Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৫১




     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











              কালের কারিগর
              

                         অর্ঘ্য ঘোষ

                    (  কিস্তি --- ৫১ ) 


শান্তিলতার কথাটা শুনে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েন সাধনা।সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়া করে অন্যরা একে একে চলে যাওয়ার পর তাকে একটু নিভৃতে ডেকে নিয়ে গিয়ে শান্তিলতা  বলেন , বলছিলাম কি মা , আমি আজ আছি কাল নেই। ছন্দার তো আঠারো বছর পূর্ণ হয়ে গেল। ওদের বয়সী ছেলেমেয়েদের তো আর কারও বিয়ে হতে বাকি নেই। এবার মনো আর ছন্দার চার হাত এক করে দিলে হত না ? আমি থাকতে থাকতে তাহলে ওদের বিয়েটা দেখে যেতে পারি।
কথাটা শুনেই একটু যেন অপ্রস্তুতেই পড়ে যান সাধনা। শান্তিদেবীর অনুযোগ অমূলক নয়। গ্রামে ওদের বয়েসী কোন অবিবাহিত ছেলেমেয়ে নেই। অনেকদিন আগেই তো মনোর সহপাঠী সৌমেনের সঙ্গে রীণার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এই তো সেদিন পাশের গ্রামের সুবর্ণা নামে ছন্দার এক সহপাঠিনীর সঙ্গে মনোর এক বন্ধু সুরেশেরও বিয়ে হয়ে গেল।তাই শান্তিলতাদের উদ্বেগ স্বাভাবিক। সব বাবা-মা, দাদু-ঠাকুমাই চান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিতে। তাছাড়া তারাই তো বলেছিলেন , ছন্দার আঠারো বছর বয়েস পূর্ণ হলেই তাকে ছেলের বৌ করে ঘরে তুলবেন। এতদিন কেউ বলার আগেই সেটা করা তাদের উচিত ছিল। তাই শান্তিলতার কথাটা শুনে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাকে। বিড়ম্বনা কাটাতে বলেন , এরই মধ্যে আপনি চলে যাবেন বললেই আপনাকে আমরা যেতে দিলেই তো।ওদের বিয়ে দেখুন।পই নাতি-নাতনির মুখ দেখুন তারপর যাওয়ার কথা ভাববেন।আমি বাড়ি ফিরে গিয়েই ছন্দার কাকুর সঙ্গে কথা বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করছি।
ফেরার মুখে শান্তিলতা সাধনার হাত দুটো ধরে বলেন , কথাটা বললাম বলে কিছু মনে কোর না যেন মা। বোঝই তো সব। গ্রামের মানুষ পাঁচজনে পাঁচ কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। সবই তো কানে আসে। শুনতে খারাপ লাগে তাই কথাটা বললাম। 
--- না না মনে করব কেন ? এই বিষয়টা তো আমাদেরই আগে ভাবা উচিত ছিল।
বিষয়টি নিয়েই স্বামীর সঙ্গে আলোচনাটা জরুরী হয়ে পড়েছিল সাধনার। তাই সেদিন রাতেই বাড়ি ফিরে স্বামীর কাছে কথাটা পাড়েন তিনি। বিছানায় স্বামীর বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন , হ্যা গো এবার ওদের বিয়েটা না দিলে আর ভালো দেখায় না। লোকে নানা কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। ছন্দার ঠাকুমাও আজ কথা তুলেছিলেন। 
স্ত্রীকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে  ভুবনবাবু বলেন, ঠিকই বলেছো। কিন্তু আমি চাইছি মনো একটা চাকরি বাকরি পাক , তারপরই ওদের চার হাত এক করে দেব।না হলে এখনই বিয়ে দিয়ে দিলে পড়াশোনার ক্ষতি হতে পারে। আর তো একটা বছর। দেখতে দেখতেই পেরিয়ে যাবে। আর আমার ধারণা ওর মতো ছেলেকে পাশ করে বেশিদিন বসে থাকতে হবে না। ঠিক কোথাও না কোথাও  চাকরি জুটে যাবে। ততদিন আমি কলেজের ব্যাপারটা একটু সামলে নিই।
সেইমতো একদিন শান্তিলতাকে স্বামীর অভিপ্রায়ের কথাটা খুলে বলেন সাধনা। তখন তিনিও বিষয়টির যৌক্তিকতা অনুধাবন করেন।তার অনুযোগ ভুবনবাবুর যুক্তিতে প্রশমিত হয়।তাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই তিনি বলেন, সেটাই সবদিক থেকে ঠিক হবে মা। আমি এদিকটা অত তলিয়ে ভাবি নি। সাধে কি আর বলে মাস্টারের মাথা।



                           তারপর থেকে কলেজ নিয়ে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েন ভুবনবাবু। কলেজ স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত দাবি পূরণ করা স্তত্বেও কিছুতেই আর সরকারি ছাড়পত্র মেলে না। দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে হাল ছেড়ে দেন সংগঠক কমিটির সদস্যরা। কিন্তু হাল ছাড়েন না ভুবনবাবু। ফাইল নিয়ে জেলা শিক্ষা দফতর থেকে রাজ্য উচ্চ শিক্ষা দফতরে সমান তালে দৌড়ঝাঁপ করতেই থাকেন। পাশাপাশি একাই কলেজের দাবিতে গ্রামে গ্রামে গণস্বাক্ষর  সংগ্রহও শুরু করে দেন। গণ স্বাক্ষরিত সেই স্বারকলিপি প্রশাসনের সকল স্তরে পাঠিয়ে দিয়ে সরকারি অনুমোদনের আশায় দিন গোনেন ভুবনবাবু। কিছুতেই হতোদ্যম হন না তিনি। সবসময় মনে হয় সবাই বিশ্বাস করে তার হাতে টাকা তুলে দিয়েছেন।তাদের কি জবাব দেবেন ? এত লোকের আশা ভরসা সব কি বৃথা যাবে ? গ্রামাঞ্চলের ছেলেদের কাছে উচ্চ শিক্ষা অধরাই থেকে যাবে ? তারই মধ্যে দেখতে দেখতেই বছর ঘুরে যায়। ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে বি,এ, সি পাশ করে গ্রামে ফিরে আসে মনোতোষ। পরিবারে খুশীর হাওয়া বয়ে যায়। ঠিক হয় বাবার মতোই কোন একটা চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর প্রাইভেটে এম, এ , সি'টা করে নেবে মনোতোষ। তারই মাঝে বিয়ের পর্বটাও চুকিয়ে ফেলতে হবে। তাই শুরু হয় চাকরির খোঁজ। সেই সময়ই অবসর নেন ভুবনবাবুদের স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক সত্যবাবু। তার স্থলে নতুন শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। স্কুলের পরিচালন সমিতি শিক্ষক নিয়োগের জন্য যথাসময়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে।পদাধিকার বলে পরিচালন সমিতির যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে সেই বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষরও করেন ভুবনবাবু। কিন্তু বিজ্ঞানে অত ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করা স্বত্ত্বেও নিজের ছেলেকে আবদেন করতে বারণ করেন তিনি। কথাটা শুনে মনো তো বটেই বিস্মিত হন সাধনাও। স্বামীর এহেন সিদ্ধান্তের কারণ কিছুতেই বোধগম্য হয় না তার। তাই খোলাখুলিই জিজ্ঞেস করেন -- এ তোমার কেমন ধারা কথা ?  
গ্রামের স্কুল , তার উপরে সেই স্কুলেই তুমি হেডমাস্টার। কোথাই ছেলেকে ঢুকিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে দেবে তা না , কোন যুক্তিতে ছেলেকে দরখাস্ত করতেই বারণ করছো বুঝি না ?
--- আমি ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সেটাই বড়ো বাধা সাধনা।তার উপরে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নির্বাচকমন্ডলীতে আমার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মনোর যা রেজাল্ট তাতে  আবেদন করলে চাকরিটা ও'ই অবধারিত পাবে। কিন্তু লোকে তো অত বুঝবে না , ভাববে বাবাই কায়দা করে ছেলেকে ঢুকিয়ে দিল।
---- বাইরের লোকে কে কি বলবে ভেবে তুমি ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবে ? 
---- দেখ আমরা সমাজবদ্ধ জীব। তাই লোকের কথাকে গুরুত্ব দিতে হবে বৈকি। তাছাড়া মনোর ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে ভাবচ্ছ কেন ? ও যেখানে আবেদন করবে সেখানেই চাকরি পাবে। তারপর আমি অবসর নেওয়ার পর না হয় গ্রামের স্কুলে যোগ দেবে। তাতে কেউ আর গায়ে কালি ছেটাতে পারবে না। তুমি কি চাও লোকে আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিক ?




                          স্বামীর মতাদর্শটা অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না সাধনার। মানুষটা ওই রকমই। নীতি আদর্শের জন্য নিজের সর্বস্ব জলাঞ্জলি দিতে কখনও পিছু পা হন না। তা নিয়ে তার চাপা গর্বও আছে। তাই আর কিছু বলেন না তিনি। কিছু বলতে পারে না মনোতোষও। আজকের দিনে এমন সুযোগ ক'জন হেলায় হারাতে পারে ? তাই বাবার জন্য শ্রদ্ধায় তার মাথা নত হয়ে আসে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বাবার মতো সে'ও সারাজীবন নীতি আদর্শ আঁকড়ে চলবে। তাতে হয়তো প্রতিষ্ঠা মিলবে না, কিন্তু মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা মন প্রাণ ভরিয়ে দেবে। কোন প্রতিষ্ঠাই তার চেয়ে মুল্যবান নয়। কিন্তু বিষয়টা জানার পর পরিচালন সমিতির সদস্যরা ছাড়েন না ভুবনবাবুকে। সেদিন সন্ধ্যা বেলায় সবাই এসে চেপে ধরেন তাকে। স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক সুহৃদবাবু বলেন , এ কি শুনছি মাস্টারমশাই ?  আপনি নাকি ছেলেকে আমাদের স্কুলে আবেদন করতে দিচ্ছেন না ?  এটা আমরা মানতে পারছি না। এত ভালো ব্রাইট রেজাল্ট করা একটি ছেলেকে শিক্ষক হিসাবে পাওয়া থেকে আমাদের স্কুলকে আপনি বঞ্চিত করতে পারেন না। বিশেষত সে আমাদের স্কুলেরই ছাত্র। নিজের স্কুলের প্রতি তার একটা আলাদা দরদ থাকবে। আর বাইরে থেকে যে আসবে সে হয়তো নিছক চাকরি করতেই আসবে।
পরিচালন সমিতির সদস্যদের যুক্তির কাছে হার মানতেই হয় ভুবনবাবুকে।কিন্তু তিনি একটা শর্ত আরোপ করে বসেন। বিনয়ের সঙ্গেই বলেন , তাহলে আমার একটা অনুরোধও আপনাদের রাখতে হবে।
---- কি অনুরোধ ?
---- ওই নিয়োগের নির্বাচক মন্ডলী থেকে আমাকে বাইরে রাখতে হবে।
পরিচালন সদস্যরাও বিষয়টি উপলব্ধি করেন। তাই তারা বলেন , ঠিক আছে।আপনার পরিবর্তে তাহলে সহকারি প্রধান শিক্ষককেই নিয়ে নির্বাচক মন্ডলী গঠিত হবে। সেইমতো কারণ উল্লেখ করেই পরিচালন সমিতির বৈঠক ডেকে সেই সিদ্ধান্ত নথিভুক্ত হয়। স্কুলের ইতিহাসে এই প্রথম প্রধান শিক্ষক থাকতেও সহকারি প্রধান শিক্ষককে নিয়ে শিক্ষক নিয়োগের নির্বাচক মন্ডলী গঠনের সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে ওঠে। শুনে সবাই ধন্য ধন্য করে উঠে। সবাইকেই বলতে শোনা যায় , সত্যযুগে এমন সততার গল্প শুনেছি। কলিযুগে এমন মানুষ দেখাই যায় না। শেষ পর্যন্ত পরিচালন সমিতির পীড়াপীড়িতে বাবার অনুমতি নিয়ে শেষ দিনে আবেদনপত্র জমা দেয় মনোতোষ। প্রত্যাশিতভাবেই সে'ই নিকটতম প্রতিযোগীকে অনেক পিছনে ফেলে প্যানেলের প্রথমস্থান দখল করে। নিয়োগ পত্র নিয়ে বাড়িতে ফিরেই মায়ের হাতে সেটা তুলে দেয় মনোতোষ। তারপর বাবা-মাকে প্রনাম করে। ছেলেকে আর্শিবাদ করতে করতে ছন্দাকে ডাকেন সাধনা। খবরটা শোনার পর থেকেই ছন্দার মনের ভিতর যেন খুশীর প্লাবন বইতে শুরু করেছে। পাছে আতিশয্য প্রকাশ হয়ে পড়ে সেই আশংকায় সে তখন মনোদার পড়ার ঘরে গিয়ে গোছগাছের অছিলায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার ভান করছিল। সাধনার ডাক শুনে -- যাই কাকীমা বলে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে।
সাধনা মনোতোষের নিয়োগপত্র আর একটা চাবি তার হাতে দিয়ে বলেন ,  পড়ার ঘরের আলামারিতে এটা তুলে রাখ। এবার থেকে নিজের জিনিস তোকেই দায়িত্ব করে রাখতে হবে।
কাকীমার কথা শুনে খুব লজ্জা পেয়ে যায় ছন্দা। কাকীমাটা যেন কি ? কয়েকদিন পরেই মনোদা তার একান্ত নিজের মনের মানুষ হয়ে যাবে ঠিকই কিন্তু কাকুর সামনে এভাবে বললে বুঝি লজ্জা করে না ? তাছাড়া নিজের জিনিস কথাটাতেও তার কানে বাজে। কিন্তু কাকুর সামনে কিছু বলতেও পারে না। আলমারিতে খামটা রেখে এসে চাবিটা ফিরিয়ে দিতেই কাকীমা বলেন , একটা কাজ করতে পারবি মা ?
--- কি কাজ ? 
--- সেবারে রুম্পাদের আর্শিবাদের সময় ধরণী পাহাড়ের শিবমন্দিরে মনোর চাকরির জন্য একটা মানত করেছিলাম। পারবি মা দুজনে গিয়ে পুজোটা দিয়ে আসতে ?
কাকীমায়ের কথা শুনে ছন্দার হৃদয় তন্ত্রীতে যেন বেজে ওঠে সপ্তসুর।

                             ( ক্রমশ )



নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                      ----০---- 


No comments:

Post a Comment