( কিস্তি --- ৫৮ )
সে যে নিভৃতে খুঁজে চলেছে প্রিয় দুটি চোখ। কিন্তু সেই দৃষ্টি পথের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কালরাত্রি। দুজনেই কাল রাত্রি অবসানের প্রতীক্ষায় থাকে।কাল রাত্রি কেটে আসে সোহাগ রাতের দিন।একদিকে তারই আয়োজন অন্যদিকে অত্মীয়স্বজন , কাজের লোকেদের বিদায় জানাতে জানাতে দম ফেলার ফুরসৎ পান না সাধনা।আত্মীয় স্বজনদের ফেরার সময় বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য সবার হাতেই হাড়ি ভর্তি মিষ্টি তুলে দেন সাধনা। সুধাদিদের যাওয়ার সময় মিস্টির পাশাপাশি রুম্পাকে একটা তাঁতের শাড়িও দেন তিনি।খুকীকেও দেন একটা শাড়ি।ছন্দার হাতে উপহার হিসাবে বেশ কয়েকটা শাড়ি পড়েছে। সেখান থেকেই বেছে ভালো শাড়িগুলোগুলো দেন। অধিকাংশ আত্মীয় স্বজন চলে যাওয়ায় বাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। কয়েকদিন ধরে জমজমাট হয়ে থাকা বাড়িটা যেন এক লহমায় ঝিমিয়ে পড়ে। থাকার মধ্যে দু'চারজন আত্মীয় আর অম্লানবাবু রয়েছেন।
অম্লানবাবুও চলে যেতে চেয়েছিলেন।ভুবনবাবুই যেতে দেন নি তাকে। আত্মীয়রা বিকেলের মধ্য চলে যাবেন। কিন্তু ঠিক হয়েছে বিয়ে বাড়ির ঝামেলা একটু মিটলে তবেই যাবেন অম্লানবাবু। বন্ধুর অনুরোধ ফেলেতে পারেন নি তিনি। আত্মীয় স্বজনরা চলে যাওয়ার পরই সানাই আর লাইনের লোকেরা একে একে বিদায় নিতে হাজির হয়। প্রথমেই আসে দ্বারিক আর তার দলবল।তারপর লাইট মাইকের সেই ছেলে দুটোও আসে।সাধনা তাদেরও প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ভাঁড়ে মিষ্টি বেঁধে দেন। সেই ভাঁড় হাতে নিয়ে দ্বারিক আপ্লুত গলায় বলে , মাগো তুমি স্বাক্ষাৎ মা ভগবতী। বহু বিয়ে বাড়িতে বাজিয়েছি , কিন্তু কেউ কোনদিন আমাদের মতো ছোটলোকদের হাতে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য মিষ্টির ভাঁড় তুলে দেয় নি। কি খেলাম , কোথাই থাকলাম সেই খোঁজই নেয় না কেউ। একমাত্র তুমিই বারে বারে আমাদের খোঁজ খবর নিয়ে গিয়েছ।
---- কে কি করে তা জানি না দ্বারিক। কিন্তু তোমাদের মাস্টারমশাইয়ের কাছে ছোটলোক-বড়োলোকের কোন বিভেদ রেখা নেই। তাছাড়া মিষ্টি বাড়তি হয়েছে বলেই তো দিতে পারছি।কিনে দেওয়ার মতো তো সামর্থ্য আমাদের নেই।বৃদ্ধি না হলে তো আর দিতে পারতাম না।তোমাদের বাড়িতেও ছেলেমেয়ে আছে।বাবা বিয়ে বাড়ি থেকে কি নিয়ে ফিরছে
সেই আশায় তারাও তো অপেক্ষায় থাকে।
---- সেটাই তো বলছি মা , তোমার ভগবতীর ভান্ডার বলেই প্রানে ধরে দিতে পারছো।
নাহলে অনেক বড়ো লোকের বাড়িতে গাদা গাদা খাবার আর মিষ্টি বেঁচে যেতে দেখেছি।কই তারা তো কোন দিন হাতে তুলে দিতে পারে নি। হয় নিজেরা পচিয়ে পচিয়ে খেয়েছে , নয়তো বাজারে বিক্রি করে দিয়ে এসেছে। আর সেই মিষ্টিই আমরা ছেলেমেয়েদের জন্য কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরেছি।
--- দেখ দ্বারিক আমরা মানুষকে খাওয়ানোর জন্যই তো এই সব তৈরি করিয়েছিলাম। বেঁচে গেলে সেটা বিক্রি করে টাকা ঘর ঢোকানো জন্য তো করি নি।
---- তোমার মতো করে ক'জন ভাবতে পারে মা ?
দ্বারিক আর পরেশরা প্রনাম করে বিদায় নেওয়া উপক্রম করতেই এগিয়ে আসেন ভুবনবাবু। তাদের কাছে ডেকে কিছু টাকা তুলে দিয়ে হাতের মুঠো বন্ধ করে দিয়ে বলেন , বাড়িতে গিয়ে দেখো কেমন ?
কিন্তু হাতের মুঠো খুলে টাকা দেখেই ওরা তীব্র আপত্তি তোলে। দ্বারিক বলে , না এ টাকা আমরা নিতে পারব না। আমরা তো স্বেচ্ছায় এসেছি।
---- আমরাও তো তোমাদের স্বেচ্ছায় সামান্য ক'টি টাকা দিচ্ছি। এ তোমাদের পারিশ্রমিকের তুলনায় কিছুই নয়। তাই আর না কোর না। তাহলে আমি খুব কষ্ট পাবো।মনে হবে আমি তোমাদের ভালোবাসার সুযোগ নিয়েছি।
আর কিছু বলতে পারে না তারা। নবদম্পতিকে আর্শিবাদ করতে করতে বাড়ির পথ ধরেন তারা।দুপুরের খাওয়া দাওয়া পর বাড়ি যাওয়ার আগে কাজের লোক, সান্ধ্য আসরের বন্ধুদেরও জনে জনে মিষ্টি বেঁধে দেন।ওদের হাত দিয়ে ডাক্তারকাকা আর খুঁকীদের বাড়িতেও পাঠিয়ে দেন মিষ্টি। টানা কয়েক দিনের পরিশ্রমের পর সকলেরই শরীর আর ধকল নিতে পারছিল না। তাই সবাই একে একে বাড়ি ফিরে যায়। বন্ধু অম্লানকে নিয়ে গা গড়ান ভুবনবাবুও। মনোও নিজের ঘরে ঘুমিয়েছে। কেবল ছন্দা তার সংগে ঘুর ঘুর করে। সাধনা
কয়েকবার তাকে বিশ্রাম নিতে বলেছেন। ছন্দা সেই কথা কানে তোলে নি। ঘুরিয়ে তাকেই
বলেছে , তুমিই বরং একটু বিশ্রাম নাও। খেটে খেটে তোমার চোখ মুখ কালি হয়ে গিয়েছে।
---- তাই বুঝি ? মায়ের আমার সব দিকে লক্ষ্য। বলে ছন্দার চিবুকে হাত ছুঁইয়ে চুমু খায়।
ছন্দা বলে , তুমি তো এখন নিজের দিকে একবার চেয়ে দেখার ফুরসত পাচ্ছো না। এরপর অসুখে পড়লে কি ?
---- কেন তুই আমার সেবা করবি ? কি রে করবি না আমার সেবা ?
--- তার জন্য তোমায় অসুখে পড়তে হবে কেন ? আমি এমনিই তোমার সেবা করব মা।
--- ওরে আমার সোনা মা। বলে আরও একবার ছন্দার চিবুকে হাত ছুঁইয়ে চুমু খান সাধনা।সেই সময় ফুল নিয়ে হাজির হয় মনোর স্কুলের কয়েকজন বন্ধু স্থানীয় সহকর্মী এবং তাদের স্ত্রী। বৌভাতের সময় খাওয়া-দাওয়ার পর তারাও উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভুবনবাবু তাদের নিরস্ত করেন। তখনই তারা ফুলশয্যা খাট আর কনে সাজানোর
অনুমতি চায়। ভুবনবাবু আর না করতে পারেন নি। সেই মতো তারা নিজের হাতে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয় ফুলশয্যার খাট। তাদের স্ত্রী'রা সাজিয়ে দেয় ছন্দাকে। সেই সব দেখতে দেখতেই সাধনার অবচেতন মনে জেগে ওঠে ছেলেকে ঘিরে মায়েদের মধ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাহিত হয়ে আসা সেই চিরন্তন আশঙ্কা। আজ থেকে মায়ের আঁচল ছেড়ে ছেলে অন্য এক নারীর আঁচলে বাঁধা পড়তে চলছে। আর এক নারীর সংগে ভাগ হতে চলেছে তার নাড়ী ছেঁড়া ধন। আজ থেকেই কেন , বিয়ের দিনেই তো অন্যের আঁচলের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গিয়েছে মনোর। পরক্ষণেই তার মনে হয় , ছি- ছি এ কি ভাবছে সে ? ছন্দাকে প্রতিপক্ষ ভাবছে সে ? পেটে না ধরলেও ছন্দাও যে তার এক নাড়ী ছেঁড়া ধরনের মতোই। সে'ই তো তাকে পচ্ছন্দ করে এই ঘরে তুলেছে। তাহলে কেন তার মনে এল ওইসব কথা ? আসলে সব মায়ের মনেই বোধ হয় চিন্তাটা লুকিয়ে থাকে।
চিন্তাটাকে মন থেকে তাড়ায় সাধনা।খাট আর কনে সাজিয়ে মনোর সহকর্মীরা ফিরে যাচ্ছিল। সাধনা তাদের আটকে দিয়ে বলেন , চলে যাব বললেই কি হয় বাবা ? রান্না হয়ে গিয়েছে , একেবারে খেয়েই যাবে। ছেলেগুলো সাধনার কথা ফেলতে পারে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই রান্না হয়ে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে ছন্দা আর মনোও খেতে বসে। খাওয়ার দাওয়ার পর বন্ধুরা বাড়ি ফেরার জন্য ব্যগ্র হয়ে পড়ে। তাদের বিশেষ দোষও দেওয়া যায় না। সেই বিকেল থেকে আকাশে মুখ ভার। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। তাই সহকর্মীদের বাড়ির বার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে মনোতোষ। তারপর সে নিজের ঘরে চলে যায়।কিন্তু ছন্দা কিছুতেই সেই ঘরের দিকে পা বাড়াতে পারে না।অথচ বিয়ের আগে কত অনায়াসেই না সে মনোদার ঘরে যেত।
কিন্তু আজ একটা লজ্জা বোধ যেন তার পা টেনে ধরে।তার আড়ষ্ঠতা নজর এড়ায় না সাধনার। তাকেও ওই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল।শাশুড়ি সেদিন তাকে স্বামীর ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। শাশুড়ির ধারা অনুসরণ করেই সে ও ছন্দার হাত ধরে ছেলের ঘরের সামনে পৌঁচ্ছে দেন।ধীরে ধীরে ঘরে পা রাখে ছন্দা।
তার পরই যেন আচমকা তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।কিছুতেই বরের দিকে সরাসরি তাকাতে পারে না সে। মনোতোষই এগিয়ে এসে স্ত্রীর হাত ধরে খাটে নিয়ে গিয়ে বসায়। আচমকা বিকট শব্দ করে মেঘ ডেকে ওঠে। আর ভয়ে মনোতোষকে জড়িয়ে ধরে ছন্দা।অদ্ভুত ভালোলাগায় মনোতোষ ও ছন্দাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর মুখটা তুলে ধরে বলে অপরূপ তার ঠোঁট নেমে আসে ছন্দার ঠোঁটে।স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে মনোতোষ গলা নামিয়ে আবৃত্তি করে ওঠে ---
" দুজনের চোখে দেখেছি জগত,
দোহারে দেখেছি দোহে --
মরুপথ তাপ দুজনে নিয়েছি সহে।
গলা মিলিয়ে ছন্দাও বলে ---
' ছুটি নি মোহন মরীচিকা পিছে পিছে ,
ভুলাই নি মনে সত্যেরে করি মিছে।
তারপর মনোতোষ বলে --
" এই গৌরবে চলিব , এ ভবে
যতদিন দোহে বাঁচি।
এই বানী, প্রেয়সী হোক মহীযসী --
তুমি আছ, আমি আছি।।"
বাইরে তখন তুমুল ধারায় বৃষ্টি নামে। ঘরের ভিতরে ওরা দুজনেও ভিজে যায়। অবিরাম ভিজতেই থাকে।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment