Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৫৯




     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











              কালের কারিগর
              

                          অর্ঘ্য ঘোষ


                          ( কিস্তি -- ৫৯ )  



অবিরাম ভিজতেই থাকে। সুখানুভূতিতে ভরে যায় দুজনের মন। ঘুম ভাঙতেই ফের এক লজ্জাবোধ পেয়ে বসে ছন্দাকে। কাল ঘরে আসতে যেমন লজ্জা করছিল , আজ ঘর থেকে বেরোতেও একই অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় তাকে।মনে হয় যেন সবাই তাদের একত্রে রাত্রি যাপনের বিষয়টি নিয়েই উৎসুক হয়ে রয়েছেন। তবে মন্দের ভালো , এখনও কেউ ওঠে নি। তাই দ্রুত বিছানা ছাড়ে সে।সবার আগে ঘর ছেড়ে বেরোতে পারলেই যেন অনেকখানি স্বস্তি পাবে বলে মনে হয় ছন্দার। বাইরে বেরনোর আগে বরের দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে সে।আরে সারা মুখে সিঁদুরে মাখামাখি। হবে না'ই বা কেন যা দুষ্টুমি করছে কাল।সে সব কথা মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে তার চোখ মুখ।ওর অবশ্য সে সব দিকে খেয়ালই নেই।দিব্যি শিশুর মতো সারা মুখে সিঁদুর মেখে ঘুমোচ্ছে। খুব ইচ্ছে করে মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে আলতো করে ঠোঁটে কয়েকটা চুমু খেয়ে নেয়। কিন্তু বহু কষ্টে সে নিজেকে সংযত করে। কারণ ওই করতে গিয়ে একবার যদি ও জেগে যায় তাহলে অবধারিত ভাবে সাত সকালে ফের দুষ্টুমি শুরু করে দেবে। তখন সবার ওঠার আগে বেরনোটাই হয়তো আর হবে না। কিন্তু এই অবস্থায় ওকে ফেলে রেখে যাই'ই বা কি করে ? যদি ও ওরকম সিঁদুর মাখা অবস্থাতেই বেরিয়ে পড়ে ? তাহলে তো  লজ্জায় মাথা কাটা যাবে তার। মুখ তুলে কারও দিকে তাকাতেই পারবে না। তাই আলতো হাতে কাপড়ের আঁচল দিয়ে সিঁদুর মুছতে শুরু করে সে। কিন্তু মোছা শেষ হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে চোখ মেলে চায় মনতোষ। স্ত্রীকে ওই ভাবে বুকের উপর ঝুঁকে আঁচল দিয়ে গাল ঘষতে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সে। ছন্দা গিয়ে টেবিল থেকে হাত আয়নাটা এনে তার মুখের সামনে ধরে। দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠে মনোতোষের মুখে। স্ত্রীকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে সে। এই আশঙ্কাটাই করছিল ছন্দা। মনোতোষ দুষ্টুমি শুরু করলে সহজে আর তার বাইরে যাওয়া হবে না। তাই বরের আলিঙ্গন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য অনুনয় করে ছন্দা। মনোতোষ আঙুল দিয়ে নিজের ঠোঁটটা দেখিয়ে দেয়। সেই ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে তবে ছাড়া পায় ছন্দা। বাইরে আসতেই দেখে ততক্ষণে সাধনা উঠে দুয়ারে ছড়ো-মারুলি দিতে শুরু করেছেন। সে হাতমুখ ধুয়ে কাছে গিয়ে বলে , আমি দেব মা ? সাধনা স্নেহের সুরে বলেন ,তোকে এসব করতে হবে না। তুই বরং যা দেখি মা , চা-টা করে ফেল।অম্লানবাবু , তোর কাকুরা উঠে পড়বেন। তারপরই ঠোঁট কামড়ান সাধনা। মৃদু হেসে বলেন, অভ্যাস বশে কাকুই বলে ফেলেছি। তুই আমাদের বাবা-মা বলা শুরু করেছিস আর আমরা সেই কাকু-কাকীমাতেই আটকে আছি।
---- থাক না মাব ! আমার তো কাকু-কাকীমা নেই। তোমরা একাধারে আমার বাবা-মা, আর কাকু-কাকীমাও হয়ে থাকো। যখন যেটা ইচ্ছে বলব।
--- বেশ তোর যখন ইচ্ছা , তখন না হয় তাই হবে। কিন্তু এখন যা দেখি চা-টা করে ফেল। তারপর তো জলখাবারের যোগাড় করতে হবে। আজ আবার তোদের ও বাড়িতে দ্বিরাগমনে যেতে হবে। তোর ঠাকুমা এসে পড়লেন বলে।




                  চা করতে করতেই সবাই উঠে পড়েন। ছন্দা সবার হাতে হাতে চা দেয়। হাতের কাজ সেরে চা খেয়ে স্নানে চলে যান সাধনা। সাধনা ফিরতেই স্নান করে নেয় ছন্দাও। তারপর শাশুড়ির সঙ্গে জলখাবার তৈরিতে হাত লাগায় সে। তার মধ্যেই নাতনী আর নাতজামাইকে নিতে গরুর গাড়ি নিয়ে হাজির হন শান্তিলতা।এ গ্রামের এটাই রীতি। ঢিল ছোঁড়া দুরত্বের ব্যবধান হলেও দ্বিরাগমন , অষ্টমঙ্গলায় গরুরগাড়িতে করেই মেয়ের বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা নিতে আসেন। ব ড়োলোকেরা অবশ্য পালকি কিম্বা চারচাকার গাড়িও পাঠান। ঠাকুমাকে তাদের নিতে আসতে দেখে খুব ভালো লাগে ছন্দার। বাসর রাতের দিন ওইভাবে প্রচলিত সংস্কারের বেড়া ভেঙে দিতে না পারলে ঠাকুমা তার বিয়েতে ব্রাত্যই থেকে যেতেন। সারা জীবন তার আক্ষেপ থেকে যেত। ঠাকুমাও হয়তো মনে মনে কষ্ট পেতেন। সেই কথাটা মনে পড়তেই সে ছুটে গিয়ে বাচ্চাদের মতো ঠাকুমা জড়িয়ে ধরে। শান্তিলতাও নাতনীর মুখটা তুলে ধরে বলেন , আমার দিদিভাইকে তো রাজরানীর মতো দেখাচ্ছে গো। আর দেখাবেই না বা কেন ?  রাজার ঘরে পড়েছে যে। তা আমার সেই রাজকুমারটি কই ? 
সেই সময় মনোতোষ, সাধনা, ভুবনবাবু এগিয়ে এসে শান্তিলতাকে প্রনাম করে। শান্তিলতা সকলকে আর্শিবাদ করেন। সাধনা তাকে হাতে ধরে ঘরে নিয়ে যান।জলখাবারের পরই নাতনী আর নাতজামাইকে নিয়ে রওনা দেন শান্তিলতা। অম্লানবাবু ছাড়া বাকি আত্মীয়রাও বাড়ি ফিরে যায়। খাওয়া দাওয়া করে বিকালের দিকে ফিরে যাবেন অম্লানবাবুও। তাই দুপুরে খাওয়া -দাওয়ার পর দুই বন্ধুতে বৈঠকখানা ঘরে কিছুক্ষণ গল্প করার জন্য গিয়ে বসেন। সেখানেই কলেজের কথাটা পাড়েন ভুবনবাবু। আর খুব বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েন অম্লানবাবু। এই আশংকাটাই তিনি করছিলেন। কি করে সত্যি কথাটা বন্ধুকে বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভুবনবাবু ফের তাগাদা দেন -- কি রে , কি হোল কিছু বলছিস না যে ? কলেজের অনুমোদনের ব্যাপারটা কতদুর কি হল বল ?
--- দেখ একটা কথা তোকে অনেকদিন ধরে বলব বলব করেও তোর মন খারাপ হয়ে যাবে ভেবে বলতে পারি নি।
---- কি কথা ? 
---- তুই কলেজের আশা ছাড়।
---- কলেজের আশা ছাড় মানে ? এতদুর এগিয়ে এসে আশা ছাড় বললেই কি অত সহজে ছাড়া যায় ? তাছাড়া আশাটা আমার একার নয়। এই এলাকার হাজার - হাজার মানুষ কলেজ হবে বলে  আশা করে বসে আছে।
---- তাদের কথা ছাড়। তাদের ব্যাপার তারা বুঝে নেবে। তুই অযথা কলেজের জন্য ঘুরে ঘুরে হয়রান হতে যাস নে।
---- আচ্ছা ব্যাপারটা কি খুলে বল দেখি ?  
----- সরকার তোদের কলেজের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। তোদের ফাইল আলমারির মাথায় ধুলোয় ঢাকা পড়ে গিয়েছে। আমরা চেষ্টা করেও কিছু করতে পারি নি।
---- কেন ,  সরকার আমাদের কলেজের ব্যাপারে আগ্রহী নয় কেন ? 
---- তোরা ওদের দলের লোক নোস বলে।
--- আমরা তো কারও দলেরই লোক নই।
---- সেটাই তো সমস্যা। তোরা ওদের মিটিং -মিছিলে যাস না। ওদের শ্লোগানে গলা মেলাস না। তাই শাসকদল মনে করে কলেজটা হয়ে গেলে তোরা যারা বিষয়টা অর্গানাইজ করেছিস তারাই প্রচার পেয়ে যাবি। আর বিরোধীরা সেটা হাতিয়ার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুঠবে।
--- বাহ , এতো মজার কথা। কে রাজনৈতিক ফায়দা লুঠবে বলে এত মানুষের আশা - আকাঙ্ক্ষা জলাঞ্জলি দিতে হবে ? 
--- তুই রাজনীতির প্যাঁচপোঁচ অত বুঝবি না। রাজনীতির কারবারিরা কার কি এলো গেল তা নিয়ে খুব কমই মাথা ঘামায়। ক্ষমতায় টিকে থাকা নিয়েই তাদের যত মাথা ব্যাথা।
---- আচ্ছা আমরা যদি সরে যায় তাহলে ? ওরা তো আমাদের সংগৃহিত জমি আর টাকা নিয়ে কলেজটা করতে পারে। সেক্ষেত্রে তো ওরাই প্রচার পাবে। আর আমাদের কে প্রচার পেল না পেল তা  নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমরা চাই যে কোন মুল্যে কলেজটা হোক। 
---- তোরা সরে গেলেও এই মুহুর্তে কলেজ হলে লোকে সেই তোদের নামেই জয়ধ্বনি দেবে।তাই তাতেও সরকারের মন উঠবে না।
---- তাহলে কি কোনদিনই কলেজ হবে না ? 
---- হবে হয়তো , যেদিন ওরা চাইবে।
---- ততদিন তো কয়েকটা প্রজন্ম অন্ধকারে থেকে যাবে।
---- যাবে তো যাবে, তোর উপরে তো নেই ভুবনের ভার।
---- আমি তো ওই ভাবে ভাবতে পারি না। আমি একজন শিক্ষক , সমাজকে শিক্ষার পথ দেখানোই আমার কর্তব্য।তাছাড়া সবাই আমার উপর আশা ভরসা করে টাকা পয়সা দিয়েছে।কি জবাব দেব আমি তাদের কাছে ?
----- সবাইকে টাকা পয়সা ফেরত দিয়ে দে।
---- সেটাও তো সম্ভব নয়। টাকা তো ফিক্সড করা হয়ে গিয়েছে কলেজের নামে। সেই ডিপোজিট ভাঙানোও  তো সহজ নয়। তাছাড়া কলেজের ভিতের গাঁথনি , জমি রেজিস্টারি করতেও তো অনেক টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। আমাকে তো শেষ পর্যন্ত চোর সাজতে হবে। 
--- তাহলে বরং হচ্ছে হবে করে কাটিয়ে দে।
---- কক্ষনো না , আমি মানুষের সঙ্গে এভাবে প্রতারনা করতে পারব না। যা- যা , তোকে আর উপদেশ দিতে হবে না।বলে মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে ওঠেন ভুবনবাবু। সেই চিৎকার  শুনে চমকে উঠেন সাধনা। স্বামীকে কখনো ওই ভাবে চিৎকার করতে শোনেন নি। তাই দ্রুত  বৈঠকখানা ঘরে ছুটে যান তিনি। সেখানে গিয়ে দেখেন রাগে স্বামীর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কাঁপছেন আর বলছেন -- তোরা পারিস , কিন্তু আমি মানুষের সঙ্গে প্রতারনা করতে পারব না।




                  স্বামীর কথা শুনে অম্লানবাবুর মুখের দিকে তাকান সাধনা।অম্লানবাবুকে খুব অপ্রস্তুত দেখায়। কিছুটা আমতা আমতা করে বলেন , দেখুন না বৌদি সরকার কলেজের অনুমোদন দেবে না , তা আমরা কি করতে পারি ? ঘুরে ঘুরে অহেতুক হয়রান হতে হবে। সেটাই ওকে বুঝিয়ে বলতে গেলাম কিন্তু ও আমার উপরেই অযথা রাগ করছে। এদিকে বাড়ি যাওয়ারও সময় হয়ে এলো। কি করি এখন ভেবে পাচ্ছি না।
তারপর সবকিছু শোনার পর অম্লানবাবুকে বাইরে ডেকে সাধনা তার হাত দুটো ধরে বলেন , ভাই তুমি ওর কথা শুনে কিছু মনে কোর না। আসলে সবাই তো ওর ওপরেই ভরসা করে আছে তাই কলেজটা হবে না শুনেই নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেন নি। নাহলে তোমার মতো দীর্ঘদিনের বন্ধুকে ও ওই ভাবে কথা বলতে পারে ! তুমি নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারো। কিন্তু হাত জোড় করে বলছি এত দিনের বন্ধুত্বের সম্পর্কটুকু যেন নষ্ট করে ফেলো না ভাই।
---- না , না বৌদি আমি কিছু মনেই করি নি। আপনি বরং ওকে পরে বুঝিয়ে বলবেন। বেশ তাহলে আমি এখন আসি বৌদি ? 
---- হ্যা , এসো ভাই। 
দ্রুত অম্লান বাড়ির বাইরে পা রাখে। সাধনার মনে হয় অম্লান যেন পালিয়ে বাঁচে।

                          ( ক্রমশ )



No comments:

Post a Comment