ্গে বলে , দাদা ছন্দা শুধু আমাদেরই নয় , আপনাদেরও মেয়ে। তাই তার ব্যাপারে আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন তা নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। তবে আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি একটা কথা বলতে পারি।
--- কি কথা , বলো ?
---- বলছি দাদা আমার মায়ের খুব ইচ্ছা একবার আপনাদের পায়ের ধুলো আমাদের বাড়িতে পড়ুক।তাই আপনি অনুমতি দিলে এবারের খাবারের আয়োজনটা আমি করতে পারি।ভুবনবাবু কিছু বলার আগে তার সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা সমস্বরে বলে উঠেন -- এর মতো ভালো প্রস্তাব আর হয় না। অগত্যা ভুবনবাবুকে মত দিতে হয়। দুশ্চিন্তার মেঘ সরে যাওয়ায় হাসি ফোটে ছন্দার মুখে। পরদিনই মহা সমারোহে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয় ছন্দাদের বাড়িতে। ভুবনবাবুর সান্ধ্য আসরের বন্ধু , ডাক্তারবাবু এমন কি রুম্পার বাবা-মাকেও নিমন্ত্রণ করা হয়।খাওয়া দাওয়া চুকতেই সেদিন অনেক রাত হয়ে যায়।ফেরার মুখে সাধনাকে পাশে ডেকে কথাটা পাড়েন ছন্দার ঠাকুমা।শান্তিলতার কথাটা শুনে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েন সাধনা।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment