Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৫৩




     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











               কালের কারিগর
              

                         অর্ঘ্য ঘোষ

                      (  কিস্তি -- ৫৩ )



ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাড়ির পথ ধরে ওরা দু'জনে। বাড়িতে পা রাখতেই এগিয়ে গিয়েছন্দার হাত থেকে পুজোর ডালিটি নিয়ে সাধনা বলেন , আয় আয় ভিতরে আয়। ঘেমে নেয়েএকসা হয়ে উঠেছিস।
সাইকেল থেকে নেমে দ্রুত হাত পা ধুয়ে ছন্দা  আঁচলে বাঁধা প্রসাদী ফুল সবারমাথায় ছুঁইয়ে দেয়। পুজোর পর মনোতোষের মাথায় একবার প্রসাদী ফুল ছুঁইয়ে দিলেওফের আবার একবার দেয়। তারপর সবাইকে প্রসাদ দেয় সে। সেই সময় সাধনা নিজের  আঁচলেকরে ছন্দার মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলেন , রোদে পুড়ে মুখখানা কেমন লাল হয়ে উঠেছে দেখ দেখি।
মনোতোষ তাকিয়ে দেখে ঘামে লেপ্টে গিয়েছে ছন্দার কপালের সিঁদুরের টিপ। মেয়েদের গরদের শাড়ি আর সিঁদুরের টিপে দেবী দেবী লাগে মনোতোষের। ঘামের সঙ্গে সিঁদুরের টিপের একটা ফোঁটা চোখে গড়িয়ে পড়তেই চোখটা অর্ধেক বন্ধ করে ট্যারার মতো তাকায় ছন্দা। আর কাছে পিঠে বাবা নেই দেখে মনোতোষ একটা চোখ ট্যারাকরে নীচু সুরে গেয়ে ওঠে " ট্যারা চোখে তাকায় টিয়া, নোলক পড়া নাকে।"
আর যাই কোথায় ? যথারীতি রাগে নাকের পাটা ফুলিয়ে ছন্দা বলে, দেখছো কাকীমাদেখছো, কেমন আমাকে রাগাচ্ছে ?
ছন্দা যত রাগে , মনোতোষও তত তার পিছনে লাগে। এক সময় খাপ্পা হয়ে ছন্দা বলে ,কাকীমা তোমার ছেলেকে সামলাও বলে দিচ্ছি। না হলে ভালো হবে না কিন্তু।
ছন্দার বলার ধরন দেখে হেসে ফেলেন সাধনা। তাকে হাসতে দেখে ছন্দা বলে --- তুমি হাসছ ?
--- হাসা ছাড়া কি করি বল ? ও আমার ছেলে , আর তোর বুঝি কেউ নয় ?
সাধনার কথায় ছন্দা মনোতোষ দু'জনেই লজ্জা পেয়ে যায়। লজ্জা ঢাকতে মনোতোষ চুপ করে যায়। আর ছন্দা রাগ দেখিয়ে বলে , জানি না যাও। তুমি যদি কিছু বিচার না'ই করতে পারো তাহলে এই আমি চললাম  বাড়ি।
তারপরই ছন্দাকে  কাছে টেনে নিয়ে সাধনা বলেন , ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে আর পারি না বাপু। এটার দেখছি মাথাটা একটু বেশিই গরম।কই আয় দেখি হাত বুলিয়ে দিই। তারপর হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য চুলে হাত ছুঁইয়েই বলেন , কি ব্যাপার রে ? এইমাত্র স্নান করে গেলি। তাও তোর চুলে এত ধুলো কেন ?
চকিতেই মনে পড়ে যায় সৌমেনের বাইকের ধুলো উড়িয়ে দিয়ে যাওয়ার কথা। কাকীমাকে কথাটা বলবে কিনা ভেবে উঠতে পারে না। তাই মনোদার মুখের দিকে চায় ছন্দা। তাকে কিছু বলতে হয় না। মনোদাই ঘটনাটার কথা কাকীমাকে বলে। শুনেই কাকীমা রাগে খাপ্পা হয়ে বলেন, মহা মুশকিল হল তো। আমরা ওদের কোন সংশ্রবে থাকি না। কিন্তু সেই
পিকনিক থেকে দেখছি ওরা আমাদের পিছনে লেগে রয়েছে। তোদের মোটর বাইক আছে , নিজেরা হাওয়া খাবি ভালো কথা। কিন্তু অন্যকে কেন ধুলো খাওয়াবি রে বাবা ? দিলি না কেন ভালো করে দু'কথা শুনিয়ে।
--- দু 'কথা শুনিয়ে দিয়ে লাভ নেই। কুকুরে কামড়ালে কুকুরকে কামড়ানোর পরিবর্তে প্রতিষেধক নেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া কাল থেকে ও শিক্ষকতার কাজে যোগ দিচ্ছে। আর কোনরকম ঝামেলার মধ্যে ওর না জড়ানোই ভালো। ছাত্রছাত্রীদের চোখে পড়লে তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। শিক্ষকেরও মর্যাদা হানি হবে।
তারপরই ছেলেকে নিয়ে পড়েন ভুবনবাবু। আর্দশ শিক্ষকের পালনীয় বিষয় গুলি একে একে তুলে ধরেন তিনি।




                                                          ইতিমধ্যেই বাবাকে দেখে ওইসব পালনীয় বিষয়গুলি মনোতোষের জানা হয়ে গিয়েছে।বাবার মুখে কথাগুলি শুনতে শুনতে যেন তার মনে গেঁথে যায়। বাবা অনুচ্চ স্বরে বলে চলেন , একজন প্রকৃত শিক্ষকের বড়ো গুণ হলো ছাত্রছাত্রীদের পাঠদানের আগে নিজের পাঠাভ্যাস তৈরি করা। শুধু নিদিষ্ট বিষয়েরই নয়, একজন শিক্ষককে অন্যান্য বিষয়েও সমান তালে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। তবেই সেই শিক্ষক পাঠ্যক্রমের খটমটো বিষয়কেও পড়ুয়াদের মনে গেঁথে দিতে পারবেন।
বাবার কথা শুনতে শুনতেই স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে যায় মনোতোষের। তাদের ইতিহাস পড়াতেন কার্তিকবাবু। সেদিন ছিল মোগল  সম্রাট শাহজাহানের অধ্যায়। কার্তিকবাবু বারন্দা থেকেই উদাত্ত গলায় -- " কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ  তাজমহল " কবিতাটি আবৃত্তি করতে করতে ক্লাসে ঢুকেই প্রশ্ন করেন -- বলো তো তাজমহল কে তৈরি করিয়েছিলেন ?  সেদিন তারা অনেকেই বলতে পারে নি ঠিকই। কিন্তু পুরো কবিতাটা শোনার পর রবীন্দ্রনাথ আর শাহজাহান মনে গেঁথে গিয়েছিল। কার্তিকবাবুই শিখিয়েছিলেন  '  বাবার হলো আবার জ্বর সারিল ঔষধে " শব্দবন্ধের সাহায্যে মোগল সম্রাটদের বংশক্রম মনে রাখার নিয়ম। শুধু কি কার্তিকবাবু ? কাকে ছেড়ে কার কথা ভাববে মনোতোষ। তখন সিক্স কি সেভেনে পড়ে তারা। পরিমাপের একক কিছুতেই মনে রাখতে পারছিল না। তপনবাবুই তাদের শিখিয়ে দিলেন "ডেকে হেকে কিলিয়ে মারো " শব্দবন্ধের মাধ্যমে মনে রাখার কৌশল। দিলীপবাবু শিখিয়েছিলেন কি করে " বেনিআসহকলা " শব্দবন্ধের মধ্যমে রামধনুর সাতটি রঙ মনে রাখতে হয়। আজও মনে গেঁথে আছে তারাপ্রসন্নবাবুর সেই "উই আর সেভেন , নবকিশোরবাবুর "আংকেল পোজার " কিম্বা জগদীশবাবুর " বিদ্যাপতির বিলাপ।" পড়াশোনা না থাকলে ওইসব শিক্ষকেরা কি এভাবে পড়ুয়াদের মনে গেঁথে দিতে পারতেন ? শুধু কি পড়াশোনা নৈকট্যও কি কম ছিল ? স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে একবার নাটক হয়েছিল ' দায়ী কে ? ' পরিচালনায় ছিলেন অরুণবাবু। তার ছিল নায়কের রোল। নাটকে নায়কের সিগারেট খাওয়ার একটা দৃশ্য ছিল। সে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিল না। অরুণবাবু হঠাৎ করে প্যাকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়ে একটা নিজে নিয়ে অন্যটা গুঁজে দিয়েছিলেন তার মুখে। তারপর নিজে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিল , লজ্জা কি ? এটা অভিনয়।নে আমার মতো করে টান দেখি।
বলাবাহুল্য তারপরই তার অস্বস্তি কেটে গিয়েছিল। নৈকট্য না থাকলে এমনটা সম্ভব ? ভুবনবাবু তখনও বলে চলেছেন , শিক্ষা বিক্রির সামগ্রীর নয় , শিক্ষা দানের বিষয়।আর একজন প্রকৃত শিক্ষকের সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনসংযোগ। তবেই শিক্ষার্থী এবংশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃত উন্নতি সাধন করতে পারবেন শিক্ষকেরা।
ফের স্কুলের শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে যায় মনোতোষের। কি সময়ানুবর্তিতা ছিল কামাক্ষ্যাবাবু - বীনাকরবাবুদের। পাশের গ্রাম থেকে সাধারণত হেঁটেই স্কুলে আসতেন তাঁরা।প্রতিদিন সমান তালে পা ফেলে নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগে স্কুলে পৌঁছোতেন তারা। অধিকাংশই টিউশানির ব্যবসা করতেন না। বরং ফ্রি কোচিং ক্যাম্প চালাতেন। আর কি ছাত্র দরদ ! কোন ছাত্রছাত্রী ২/৩ দিন স্কুলে না এলে বাবাকে তো বটেই , অন্যান্য শিক্ষকদেরও উতলা হয়ে পড়তে দেখেছে মনোতোষ।অসুস্থতার খবর পেলে সদলবলে হাজির হয়েছেন পড়ুয়াদের  বাড়ি। ওষুধ পথ্যের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি পড়ুয়ার জ্বর তপ্ত কপালে বুলিয়ে দিয়েছেন স্নেহের হাত।পরিবারের লোকেদের আশা-ভরসা যুগিয়েছেন। হোস্টেলে থাকতেন সত্যবাবু।তিনি তো ছাত্রছাত্রী এমন কি অভিভাবকদের চিকিৎসার জন্য নিজে হোমিওপ্যাথিক শিখেছিলেন।আর ছিলেন পন্ডিতমশাই  ধীরেণ স্যান্যাল , মোহিত মৌলবী।ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাঁরা যেন এলাকার মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন।লোকেরাও শিক্ষকদের তো বটেই স্কুলকেও বড় আপনার মনে করতেন। স্কুলকে সরকার নামক কোন ব্যক্তি মালিকানার প্রতিষ্ঠান ভাবতেন না তাঁরা।তাই স্কুলবাড়ির দূরবস্থার কথা শুনলেই বাঁশ, খড়, দড়ি যার যা সামর্থ্য নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন স্কুলে। তারপর নিজেরা শ্রম দিয়ে স্কুল বাড়ি মেরামত করে দিয়ে যেতেন। জমিতে লাউ, কুমড়ো আখের গুড় যাই হোক না কেন, মাস্টারদের না দিয়ে খেতেন না কেউ। নিবিড় জন সংযোগ না থাকলে এমনটা সম্ভব হত না। 



                                 কালে কালে মানুষ গড়ার কারিগরদের চরিত্র খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে।কিন্তু মনোতোষ কোন দিন সেই স্রোতে গা ভাসাবে না বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। সে বাবার প্রদর্শিত পথে মানুষ গড়ার প্রকৃত  কারিগর হওয়ার চেষ্টা করবে।  সেদিন রাতটা তার সেইসব চিন্তার মধ্যেই কেটে যায়। পরদিন সাজো সাজো রব পড়ে যায় বাড়িতে। সকাল থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় সাধনার। এতদিন একজনের স্কুলের ভাত দিত হত তাকে।আজ থেকে তার বাড়িতে দুজন শিক্ষক , তাই দুজনের ভাত দিতে হবে। ছন্দাও তাকে হাতে হাতে সব এগিয়ে দেয়।নির্ধারিত সময়ে বাপ- ছেলেকে পাশাপাশি খেতে দেয় সাধনা। ছন্দা দুজনকেই পাখার বাতাস করে দেয়। অন্যান্য দিন খাওয়ার পর কাকীমা কাকুকে সব কিছু গুছিয়ে দেওয়ার জন্য ঘরে যান। আজ যাওয়ার আগে তাকে বলেন , যা দেখি মনোর কি লাগবে না লাগবে গিয়ে একবার দেখ।
মনে মনে ছন্দাও এটাই চাইছিল। যেন বলার অপেক্ষাতেই ছিল। তাই কাকীমা তাদের ঘরে যেতেই সে'ও মনোদার ঘরে যায়। তারই মধ্যে মনোদা প্যাণ্ট - সার্ট পড়ে একেবারে ফিটফাট। চোখ ফেরাতেই পারে না ছন্দা। সে একে একে এগিয়ে দেয় পেন , রুমাল, ঘড়ি। জামাতে ছড়িয়ে দেয় একটু সুগন্ধি। তারপর হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে এসে বলে , ডান হাতের কড়ি আঙুলটা দাও তো দেখি।
---- কেন আঙুল দেখে কি হবে ?
--- আহা দাওই না। বলে মনোতোষের ডান হাতের কড়ি আঙুলটা টেনে নিয়ে আলতো করে কামড়ে দেয় ছন্দা।
আর বিস্মিত হয়ে মনোতোষ জিজ্ঞেস করে -- এটা কি হল ?
---- উচ্চ মাধ্যমিক হওয়ার পর থেকে স্কুলে তো এখন সব বড়ো বড়ো মেয়েরা পড়ে।তোমাকে দেখে তো আজ চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। তাই যাতে কারও নজর লেগে না যায় তার জন্য বাঁধ দিয়ে দিলাম।
---- তবে রে --- বলেই ছন্দার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ঠোঁটটা এগিয়ে দেয় মনোতোষ। ছন্দা শুনেছে কাজে বেরনোর আগে স্ত্রীদের নাকি স্বামীকে চুমু দিতে হয়।কে জানে কাকীমা তা দেওয়ার জন্যই  কাকুর স্কুলে বেরনোর আগে ঘরে যান কিনা।ততক্ষণে তার ঠোঁটের একেবারে কাছে চলে আসে মনোদার ঠোঁট। সেই ঠোঁটে চুম্বন একে দেয় ছন্দা। মনোতোষও ছন্দার কপাল , চোখের পাতায় ঠোঁট ছোঁওয়ায়। সেই সময় সাধনার গলা শোনা যায় -- কই রে তোদের হলো ?
দ্রুত মুখ মুছতে মুছতে বাইরে আসে তারা।মনোদা বাবা মায়ের পর হরিমন্দিরে প্রনাম করে আসে।তারপর সাইকেলের সামনে বাবাকে চাপিয়ে স্কুল অভিমুখে রওনা দেয়। বাবা ছেলের মাথার উপর মেলে ধরেন ছাতা। সাধনা আর ছন্দা দুই হাত জোর করে কপালে ঠেকিয়ে বলে --- দুগগা -- দুগগা।।

                                ( ক্রমশ )


নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                      ----০----


No comments:

Post a Comment