Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৬০



     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











              কালের কারিগর
              

                          অর্ঘ্য ঘোষ

                            (  কিস্তি --- ৬০  ) 


সাধনার মনে হয় অম্লান যেন পালিয়ে বাঁচে। তাকে বিদায় দিয়ে বৈঠকখানা ঘরে ফিরে দেখেন তখনও স্বামী সমানে বকে চলেছেন। তার চোখে মুখে তীব্র হতাশার ছাপ। খুব মায়া হয় সাধনার। স্বামীর পাশে বসে হাতটা নিজের হাত তুলে নিয়ে বলেন , অত ভাবছো কেন ঠাকুর চাইলে তোমাদের কলেজ হবেই। আমার মন বলছে একদিন তোমার স্বপ্ন সার্থক হবেই দেখো। 
কিন্তু কোন সান্ত্বনাই শান্ত করতে পারে না ভুবনবাবুকে। তার চোখের দৃষ্টি উদভ্রান্তের মতো হয়ে ওঠে। সেই চাউনি দেখে সাধনা বড়ো ভয় পেয়ে যান। কেমন যেন অপ্রকৃতস্থ দেখায় ভুবনবাবুকে। কি করবেন ভেবে পান না সাধনা।  মনোকে খবর পাঠিয়ে চলে আসতে বলবেন ? কিন্তু আজই যে ওরা দ্বিরাগমনে গেল। আর আজই কি চলে আসতে বলা ঠিক হবে ? বেঠিকই বা কি হবে ? বাবার অসুস্থতায় পাশে থাকার চেয়ে অন্য কিছু বড়ো হতে পারে না। কিন্তু স্বামীর সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা এসে তাকে মনোর শ্বশুরবাড়িতে খবর দিতে বারণ করেন। তারা বলেন , আমরা তো আছি।আজ আর ওদের চিন্তায় ফেলতে হবে না। ততক্ষণে একটানা বকতে বকতে নেতিয়ে পড়ছেন ভুবনবাবু। ডেকেও সাড়া মেলে না তার। স্বামীর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাধনা। সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা ছোটেন ডাক্তার কাকার কাছে। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছে যান ডাক্তারকাকা। সাধনা তখনও সমানে কেদেই চলেছেন। ডাক্তারকাকা ভুবনবাবুর নাড়ী দেখে বলেন, কাঁদার কি আছে ? কিচ্ছু হয় নি। এখনই সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একটু গরম জল করে নিয়ে এসো দেখি।
ডাক্তার কাকার কথায় ভরসা পান সাধনা। স্বামীর মাথাটা বালিশে রেখে জল গরম করতে চলে যান তিনি। ডাক্তারকাকা ভুবনবাবুর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেন। তাতেই চোখ খুলে তাকান ভুবনবাবু। স্বস্তি ফেরে সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের মনে। গরমজল নিয়ে ঘরে ঢুকে স্বামীকে চেয়ে থাকতে দেখে দুহাত কপালে ঠেকান সাধনা।
ইঞ্জেকশান দিয়ে ডাক্তারকাকা বলেন ,  ভয়ের কিছু নেই। আচমকা মানসিক চাপ বেড়ে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে। তাই মানসিক চাপ কমাতে হবে। দুশ্চিন্তা ছাড়তে হবে।
সেই কথা শুনে মুখ খোলেন ভুবনবাবু। ক্লান্ত স্বরে বলেন , অত সহজে আমি হাল ছেড়ে দেব না। বাবারও বাবা আছে। দরকার হলে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাব , রাষ্ট্রপতির কাছে যাব। দেখি কি করে ওরা আমাদের কলেজ আটকায় ?
ডাক্তারকাকা বলেন , ঠিকই তো। অত সহজে আমরা ছাড়ব না। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। তুমি মানুষের জন্য ভালো করতে চাইছো , তাই মানুষও তোমার পাশে থাকবে। কিন্তু মানসিক দুশ্চিন্তা করে তুমিই যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো তাহলে লড়াইটাই থেমে যাবে। তুমি কি তাই চাও ?
--- না কাকা কলেজের লড়াই আমাদের জারি রাখতেই হবে।
---- বেশ তাহলে কথা দাও , যা'ই করবে মাথা ঠান্ডা রেখে করবে।
----- তাই হবে কাকা।
ভুবনবাবুকে অনেকটাই স্বাভাবিক দেখায় তখন। সাধনা মনে মনে ভগবানের উদ্দেশ্যে আরও একবার প্রণাম জানান। তারপর চা করতে রান্নাঘরে যান। চা করে নিয়ে এসে দেখেন কলেজ নিয়েই আলোচনায় মেতে রয়েছেন ভুবনবাবু।ফের মাথায় চাপ পড়তে পারে ভেবে সাধনা সবাইকে চা দিতে দিতে প্রসঙ্গ পাল্টানোর উদ্দেশ্যে বলেন -- তাহলে কি আজ আর 
মনোদের খবর পাঠাব ?
কেউ কিছু বলার আগে ভুবনবাবুই বলে ওঠেন -- না না , কি দরকার ওদের শুধু শুধু ব্যতিব্যস্ত করে ? আমি তো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গিয়েছি।




                  চা খেতে খেতেই ঠিক হয় সুবিনয় আর মানস বাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়া করে বৈঠকখানা ঘরে এসে থাকবে। সাধনা বলেছিল , কেউ না থাকলেও অসুবিধা হবে না। আর থাকতে হলে বাড়িতে খেতে যাওয়ারও কোন দরকার নেই। সে'ই দুটো চালেডালে ফুটিয়ে দেবে। কিন্তু কোন কথাই তারা কানে তোলেন না। দুজনকে রেখে বাকিরা বাড়ি চলে যায়। সুবিনয়রা এলে তবেই ওরা যাবে। সাধনা  তাদের জন্য আর একবার চা এবং দুজনের জন্য সামান্য কিছু খাবার তৈরি করে নেন। তারপর স্বামীকে খেতে দেন। খাওয়া পর ওষুধটা খাইয়ে দেন। ওষুধ খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে পড়েন ভুবনবাবু। ডাক্তারকাকা বলেছেন, এ রোগের অবর্থ ওষুধ হল ঘুম। তাই ঘুমের ওষুধই দিয়েছেন তিনি।সুবিনয়রা এসে পৌঁছোতেই সাধনাও চাট্টি মুখে দিয়ে সন্তর্পনে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়েন। রাতটা ভালোই কেটে যায়। সকালে স্বামীকে একটু ভালোই লাগে সাধনার। কিন্তু  কলেজের চিন্তা তার মাথা থেকে যায় না। সকাল থেকেই ফাইলপত্র বের করে রাজ্যপাল, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখতে বসে যান। সাধনা মনে মনে ভাবেন , এ তবুও মন্দের ভালো। মাথা গরম করার চেয়ে চিঠিচাপাটি নিয়ে আছে , থাক। সবেতেই নিষেধ করা হলে আবার হিতে বিপরীত হতে পারে। চা খেয়ে চিঠি ক'টা ডাকে দেওয়ার জন্য স্ত্রী'র কাছে টাকা চান ভুবনবাবু। শুনে সাধনা বলেন , অসুস্থ শরীরে তুমি আজ আর না'ই বা গেলে! মনো এসে বরং দিয়ে আসত।
---- তুমি বোঝ না সাধনা , একটা দিনও এখন মহা মুল্যবান। চিঠি গুলো যত তাড়াতাড়ি পৌঁছোয় ততই ভাল। মনোরা কখন ফিরবে তার কিছু ঠিক আছে ? 
অগত্যা টাকা ক'টা এনে স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বলেন - সাবধানে যাবে কিন্তু। কোথাও অসুস্থ বোধ করলে সামনে যাকে পাবে তাকেই বাড়ি পৌঁচ্ছে দিতে বলবে।
---- তুমি অত ভেব না তো। আমি যাব আর আসব। ভুবনবাবু বেড়িয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ফেরে মনোতোষরা। তাদের সঙ্গে ছন্দার বাবা - মা'ও এসেছেন। সকালে ডাক্তারকাকাই তাদের খবরটা দিয়েছেন। সব কিছু শোনার পর মনোতোষ আর ছন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে -- বাবার এই অবস্থা আর আমাদের একটা খবর পর্যন্ত দিলে না মা ? 
একই অনুযোগ করেন ছন্দার বাবা-মা'ও।সাধনা তাদের বলেন , আমি খবর দিতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু তোর বাবার বন্ধুরাই বললেন, আমরা তো আছি। ওরা দ্বিরাগমনে গিয়েছে , রাতে আর ওদের দুশ্চিন্তায় না ফেলাই ভালো। তোদের বাবাও সুস্থ হয়ে একই কথা বললেন।
মায়ের কথা শুনে ছন্দা আর মনোতোষ বলে , বাবার এই অবস্থা আর আমাদের আনন্দটাই বড়ো হলো ? 




             তারপরই রেগে রেগে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে যায় মনোতোষ। কিছুক্ষণের ভিতরেই পোষ্ট অফিস থেকে বাবাকে নিয়ে ফেরে সে । ভুবনবাবু ফিরতেই ছন্দা প্রনাম করে বলে , বাবা আপনার  শরীর খারাপ তাও আমাদের খবর দিলেন  না কেন ? 
---- আমি তো তখনই সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম রে মা। তাই আর তোদের রাতে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাই নি।
---- আপনি এখন ভালো আছেন তো বাবা ? 
---- তোদের এত ভালোবাসা - এত ভক্তি, আমার সাধ্য কি খারাপ থাকি ?  
---- হ্যা, বাবা আপনি খুব  ভালো থাকবেন।
ভুবনবাবু ছন্দাকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেন -- পাগলি মা আমার।
ততক্ষণে চোখ ভিজে ওঠে ছন্দার। শুকনো থাকে না বাকিদের চোখও। তারপর থেকেই ভুবনবাবুর কাজ হয়ে ওঠে বিভিন্ন জায়গায় চিঠি পাঠানো। কিন্তু কোথাও কোন সাড়া মেলে না। তাই ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। তার মধ্যেই সবাই জেনে যায় খবরটা। যার সঙ্গে দেখা হয় সেই বলে, কই মাস্টারমশাই টাকা পয়সা দিলাম। কলেজ তো আর হবে না  শুনছি। তাহলে আমাদের টাকা পয়সাগুলো ফিরিয়ে দিন।
প্রতিনিয়ত জবাবদিহি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ওঠেন তিনি। তার উপরে শাসকদলের সৌজন্যে চোর প্রতিপন্ন হয়ে পড়তে হয় তাকে। একদিন শাসক দলের কয়েকজন নেতা এসে তাকে বলেন , মাস্টারমশাই কলেজ তো আর হোল না। টাকাগুলো আমাদের দিন। আমরা পার্টি অফিস করি।
কথাটা শুনে নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ভুবনবাবু। ছেলেগুলো বলে কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টাকায় পার্টি অফিস ? ওদের মধ্যে সুব্রত বলে ছেলেটাই পালের গোদা। তিনি তাকে উদ্দেশ্য করেই বলেন - শোন তোমরা , টাকাটা আমার নয়। এলাকার মানুষ কলেজ গড়ার জন্য টাকাগুলো দিয়েছেন। তাই আমি সেই টাকা তোমাদের দিতে পারব না।
---- তাই তো বলছি , টাকাটা যখন আপনার নয় তখন আপনি আটকে রেখেছেন কেন ? 
--- আটকে রেখেছি কলেজ গড়ার জন্য। তোমরা কলেজ , নিদেনপক্ষে পক্ষে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ো আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু পার্টি অফিস করতে দিতে পারব না। পার্টি অফিস তো একটা বিশেষ দলের ব্যাপার। টাকাটা কিন্তু দলমত নির্বিশেষে সবাই দিয়েছেন।
---- টাকাটা কি আপনার বাপের , যে আপনার যা ইচ্ছে তাই করবেন ? আমরা কিছু বুঝি না ভাবছেন ? নিজে টাকাটা আত্মসাতের ধান্ধা করছেন তা সবাই জানে।
ওদের কথা শুনে রাগে ফেটে পড়েন ভুবনবাবু --- গেট আউট। আই সে গেট আউট।
--- বেশি ইংরাজি মাড়িয়েন না ধরে কেলিয়ে দেব।
এবারে আর কথা বলতে পারে না ভুবনবাবু। যে কোন সুস্থ মানসিকতার মানুষই ওই জাতীয় কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। আর সেটাকেই হাতিয়ার করে একতরফা গলাবাজি করে চলে সুব্রতদের দল। চিৎকার শুনে সাধনা আর ছন্দা ছুটে আসে। তারা আসতে না আসতেই রাগে কাঁপতে কাঁপতে সেদিনের মতো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন ভুবনবাবু। আর তাদের দেখে ফের আর একপ্রস্ত শাসিয়ে দলবল নিয়ে চলে যায় সুব্রত। দু' চোখে অন্ধকার দেখেন সাধনা। মনো রয়েছে স্কুলে। কি করবেন কিছু ভেবে উঠতে পারেন না তিনি। ছন্দাকে বলেন , তাড়াতাড়ি এক বালতি ঠান্ডা জল নিয়ে আয় তো মা।তারপর ছন্দা জল নিয়ে আসতেই ডাক্তারকাকার মতো স্বামীর চোখে মুখে জলের ছিটে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ মেলে চান ভুবনবাবু। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে সাধনাদের। কিন্তু তারপর থেকেই ভুবনবাবুর বাড়ির বাইরে বেরোনোই এক রকম বন্ধ হয়ে যায়। কারণ তাকে দেখলেই সবাই বলতে শুরু করে --- কি মাস্টারমশাই টাকাগুলো সব মেরে খেলেন ? আপনাকে তো আমরা অন্যরকম ভাবতাম। কিন্তু আপনিও যে মুখোশধারী শয়তান তা ভাবতে পারি নি।
সাধনার বুঝতে অসুবিধা হয় না এসবের পিছনে রয়েছে সুব্রতদের হাত। পার্টি অফিস করতে টাকাটা দেওয়া হয় নি বলে শাসকদলের নেতারাও মদত যোগাচ্ছেন। চোখ ফেটে জল আসে সাধনার। এভাবে ওরা একটা নির্ভেজাল সৎ, ভালোমানুষকে চোর বানিয়ে দিল ? কেউ কিছু প্রতিবাদ পর্যন্ত করল না। কেউ এগিয়ে এসে বলল না , তোমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।মাস্টারমশাইয়ের মতো মানুষ কখনই টাকা আত্মসাৎ করতে পারেন না।আসলে বলবে কি করে ? তাহলে ধানের পালুই পুড়বে , মাছের পুকুরে বিষ পড়বে। তাই কারও কারও প্রতিবাদ স্পৃহা থাকলেও তা হজম করে নিতে হয়। প্রথম প্রথম প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছেন ভুবনবাবু। কিন্তু কার মুখে হাত দেবেন ? তাই বাড়ি থেকে বেরনোই বন্ধ করে দিয়েছেন। তার মনে যেন একটা হায় ঢুকে যায়। শরীর - মন দুই ভেঙে যায়। ডাক্তারকাকা তো বটেই রামপুরহাট , বর্ধমানের বড়ো বড়ো ডাক্তারেরাও তার রোগ ধরতে পারেন না। পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন ভুবনবাবু।

                                        ( ক্রমশ )

নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                      ----০----


No comments:

Post a Comment