( কিস্তি ---- ৫৬ )
আনন্দাশ্রুতে ভরে যায় সাধনার চোখ। গ্রামের মানুষ তাদের এত ভালোবাসে জেনে বিস্মিত হন তিনি। কিন্তু বিষ্ময়ের তার আরও কিছুটা বাকি ছিল। ততক্ষণে আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে একে একে তাদের বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছোতে শুরু করেছে রিক্সা আর ঘোড়ার গাড়ি। ইতিমধ্যেই এসে পৌঁছে গিয়েছেন সুধাদি, অম্লানবাবু, জয়ন্তবাবু, ভোম্বলবাবুরা। এসেছেন রুম্পার বাবা-মা, খুকীর বাবা-মা এমনকি ডাক্তার কাকাও। মনোর স্কুলএবং কলেজ জীবনের কিছু বন্ধুও এসেছে। ভুবনবাবুর সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের হাকডাকে সরগরম হয়ে উঠেছে বিয়েবাড়ি। সেই সময় একটা ভ্যান এসে থামে ভুবনবাবুর বাড়ির সামনে। আত্মীয় স্বজনরা কেউ এসেছেন ভেবে তাদের এগিয়ে আনতে বাইরে যান সাধনা।বাইরে গিয়ে অবাক হয়ে যান তিনি। ভ্যানে মানুষ কোথাই ? মাইক, জেনারেটর আর লাইটের সরঞ্জাম নামাচ্ছে দু'জন যুবক।কি যে হচ্ছে আজ সকাল থেকে ?
তারা সানাই করেন নি , তবু দলবল নিয়ে হাজির হয়েছে দ্বারিক বায়েন।তারপর আবার এই ছেলে দুটো লাইট-মাইক নিয়ে হাজির হয়েছে। তারা তো মাইক - লাইটও করেন নি , তাহলে তাদের বাড়ির সামনেই ওরা ওই সব নামাচ্ছে কেন ? এ গ্রামে তো কারও লাইট-মাইকের ব্যবসা আছে বলে তার জানা নেই। ছেলে দুটোকেও চেনেন না সাধনা। তাই তিনি অবাক হয়ে তাদের দিকে চেয়ে থাকেন। কিন্তু ছেলে দুটোর কোনদিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই। একের পর এক মালপত্র নামিয়েই চলেছে তারা। অগত্যা সাধনাই তাদের জিজ্ঞেস করেন -- কি ব্যাপার , কে বাবা তোমরা ?ছেলে দুটোর মধ্যে একজন বলে ---- আপনি নিশ্চয়ই কাকিমা ? আপনি আমাদের চিনবেন না। পাশের গ্রামেই আমাদের বাড়ি। আমরা স্যারের প্রাক্তন ছাত্র।
--- কিন্তু এসব লাইট -- মাইক ?
---- এসব লাইট - মাইক আমাদেরই। স্যারের একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। আর আমরা থাকতে সেই বিয়েতে লাইট - মাইক হবে না, তাই কখনও হয় ?
---- কিন্তু বাবা আমরা তো লাইট মাইকের জন্য কাউকে কিছু বলি নি।
---- এতে আর বলাবলির কি আছে কাকিমা ? স্যারের ছেলের বিয়ে মানে তো আমাদের বাড়িরই বিয়ে। আপনি বরং একবার স্যারকে ডেকে দিন। কোথাই কি লাইট লাগাব একটু জেনে নিই।আমরা ততক্ষণে মাইকটা চালু করার ব্যবস্থা করি।তারপরই সে হাক পাড়ে , কই রে পরেশ হলো তোর ? এখনও মাইকটাই বাঁধতে পারলি না ?
---- এই তো দাদা। বলে বাড়ির সামনের আমগাছে দুই দিকে দুটো মাইক বেঁধে ঝাঁপিয়ে নেমে আসে পরেশ নামের ছেলেটি।তারপর বারচালায় মাইক চালু করার তোড়জোড় শুরু করে দেয় তাদের কথাবার্তা শুনে বাইরে বেরিয়ে আসেন ভুবনবাবু। তারপর ছেলে দুটিকে দেখে বলেন , আরে তোরা ? কেমন আছিস সব ? কতদিন পরে দেখছি তোদের।
ছেলে দুটি এগিয়ে এসে প্রণাম করে ভুবনবাবুকে। ভুবনবাবু তাদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর মাথায় হাত রেখে আর্শিবাদ করেন।
ছেলে দুটি বলে , ভালো আছি। চিনতে পেরেছেন স্যার আমাদের ?
---- চিনতে পারব না কি রে ? দুটোকে খুঁজতে কম দিন তোদের গ্রামে যেতে হয়েছে আমাকে ? স্কুলে আসার পথে তোরা তো আখের জমিতে ঢুকে থাকতিস। খুঁজে খুঁজে কতদিন ধরে এনেছি। সেই তোদের মনে থাকবে না ?
বাস্তবিকই ভুবনবাবু দেখেছেন স্কুলের দুষ্টু ছেলেগুলোই মনের মনিকোঠায় একটা বড়ো জায়গা দখল করে থাকে। তাদের বিচিত্র বিচিত্র দুষ্টুমির কথাগুলো বড়ো বেশি করে মনে পড়ে। ভুবনবাবুকে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে দেখে পরেশ বলে --- সব মনে আছে স্যার। সেদিন ওইভাবে ধরে ধরে স্কুলে এনেছিলেন বলেই আজ আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।
----- তা বেশ বেশ , খুব ভালো দিনেই এসেছিস।আজ আমার ছেলের বিয়ে। আয় , ভিতরে আয়। কিন্তু এইসব লাইট মাইক কাদের ? এখানেই বা কেন ?
---- আমাদেরই স্যার। আপনার ছেলের বিয়েতে লাগব বলে এনেছি।
----- কিন্তু আমরা যে লাইট- মাইক লাগব না বলে ঠিক করেছি রে।
---- তা আমরা জানি স্যার। আর কেন লাগাবেন না তাও আমাদের অজানা নয়। আমরা তো রাজীবের বিয়েতে লাইট - মাইক নিয়ে এসেছিলাম। সেখানেই সব শুনেছি। সেদিনই ঠিক করেছিলাম আপনার ছেলের বিয়েতে আমরাই লাইট মাইক দেব।তাই সেদিন থেকে লাইট-মাইক রাজীবদের বাড়িতেই রেখে দিয়ে গিয়েছিলাম।
---- কিন্তু ---!
---- কোন কিন্তু নয় স্যার। আপনার কাছ থেকে আমরা একটা পয়সাও নিতে পারব না।আপনার জন্যই আমাদের এসব হয়েছে। আপনিই সে দিন ধরে ধরে স্কুলে এনেছিলেন বলেই না আমরা মাধ্যমিক পাশটা করেতে পেরেছিলাম। আর সেই জন্যই তো এই ব্যবসা করার জন্য ঋণ পেয়েছি। তাই স্যার ধরুন এ আমাদের গুরুদক্ষিণা।
সেই সময় মাইক বেজে ওঠে।ফের অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে সাধনার চোখ।ভুবনবাবুও কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। মনে মনে ভাবেন , মানুষের জন্য তো তিনি খুব সামান্যই করতে পারেন। তার জন্য মানুষ তাকে এত শ্রদ্ধা-ভক্তি করে ? এত ভালোবাসে ? মানুষের এত শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা তিনি রাখবেন কোথায় ? ওইসব অমূল্য সম্পদে তার হৃদয় যে কানায় কানায় ভর্তি হতে চলেছে।
সাধনাকে অবশ্য বেশ খুশী খুশীই দেখায়।দিব্যি ছেলেদুটিকে কোথায় কি লাইট লাগাতে হবে দেখিয়ে দেন।এতক্ষণে যেন ছন্দে ফেরে সাধনা। খুঁকীর বাবার সমস্যার কথা ভেবে স্বেচ্ছায় আড়ম্বর কাটছাঁট করার মত দিয়েছিল ঠিকই , কিন্তু মনে মনে একটা আক্ষেপ হয়তো ছিল। হাজার হোক মা তো। সাধনাকে ছন্দে ফেরানোর জন্য ছেলে দুটিকে মনে মনে আরও একবার আর্শিবাদ করেন ভুবনবাবু। তারপর বাড়ির ভিতরে যাওয়ার আগে তাদের উদ্দ্যেশ্যে বলেন - বেশ তোরা তাহলে নিজেরাই সব দেখে শুনে কর। বাড়ির মতোই যখন যা লাগবে চেয়ে নিবি।
---- বেশ স্যার। আমাদের নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না।
ফুর ফুরে মন নিয়ে স্বামীকে অনুসরণ করেন সাধনা। আর মনে মনে ভাবেন , একেই বোধ হয় বলে ভক্তের ভগবান। তারা তো চান নি , ভগবান চেয়েছেন বলেই তো আলো জ্বলল, সানাই - মাইক বাজল। আর কিছু ভাবার অবকাশ পান না সাধনা।
ছেলের গায়ে হলুদ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। মেয়ের বাড়ি থেকে বীরমুঠির কড়ি নেওয়ার জন্য নাপিত এসে বসে রয়েছে। ছেলের গায়ে ছোঁওয়ানো হলুদ নিয়ে যাওয়ার পর মেয়ের গায়ে হলুদ হবে। তাই সে ঘন ঘন তাড়া দেয় -- কই মা হলো ? তারই মাঝে কেউ এসে জিজ্ঞেস করে , বৌদি দুপুরে কি রান্না হবে ? আরও নানা সাত সতেরো কাজে মাথা ঘামাতে গিয়ে তার পাগল হওয়ার যোগাড়। ওইভাবেই ব্যস্ততা আর আনন্দের মধ্যে দিনটা কেটে যায়। প্রথম লগ্নেই বিয়ে তাই সন্ধ্যা হতেই শুরু হয়ে যায় বিয়ে বের করার তোড়জোড়। সাধনা একে একে এনে বের করে দেন বরের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সামগ্রী।
এনে দেন বিয়ের ছাপানো পদ্যও।ছেলের বিয়ে চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পরই নিমন্ত্রণ পত্রের সঙ্গে বিভিন্ন জনের নাম দিয়ে লিখে ওই পদ্য ছাপিয়ে আনেন ভুবনবাবু। আজ বিয়ে বাড়িতে অতিথি অভ্যাগতদের হাতে তা তুলে দেওয়া হবে। সেই সময় এসে পৌঁছোন ধরণী পাহাড়ের সেই পুরোহিত ধীরেন স্যানাল। সবাই আশ্চর্য হয়ে যান। সাধনা এগিয়ে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানান -- আসুন, আসুন। কি সৌভাগ্য আমাদের। আপনি যে মন্দির ছেড়ে আসতে পারবেন তা আমরা ভাবতেও পারি নি।
--- হরগৌরীর মিলন হবে আর আমি না এসে থাকতে পারি ? আমি সেই প্রথমদিন দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম ওদের মিলন তো ঠাকুরেরই অভিপ্রায়। তাই তো ঠাকুরের প্রসাদীফুল নিয়ে এসেছি।
---- বাবা আপনি এসেছেন ভালোই হয়েছে। বিয়ের মন্ত্র পড়ানোর দায়িত্বটা আপনি নিলে আমাদের ভালো লাগবে।
---- তা হয় না মা , যারা সারা বছর তোমাদের পুজো আচ্চা করেন তাদের বাদ দিয়ে আমার মন্ত্র পড়ানোটা ভালো দেখায় না। ওদের অভিমান হতে পারে। তাছাড়া মন্দির ফেলে একজনকে নিয়ে এসেছি। তাই আমাকে যে ফিরে যেতেই হবে মা।
তাঁর কথার যৌক্তিকতা অনুধাবন করেন সাধনাও। তাই আর জোরাজুরি করেন না। সামান্য ফল - মিস্টি মুখে দিয়ে মনোকে আর্শিবাদ করে বিদায় নেন তিনি। সেই সময় পালকি এসে দাঁড়ায় বাড়ির দোরগোড়ায়। আসে চারটি গোরুর গাড়িও। আগে ঠিক ছিল বরযাত্রীরা সব হেঁটেই যাবেন। এপাড়া আর ওপাড়াই তো ব্যাপার। কিন্তু ভুবনবাবুর সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন। যাবতীয় স্ত্রী আচার সেরে সাধনা ছেলের মাথায় ঠাকুরমশাইয়ের প্রসাদী ফুল ছুঁইয়ে পালকির কাছে পৌঁছে দেন।
প্রনাম করে পালকিতে ওঠার আগে রীতি মেনে মনো বলে , মা তোমার জন্য দাসী আনতে চললাম। স্ত্রী আচারে উপস্থিত মহিলাদের শেখানো কথাই বলতে হয় মনোকে। কিন্তু কথাটা যেন বড্ড কানে লাগে তার। দাসী কথাটার মধ্যে কেমন যেন একটা চাকরানী -- চাকরানী ভাব আছে। বাড়ির বৌ আনা মানে কি নিছকই একটা চাকরানী আনা ? সব ক্ষেত্রে হয়তো নয়। কিন্তু কোথাও কোথাও তো বউ আনা মানেই বাড়িতে যেন একটা বিনা পয়সার ঝি আনা। ওই শব্দটাও যেন সেই প্ররোচনাই দেয়। নিজের বিয়ের কথাও মনে পড়ে যায় সাধনার। বিয়ের পর বাপের বাড়ি ছেড়ে আসার সময় - উল্টো দিকে মুখ করে এক মুঠো চাল ছুড়ে দিয়ে তাকেও বলতে হয়েছিল , মা তোমাদের ভাত কাপড়ের ঋণ শোধ করলাম। বাবা--মায়ের ঋণ কি কোনদিন শোধ হয় ? সেই সময় সানাই বেজে উঠতেই বাস্তবে ফেরেন সাধনা। ছেলেকে পালকিতে তুলে দিয়ে চুমু খান। বর নিয়ে বরযাত্রীরা বেরিয়ে যেতেই হাত জোড় করে কপালে ঠেকান সাধনা।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment