Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৫২




     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











               কালের কারিগর
              

                         অর্ঘ্য ঘোষ

                      (  কিস্তি ---- ৫২ ) 


কাকীমায়ের কথা শুনে ছন্দার হৃদয়তন্ত্রীতে যেন বেজে ওঠে সপ্তসুর। পুজো দিতে গিয়ে মনোদার সঙ্গে একান্তে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারবে ভেবেই মনটা তার আনন্দে ভরে ওঠে। মনোতোষও ছন্দার সান্নিধ্য কামনায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে।মনে মনে ঠিক করে আজ একান্তে কিছুটা সময় কাটাবে তারা। আর টিয়া টিয়া গানটা গেয়ে ছন্দাকে রাগাবে। রেগে যখন ছন্দা নাকের পাটা ফুলিয়ে তাকায় তখন খুব সুন্দর লাগে তাকে। সেটা দেখার জন্যই বার বার রাগাতে ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু সে তো আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে পারে না।তাই ছন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।কিন্তু ছন্দা তাকে আমলটুকু পর্যন্ত দেয় না। বরং মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে , পারব না কেন কাকিমা , নিশ্চয় পারব। 
---- তাহলে স্নানটা সেরে নিয়ে পুজোর যোগাড়টা করে ফেল মা। মনো তুই ও স্নান টান করে রেডি হয়ে নে।
সেই মতো দুজনেই স্নান টান করে রেড়ি হয়ে নেয়। ছন্দা আজ মায়ের লাল পাড় গরদের শাড়িটা পড়েছে। ভেজা চুল পিঠময় রয়েছে।চুলে আবার একটা ফাঁস দিয়েছে।ছোটবেলায় স্নানের পর খোলাচুলে মাকেও ওই রকম ফাঁস দিতে দেখেছে  মনোতোষ। মায়েরও ওই রকম কোমর ছোঁয়া চুল ছিল। অতটা না হলেও এখনও মায়ের খোলা চুলে পিঠ ভর্তি হয়ে  যায়। মা এখন আর চুলে ফাঁস দেন না।ছোটবেলায় একদিন মাকে ওই ভাবে চুলে ফাঁস দিতে দেখে কৌতুহল বশত কারণ জানতে চেয়েছিল সে। সে দিনই মায়ের কাছে জানতে পারে মেয়েরা অন্যের নজর লাগা এড়াতে চুলে ওই রকম ফাঁস আটকে দেয়।এক লহমায় ছন্দা যেন তার সেই ছেলেবেলাটা  ফিরিয়ে দেয়। তা নজর লাগার মতোই চুল বটে ছন্দার। কোমর ছাড়িয়ে নিচের দিকে নেমেই চলেছে। সারা শরীর থেকে বেরোচ্ছে মিষ্টি একটা সুবাস। ছন্দাকে আজ দেখতে পুরোপুরি অন্যরকম লাগছে। কেমন যেন দেবী প্রতিমার মতো দেখাচ্ছে।এই রূপে আগে তো দেখেনি ছন্দাকে। ভবিষ্যতে  ঠিক এই রূপটিই আর  দেখেতে পাবে কি না কে জানে। তাই এই মুহুর্তে ওই চুলে নাক ডুবিয়ে দীর্ঘক্ষণ শ্বাস নিতে খুব ইচ্ছে করে মনোতোষের। কিন্তু সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাবা-মা। তাই মনের ইচ্ছেটা মনে রেখেই ছন্দাকে সাইকেলের সামনে চাপিয়ে ধরণী পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে। 



                      গ্রাম পার হয়ে গিয়ে নির্জন পথে পড়তেই সে নাক ডুবিয়ে দেয় ছন্দার চুলে।আচমকা এ হেন আচরণে বিস্মিত হয়ে মনোদার মুখের দিকে ঘুরে তাকায় ছন্দা, সেই সুযোগে মনোতোষ ছন্দার ঠোঁটের কাছে নামিয়ে আনে তার ঠোঁট। মনোদার অভিপ্রায়টা বুঝতে অসুবিধা হয় না ছন্দার। তাই সে দ্রুত তার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে , করো কি ?  উপোষ করে পুজো দিতে যাচ্ছি , আর যত সব দুষ্টু বুদ্ধি ? তুমি দিন কে দিন খুব দুষ্টু হয়ে যাচ্ছ কিন্তু মনোদা। আগে তো এমন ছিলে না !
--- দুষ্টু হচ্ছি কি আর সাধে ?
--- কেন গো ? 
--- তুই  দিন কে দিন সুন্দরী হয়ে উঠছিস সেইজন্য।
--- ধ্যাত । 
রূপের প্রশস্তি শুনে সেই প্রথমবার ধরণী পাহাড়ে পিকনিকে আসার কথা মনে পড়ে ছন্দার। সেদিনই প্রথম মনোদা তার রূপের সুখ্যাতি করেছিল। সেদিনই থেকেই মনোদার প্রতি তার মনে অনুরাগের জন্ম হয়। তারপর যত দিন গিয়েছে ততই অনুরাগ প্রগাঢ় হয়েছে। মনে পড়ে সেদিনই মন্দিরের পুরোহিতদাদু তাদের দেখে সাক্ষাৎ হরপার্বতী বলেছিলেন। তারপর তো রুম্পাদি আর প্রভাতদার আর্শিবাদের দিনে তাদের আর্শিবাদের কথা বলে সবার সামনে রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিলেন। আজ আবার তার সঙ্গে দেখা হবে।নিশ্চয় তাদের নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেন।আজ আর অবশ্য কোন অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে না তাদের। আজ তো তাদের সংগে অন্য কেউ নেই। তাছাড়া শীঘ্রই তাদের বিয়ে হবে। বিয়ের কথা মনে আসতেই রোমাঞ্চ অনুভব করে। তার চোখে মুখেও সেই অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। সেটা চাপা দিতেই ' ধ্যাত ' বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। মুখে ধ্যাত বললেও মনোদার মুখে রূপের সুখ্যাতি শুনতে ভালোই লাগে ছন্দার। কারই বা লাগে না !  প্রিয়জনের মুখে রূপের প্রশস্তি শুনতে সব মেয়েরই ভালো লাগে। সেই সময় সাইকেলটা গিয়ে থামে মন্দিরের সামনে।সাইকেল থেকে নামতেই ভ্রু কুঁচকে যায় তাদের।দূর থেকেই তারা দেখতে পায়  পুরোহিতদাদুর সঙ্গে কথা বলছে সৌমেন আর রীণা। তারাও বোধহয় পুজো দেওয়ার জন্যই এসেছে। কিন্তু পুরোহিত দাদু তাদের দেখতে পেয়েই ওদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে তাদের দিকে এগিয়ে আসেন। তাতেই যেন আক্রোশ ফুটে ওঠে ওদের চোখে মুখে। ছন্দারা অবশ্য তাতে আমল দেয় না। তারাও পুরোহিতদাদুর কাছে এগিয়ে  যেতেই সবার খবর নেন তিনি। ছন্দা তাকে পুজো দিতে আসার উপলক্ষ্যটা খুলে বলে। শুনেই উচ্ছস্বিত হয়ে পড়েন  পুরোহিতদাদু। কপালে হাত ঠেকিয়ে আবেগ মেশানো গলায় বলে ওঠেন , সবই তার ইচ্ছা। তার ইচ্ছাতেই জগত চলছে।তার ইচ্ছাতেই তো তোমাদের দুটি এক  সূত্রে বেঁধে দেওয়ার জন্য এতো আয়োজন। 



               পুরোহিতদাদুর কথা শুনে তারা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। মনে পড়ে যায় প্রথম যেবার তারা এখানে এসেছিল সেবারও এই ধরণের কথাই বলেছিলেন পুরোহিতদাদু। সেবারও তারা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিয়ে ছিল। এবারও তার অন্যথা হয় না।  সেটা লক্ষ্য করেই বোধহয় পুরোহিতদাদু পুজোর দিতে মন্দিরের ভিতরে চলে যান।কিছুক্ষণের মধ্যেই পুজোর ডালিটা ছন্দার হাতে তুলে দেন তিনি। তারপর দুজনের কপালে সিঁদুরের টিপ পড়িয়ে দেন। কপালে সিঁদুরের ছোঁয়াই  ছন্দা দেখতে একদম অন্য রকম হয়ে যায়। তার দিকে চেয়ে পুরোহিতদাদু বলেন , এবারে দিদিভাইকে স্বাক্ষাৎ মা ভগবতীর মতো দেখাচ্ছে। মনোতোষও তাই মনে হয়। ফেরার আগে পুরোহিতদাদু বলেন , ভাই তোমাদের মিলনের দিন মন্দির ছেড়ে যাওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু জোড়ে যেন একবার আসিস ভাই। তারা পুরোহিত দাদুর কাছে আর্শিবাদ নিতে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মন্দির ছেড়ে বেড়িয়ে আসে। দূরে দাঁড়িয়ে সবই লক্ষ্য করে সৌমেনরা। তারপর তারা রওনা দিতেই ওরাও পুজো দিয়ে অসভ্যের মতো একবারে তাদের পাশ দিয়ে মোটর বাইকের ধুলো উড়িয়ে চলে যায়।ওই অসভ্যতায় প্রচন্ড রেগে ওঠে মনোতোষ। কিছু একটা বলার জন্য সাইকেলের গতি বাড়ায়। আর তার মধ্যেই মোটর বাইকটা অনেকখানি দূরে চলে যায়। তাই অস্ফুটে বলে , বিয়ের পরেও স্বভাব বদলায় নি। 
ছন্দারও তাই মনে হয়। মোটর বাইকটা পেরিয়ে যাওয়ার সময় সৌমেনের মুখের দিকে এক পলক নজর পড়তেই তার চোখের নীচে মনোদার ঘুসির দাগের সেই চিহ্নটা দেখতে পায় সে। তার মনে প্রশ্ন জাগে , দাগটা দেখে কি রীণা কিছু জিজ্ঞেস করে না ? উত্তরে শয়তানটাই বা কি বলে ? মনোদা অবশ্য ওদের আচরণ নিয়ে আর কোন কথা বলে না।ফেরার পথে সুরমতী নদীর পাড়ে নির্জন বটগাছটার নীচে সাইকেল দাঁড় করায় মনোতোষ। ছন্দার বুঝতে অসুবিধা হয় না মনোদা তার সঙ্গে নিভৃতে কিছুটা সময় কাটাতে চায়। তার মনও তাই চায়। তখন ভন্নি দুপুর বেলা। চাষের কাজ সেরে দুপুরে খেতে বাড়ি গিয়েছে চাষির দল। মাঠ থেকে রাখালরাও গরুর পাল নিয়ে ফিরে যাচ্ছে গ্রামে। চারদিকে একটা নির্জনতার ছায়া।শুধু বাঁধানো বটগাছটার অদুরে কুল কুল ছন্দে বয়ে যাচ্ছে ক্ষীনকায়া সুরমতী। আর বয়ে যাছে অহেতুক মন কেমন করা উদাস বসন্ত বাতাস। এ সময় এমনই হয় , বিনা কারণেই মন কেমন করে। মনোতোষ - ছন্দার মনেও সেই   প্রভাব পড়ে। এ সময় মন সঙ্গী খোঁজে। একে অন্যকে কাছে পেয়ে এক অনাস্বাদিত ভালো লাগায় ভরে ওঠে তাদের মন। সাইকেল থেকে নেমে ছন্দাকে হাত ধরে নামায় মনোতোষ। তারপর হাত ধরাধরি করে বাঁধানো বটগাছটার নিচে গিয়ে বসে তারা।ছন্দার মুখটা দু হাতের তালুতে তুলে ধরে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে, সত্যি রে সিঁদুরের টিপটা পড়ে তোকে আজকে অন্যরকম লাগছে।
---- কি রকম লাগছে ? 
---- একে বারে নতুন বৌয়ের মতো।



                   বলেই আচমকা ছন্দার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে দেয় মনোতোষ। এবারে আর আপত্তি করে না ছন্দা।  আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার। পরক্ষণেই অবশ্য  কপট রাগ দেখিয়ে বলে , ইঃ মা কি লজ্জা - কি লজ্জা!  খোলা মাঠে কেউ এসব করে ? তুমি না মাস্টার !  ছাত্রছাত্রীরা কেউ দেখে ফেললে কি হবে ?
--- কি আর হবে ? আমি তো এখনও মাস্টার হই নি। তাছাড়া আমি আমার বৌকে ওটুকু করতেই পারি। 
---- আমি যে এখনও তোমার বউ হই নি মশাই।
বলেই মনোতোষের নাকটা মুলে দিয়ে হাসতে থাকে ছন্দা। ততক্ষণে তার নাকের পাটায় মুক্তোদানার মতো জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সেই স্বেদবিন্দু আর নাকছাবিতে বটপাতার ফাঁক দিয়ে গলে আসা সুর্যালোক প্রতিফলিত হয়ে  মনোতোষের চোখে যেন একে দেয় প্রেঁমের রমধনু।ভাবী বধুর রূপ মাধুরী মোহিত করে তোলে তার মন।মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে চেয়ে থাকে ছন্দার মুখের দিকে। কোন কথা বলতে পারে না। তার মুগ্ধতা গানের সুরে প্রকাশ পায়। ছন্দার মুখের দিকে চেয়ে মনোতোষ গেয়ে ওঠে --
" ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো তোমার
চরণ মঞ্জিরে।
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি তোমার প্রসাদ প্রাঙ্গণে।
মনে করে সখী, বাঁধিয়া রাখিও
আমার হাতের রাখি তোমার
কনককঙ্কণে। "
মনোদার গলায় অপূর্ব সুর মাধুরী আবেশ বিহ্বল করে তোলে ছন্দাকে। সে'ও মনোদার হাত দুটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে --
" তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।।
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো ,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা।।
তব মুখ সাদামনে জাগিতেছে সংগোপনে,
তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল- কিনারা।।
কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।।"
গান শেষ হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ তার অনুরণন খেলে যায় নির্জন নদীতটে। ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাড়ির পথ ধরে ওরা দু'জন।

                        ( ক্রমশ )



নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                                    ----০---- 





No comments:

Post a Comment