Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৫৫


     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











              কালের কারিগর
              

                          অর্ঘ্য ঘোষ
               

                        (  কিস্তি --- ৫৫ )



সেদিন সন্ধ্যায় তাদের বাড়িতে এক আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হয়। ততক্ষণে ভুবনবাবুর সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা একে একে এসে পৌঁছেছেন। সাধনা তাদের চায়ের যোগাড়ে ব্যস্ত। মনোতোষ একাকী ঘরে পরের দিন স্কুলের রুটিন অনুযায়ী বইগুলিতে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।  কিন্তু কিছুতেই বইয়ে মন বসাতে পারছে না। কেবলই ছন্দার কথা মনে পড়ছে তার। অন্যদিন এই সময় ছন্দা তার সঙ্গে খুনসুটি করতে আসত।সাধনাও খুব অভাব বোধ করে ছন্দার। মেয়েটা নিজের পেটের মেয়ের মতোই হয়ে উঠেছে। হাতে হাতে সব কাজে সাহায্য তো করেই , তাদের কারও জ্বরজ্বালা হলেও সেবায় তার জুড়ি মেলা ভার। ছন্দারও নিশ্চয় তাদের জন্য মন কেমন করছে। কি করছে মেয়েটা কে জানে ? জানার উপায়ও নেই। ওর বাবা আবার আজ সান্ধ্য আসরে আসে নি। অনেকদিন পর মেয়ে বাড়ি ফিরেছে বলেই হয়তো আসতে পারে নি।কিন্তু তার ধারণাকে মিথ্যা করে দিয়ে ঠিক সেইসময়ই খুঁকীর বাবাকে নিয়ে ঢোকে মলয়।চা নিয়ে সে সময় বৈঠকখানা ঘরে ঢোকেন সাধনাও। সবাইকে একে একে চায়ের কাপ এগিয়ে দেন তিনি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই ভুবনবাবুকে উদ্দেশ্য করে নির্মল বলে - মাস্টারমশাই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ?
---- আমি নয় ,  তোমাকে উনি ডেকে পাঠিয়েছেন। বলে আঙুল উঁচিয়ে স্ত্রীকে দেখান ভুবনবাবু।
---- বৌদি ? বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সাধনার দিকে চেয়ে থাকে নির্মল।
সাধনা বলেন , একটা কথা জানার জন্য তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি ঠাকুরপো।
---- কি কথা বৌদি ?
---- সেদিন নিমন্ত্রণ করতে এসে তুমি বলছিলে না পাঁচ হাজার টাকার জন্য ছেলের  ঘর খরচের টাকা দিতে পারছ না। সেই টাকাটা কি যোগাড় হয়ে গিয়েছে ?
---- কই আর হোল বৌদি ? গ্রামে হেন জন নেই যার কাছে ধারের জন্য হাত পাতি নি।কিন্তু কেউই হাত উপুড় করে নি।
---- সে কি ?  পরশুই তো বিয়ে।
---- শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা অবশ্য একটা হয়েছে।
---- ব্যবস্থাটা কি শুনতে পারি ?
---- কোথাও কিছু না পেয়ে বাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম কুণালবাবুর কাছে। শুনেছিলাম উনিধারের কারবার করেন। তাই সমস্যার কথা তাকেই খুলে বললাম। সব শুনে টাকা দিতে রাজিহলেন উনি।
--- রাজী হলেন টাকা দিতে !
---- হ্যা তা হলেন। তবে বললেন ধারের কারবার তো খালি হাতে হয় না। বাড়িটা বন্ধকরাখলে শতকরা পাঁচ টাকা হার সুদে টাকাটা দেবেন। তবে এক বছরের মাথায় টাকা শোধ করতেনা পারলে বাড়িটা নিয়ে নেবেন।
---- তা , তুমি কি করবে কিছু ভেবেছ ?
---- ভাবাভাবির কিছু নেই বৌদি। কাল বাদ পরশু মেয়ের বিয়ে। আমার আর অন্য কোনউপায় নেই। কালই বাড়ির দলিলটা বাঁধা রেখে টাকাটা নিয়ে আসব। আগে কন্যাদায় থেকেতো উদ্ধার হই। তারপর বাড়ি ছাড়াতে পারলে ভালো , না হলে গাছতলায় গিয়ে থাকব।
নির্মলের কথা শেষ হতেই সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা বলেন , কিছু করার নেই। ও ব্যাটাপাকে - প্রকারে তোমার বাড়ির দখল নেবেই। ওইভাবে কত আদিবাসীর জমি নামে বেনামেহাতিয়ে নিয়ে পাথর খাদান, ক্যাসার মেসিন করছে। এখন তো আবার বেয়াই দোসর জুটেছে।
---- কিন্তু আমার যে আর কিছু করার নেই। সব জেনেও ওদের গুহাতেই ঢুকতে হবে।



              এবারে মুখ খোলেন সাধনা। নির্মলের দিকে চেয়ে বলেন ,  অন্য কেউ যদি টাকাটা দেয় ?
--- কে দেবে বৌদি ?  আপনারা যে দেবেন সেই সম্ভাবনাও নেই। আপনাদেরই তো ছেলের বিয়ে।
---- ধরো আমরাই যদি টাকাটা দিই ?
---- আপনারা কি করে দেবেন ? কয়েকদিন পর তো  আপনাদেরও ছেলের বিয়ে।একমাত্র ছেলের বিয়েতে আপনাদেরও তো ভালোই খরচখরচা আছে।
---- কিন্তু আমরা ঠিক করেছি মনোর বিয়েতে লাইট, সানাই না করে, সেই টাকাটা তোমায় দেব।
কথাটা শুনে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করেতে পারে না নির্মল।  তার মুখ দিয়ে কথা সরে না। বেশ কিছুক্ষণ পর অত্যন্ত সংকুচিত ভাবে সে বলে , এ কি বলছেন বৌদি ? একমাত্র ছেলের বিয়েতে সানাই -- লাইট না করে আমার মেয়ের বিয়ের কথা ভেবেছেন ?
---- লাইট, সানাই না হলেও আমাদের ছেলের বিয়ে তো আটকাবে না। এটা রাখো। বলে আঁচলের ভিতর থেকে খামে ভরা পাঁচ হাজার টাকা নির্মলের হাতে তুলে দেন সাধনা।
---- আপনাদের এই সহমর্মিতার ঋণ আমি কোনদিনই শোধ করতে পারব না। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টাকাটা শোধ করে দেব।
---- টাকাটাও তোমাকে শোধ করতে হবে না ভাই। ওটা খুঁকীর বিয়েতে আমাদের আর্শিবাদ।ও আমাদের ভাবী পুত্রবধুর গঙ্গাজল , তাই ও আমাদের মেয়েরই মতো।
আর কোন জবাব দিতে পারে না নির্মল। অবিরাম অশ্রু ধারায় উপছে পড়ে তার দারিদ্র্যদীর্ণ কুঁচকে যাওয়া দু'চোখের কোল। কেবল সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা বলেন , তোমাদেরমতো করে সবাই যদি ভাবতে পারত তাহলে পৃথিবীটা আরও সুন্দর হয়ে উঠত। 
সেদিন আর আসরজমে না। সবাই ধন্য ধন্য করতে করতে বাড়ির পথ ধরেন। আর সেদিন রাতে ভুবনবাবু আর সাধনার মধ্যে অনুচ্চ স্বরে তুমুল তর্কাতর্কি হয়। ভুবনবাবু যত বলেন , সত্যিসাধনা তুমি যা করলে তার জন্য আমি গর্বিত।
---- যা বাবা , আমি আবার কি করলাম ? সব কিছু করালে তো তুমি। সেই জন্য বরং স্ত্রী হিসাবে আমি গর্বিত ।
---- না - না , তুমি।
---- না তুমি।
এভাবেই একে অন্যকে মহানুভবতার প্রকৃত হোতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে করতে দু'জনের মধুর উতোরচাপন চলতেই থাকে। কিন্তু কারও মতই প্রতিষ্ঠা পায় না। তবেনিজের সামান্য সুখ - আড়ম্বর তাগ করে অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর মতো আনন্দ যেজগতে আর নেই তা নিয়ে অবশ্য দুজনেই এক মত পোষণ করেন। আর সেই আনন্দের জোয়ারে ভেসে যান তারা। তাই প্রৌঢ়ত্বের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়েও ফের যেন হৃত যৌবনের উষ্ণতায় ভিজে যান দুজনে।




   
                               দেখতে দেখতে এসে পড়ে খুঁকীর বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষ্যে সন্ধ্যাবেলায় ছন্দাদের বাড়ি পৌঁছে যায় মনোতোষ। সেদিন ছন্দার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না সে। লাল বেনারসিশাড়ি আর চুলের খোঁপায় রজনীগন্ধার মালায় ছন্দাকেই সেদিন বিয়ের কনের মতো লাগছিল।বিয়ে বাড়িতে পা রাখতেই খুঁকীর বাবা-মা এগিয়ে এসে তাদের পরম সমাদরে এগিয়ে নিয়ে যান। মনোতোষ লক্ষ্য করে জনে জনে তার বাবা-মায়ের সহযোগিতার কথা বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন খুঁকীর বাবা-মা। সেই শুনে তার আর ছন্দার দিকে অনেকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। কেউ কেউ এসে আলাপও করেন তাদের সঙ্গে। বাবা - মায়ের জন্য খুব গর্ব হয় মনোতোষের। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বাবা-মায়ের মতোই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে।খুঁকীর বিয়ের রেশ কাটতে না  কাটতেই বেজে ওঠে মনোতোষের বিয়ের সানাই। বিয়ের দিন সকালে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দরজার বাইরে পা রাখতেই অবাক হয়ে যান ভুবনবাবু। দ্বারিক বায়েন আর তার দলবলকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সানাই বাজাতে দেখেই ভ্রু কুঁচকে যায় তার। কি ব্যাপার তারা তো সানাই করেন নি ? ততক্ষনে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সাধনাও। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে চান ভুবনবাবু।সাধনার চোখেও বিষ্ময়। সেই সময় তাদের এক রকম ঠেলে সরিয়ে সদলবলে ঢোকে দ্বারিক বায়েন। দ্বারিকরা পুরুষানুক্রমে ঢাক-ঢোল, কাঁসি-বাঁশি সবই বাজায়।ওইভাবে তাদের ঢুকতে দেখেই অবাক চোখে চেয়ে থাকেন ভুবনবাবু।সেটা লক্ষ্য করে দ্বারিক বলে, কই গো মাস্টারমশাই চা-টা কিছু হবে নাকি ? তুমি আমাদের বলতে ভুলে গেলে কি হবে , আমরা তো আর তোমাকে ভুলে যেতে পারব না।দ্বারিকের কথায় খুব বিড়ম্বনায় পড়েন ভুবনবাবু। দ্বারিকদের বাড়িতে তো নিমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছিল , তাহলে কি সেটা পৌঁছোয় নি ? সেটা জানতেই ভুবনবাবু বলেন , হ্যা -- হ্যা এসো চা খাও। আসলে কি জানো , একাই সবদিক দেখতে হচ্ছে তো, তাই সবাইকে বাড়িতে গিয়ে আর বলতে পারি নি। কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি যে পাও নি তা জানতাম না। কিছু যেন মনে করো না ভাই ।যেখানে বাজাতে যাচ্ছ যাও , বৌভাতের দিন কিন্তু আসতেই হবে। 
চায়ের কাপে চুমুকদিতে দিতে দ্বারিক বলে, মাস্টারমশাই তোমার নিমন্ত্রণপত্র যথাসময়ে পেয়েছি। না পেলেও কিছু মনে করতাম না। কিন্তু ছেলের বিয়েতে আমাদের বাজাতে না ডাকার ব্যাথাটা বুকে খুব বেজেছে। তাই তো নিজেরাই বাজাতে চলে এলাম।
--- কিন্তু ভাই আমারা সানাই করব না বলেই ঠিক করেছি।
----- মাস্টারমশাই কেন তুমি একমাত্র ছেলের বিয়েতে সানাই করছো না তা আর জানাতে বাকি নেই আমার। তুমি ভাবলে কি করে আমরা থাকতে তোমার ছেলের বিয়েতে সানাই বাজবে না ?  তুমি আমাদের জন্য এত কর, আর আমরা এটুকু করতে পারব না ? তোমাকে একটি পয়সাও দিতে হবে না আমাদের। চাট্টি খেতে দিও তাহলেই হবে।
তারপরই বাঁশিতে সুর তোলে দ্বারিক। সাত সকালে সানাইয়ের সুরে বিভোর হয়ে ওঠে মাধুনিয়া গ্রামের বাতাস। ভুবনবাবুর মুখ দিয়ে কথা সরে না। আনন্দাশ্রুতে ভরে যায় সাধনার চোখ।

                               ( ক্রমশ )


নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                      ----০----

No comments:

Post a Comment