Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৩৭




     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 












               কালের কারিগর
              

                              অর্ঘ্য ঘোষ           

                          (  কিস্তি --- ৩৭ ) 




তারমধ্যে স্ট্যান্ড ছেড়ে বেড়িয়ে আসে বাস। বাসে সারা রাস্তা প্রভাতদার কথা ভাবতে ভাবতেই আসে রুম্পা। পরীক্ষার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে তার। প্রভাতদার ডাব হাতে দাঁড়িয়ে থাকা, সেই ছেলে দুটোর হাত থেকে তাকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্যগুলো যেন ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর প্রভাতদার জন্য মনটা হুহু করে ওঠে তার। ভুবনবাবুরও সুধাদির কথা মনে পড়ে।সাথর্ক তার মাতৃস্নেহ।কবে স্বামীকে হারিয়েছেন , তবু ছেলেকে মানুষ করার জন্য সমানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে ছেলেরা সাধারণত বখে যায়।  পড়াশোনা বাদ দিয়ে নেশা ভাঙ করে , মেয়েদের পিছনে লাগে। নানা রকম অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু প্রভাতকে সে পথে যেতে দেন নি তিনি। বরং তার মধ্যে একটা প্রতিবাদী স্বত্ত্বার বীজ বপন করে দিয়েছেন।  নিজের জীবন তুচ্ছ করে রুম্পাকে বাঁচিয়ে সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে প্রভাত। প্রভাতের ওই ভূমিকাই হয়ে উঠতে পারে দুই পরিবারের যোগসূত্র। সেই যোগসূত্র ধরেই দুটি পরিবারকে এক সুতোয় বাঁধার চেষ্টা করবেন তিনি। সেইজন্যই তো ওদের একসঙ্গে পিকনিকে আসার আমন্ত্রন জানিয়ে এসেছেন। এখন দেখা যাক ভগবানের কি ইচ্ছা।মনোতোষ অবশ্য তখন ভেবে চলছে কেবল বাড়ির কথা।  অনেকদিন পর বাড়ি ফিরছে সে। তাই তার কেবলই মনে হচ্ছে কখন গিয়ে সে মায়ের মুখ , ছন্দার মুখ দেখবে। দেখতে দেখতেই গ্রামে ঢোকে তারা। বাড়ির চৌকাঠে পা রাখতে ছুটে আসেন সাধনা , পিছনে পিছনে আসে ছন্দাও। তার চলার ছন্দে কেমন যেন একটা লজ্জা লজ্জা ভাব। আড়চোখে একবার মনোদাকে দেখে নেয় সে। দেখতে পায় মনোদাও তারই দিকে চেয়ে আছে। তার মধ্যেই কাকীমা গিয়ে মনোদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে , কি রোগা হয়ে গিয়েছিস বাবা।হোস্টেলে ঠিক মতো খেতে টেতে দেয় না নাকি রে ? অনিয়ম করিস না তো ? 
ভুবনবাবু বলেন , নাও এই শুরু হয়ে গেল। যেন ওনার ছেলে একাই হোস্টেলে থাকে।
--- তুমি চুপ কর তো , পাঁচটা নয় দশটা নয় আমার তো মোটে একটাই ছেলে। কেমন থাকে না থাকে খোঁজ খবর নিতে হবে না ?
স্ত্রীর কথার সুত্র ধরে মজা করার খুব ইচ্ছে হয় ভুবনবাবুর। বলতে ইচ্ছে হয় , অঃ তোমার বুঝি ৫/১০ টা সন্তানের মা হওয়ার ইচ্ছে ছিল ? কিন্তু ছেলেমেয়ের সামনে মজা করার লোভ সামলাতে হয় তাকে। তাই বলেন, সে না হয় নিও , কিন্তু সবে বাড়িতে পা রেখেছে, সবাইকে একটু জল-টল দাও। তারপরে না হয় ছেলেকে নিয়ে পড়ো। 



                                      স্বামীর কথায় লজ্জা পান সাধনা , সত্যিই বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে। এতক্ষণ তার ওদের জল- সরবত দেওয়া উচিত ছিল। তার সেই ভুল সংশোধন করে দেয় ছন্দা। সে ততক্ষণে সরবত জল এগিয়ে দেয় হাতে হাতে। সেটা দেখেই স্বামীকে মুখ ঝামটা  দিয়ে সাধনা বলেন , তুমি ভাবলে কি করে তুমি বলবে তবে আমরা জলটল দেব। দেখলে তো আমাদের সবদিকে নজর আছে।
--- সে তো দেখতেই পাচ্ছি। নেহাত মেয়েটা ছিল বলে এত কথা বলতে পারছ। নাহলে তো চুপসে গিয়েছিলে।
--- আমি তো জানি মা আমার সব ব্যবস্থা করবে।
এক লহমায় হাসিঠাট্টায় ভরে ওঠে বাড়িটা। সেদিন আর রুম্পাকে দুপুরে না খেয়ে বাড়ি যেতে দেন না সাধনা। ঠিক হয় ওর বাবা নিতে এলে ভালো , নাহলে সান্ধ্য আসরের পর ছন্দা যখন বাবার সঙ্গে বাড়ি যাবে তখনই রুম্পাকে পৌঁচ্ছে দিয়ে আসবেন ভুবনবাবু। সেই মতো সাধনা রান্নার তোড়জোড় শুরু করেন। ছন্দা এবং রুম্পাও তাকে সাহার্য করে। দুপুরে সবাই একসঙ্গে খেতে বসে। খেতে খেতেই গল্প গুজবে মেতে উঠে সবাই। একথা সে কথার পর উঠে প্রভাতের সাহসিকতার প্রসঙ্গও।কথাটা শুনে সাধনাও প্রভাতের খুব প্রশংসা করেন।প্রভাতদার প্রশংসায় রুম্পার বুকটা ভরে ওঠে। কিন্তু সে  কিছু বলতে পারে না। একে স্যার রয়েছেন তার উপরে তাদের সম্পর্কের কথা কারও অজানা নয়।তাই একটা স্বাভাবিক লজ্জাবোধ তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু খাওয়ার পর তাকে নিয়ে পড়ে ছন্দা। তার বুকে হাত দিয়ে বলে , দেখি দেখি প্রভাতদার প্রশংসা শুনে  রুম্পাদির বুকটা কতখানি ফুলে উঠল দেখি।
--- যাঃ  তুই না। তুই বুঝি নিজের ধাত ধরে আমার চিকিৎসা করতে এসেছিস।
---- সে যাই বলো , ও যখন আমার সম্মান বাঁচাতে শয়তানটাকে শায়েস্তা করেছিল তখন আমার গর্ব হয়েছিল বৈকি।
---- তাই বুঝি ওর নাক সারাতে দিনরাত সেবা শুশ্রূষায় মেতে উঠেছিলি ? 
--- তা একরকম তাই-ই বলতে পারো। প্রিয়জনের সেবা করতে কার না ভালো লাগে ? তার উপরে সেই প্রিয়জন যদি আমারই জন্য আহত হয় ,  তাহলে তো নিজের সবটুকু দিয়ে সবসময় তার পাশে থাকতে ইচ্ছে হয়।
---- ঠিক বলেছিস। আমারও এসময় প্রভাতদার পাশে থাকার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল , কিন্তু আমার তো সেই উপায় নেই। 




                                     রুম্পাদির কষ্টটা উপলব্ধি করে ছন্দা।তাকে জড়িয়ে ধরে বলে ,  আক্ষেপ করো না রুম্পাদি। প্রভাতদাও তোমার যন্ত্রণা ঠিক বুঝবে।
মনোতোষও বলে , তুই ঠিকই বলেছিস।এই দুবছর প্রভাতদার সঙ্গে মিশে দেখেছি সত্যিই তার মতো অনুভূতি প্রবণ ছেলে কমই আছে।
মনোতোষ আর ছন্দার কথা শুনে প্রভাতদাকে ঘিরে রুম্পার বুকটা ফের গর্বে ভরে যায়। কাকুও তো সেদিন প্রভাতদার কত প্রশংসা করলেন।কিন্তু তার বাবা-মাই কেবল প্রভাতদার নাম সহ্য করতে পারে না।অথচ বাবা প্রভাতদাকে দেখেই নি। কেবল জয়ন্তমামাদের কাছে থেকে তাদের মেলামেশার কথা শুনেই বাবা-মায়ের এত রাগ। আসলে একসময় তো জয়ন্তমামাদের বাড়িতে প্রভাতদার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সেও মাঝে মধ্যে যেত। সেই সূত্রেই দু'জনের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। সেটাই জয়ন্তমামাদের কাছে চক্ষুশূল হয়ে ওঠে।তারপর থেকেই জয়ন্তমামাদের বাড়িতে প্রভাতদার যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়।আর তাদের মেলামেশার খরব পৌঁছোয় বাবা-মায়ের কানে।প্রভাতদারা নিচুজাত  আর আর্থিক অবস্থা ভালো নয় শুধু এইটুকু শুনেই বাবা বিশেষ করে মা কিছুতেই তাদের মেলামেশা মেনে নিতে পারে না।  রুম্পা মনে করে বাবা-মা ঠিক করেন না। পদবি কিম্বা আর্থিক স্বাচ্ছল্য কোন মানুষের গ্রহণ যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। মানুষের আচার-আচরণই তার অন্যতম পরিচয়। সুধামাসী আর প্রভাতদার মতো মানসিকতার মানুষ সে খুব কমই দেখেছে। অথচ মা বলেন , ওরা নাকি ছোটলোক।মা তো জানেই না , দু'জনের কি অমায়িক ব্যবহার আর মিষ্টি কথাবার্তা। রুম্পার ধারণা মা-বাবা ওদের সঙ্গে কথা বললে তাদেরও দুজনকে ভালো লেগে যাবে।সেই সম্ভাবনা তো একটা তৈরি হয়েছে। স্যার তো সুধামাসি , প্রভাতদাদের পাশাপাশি ভোম্বলকাকা , জয়ন্তমামা, মামী , সঞ্জয়দেরও আসতে বলেছেন। জয়ন্তমামারা এলে তারা বাবা-মাকে বাদ দিয়ে পিকনিকে যাবেন বলে মনে হয় না। তাহলেই তো বাবা-মায়ের সঙ্গে সুধামাসিদের আলাপ পরিচয় হয়ে যাবে। আর কথাবার্তা হলেই বাবা-মায়েরও তাদেরকে ভালো লেগে যাবে বলেই মনে হয় তার। মনে মনে রুম্পা সেই প্রার্থনাই করে। 



                                দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। ভুবনবাবুর সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা একে একে এসে হাজির হন। ছন্দার বাবার মতো মেয়েকে নিতে এসে সেদিনের  মজলিশে যোগ দেন রুম্পার বাবাও। সাধনা ছন্দাকে বলেন , যা তো মা সবাইকে তোর কাকুর আনা মিষ্টি দিয়ে আয়। আর বাড়ি যাওয়ার সময় তুই আর রুম্পা একটা করে প্যাকেট নিয়ে যাবি।
রুম্পা বলে -- সেকি স্যার এনেছেন , আর আমরা নিয়ে যাব কেন ? 
---- স্যারকে কি এতদিনে তোরা এই চিনলি ? তোদের স্যার যখন তিন প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে আসে তখনই তো তোদের বোঝা উচিত ছিল।
আর কোন কথা বলতে পারে না রুম্পা।সে'ও ছন্দার সঙ্গে গিয়ে হাতে হাতে মিষ্টি দিয়ে আসে , কিছুক্ষণ পরে চা'ও। ক্রমে জমে উঠে সান্ধ্য মজলিস।মজলিসে একথা - সে কথার পর ওঠে প্রভাতের প্রসঙ্গও। ভুবনবাবু রুম্পার বাবার প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য কিছুটা ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গটা তোলেন। শুনেই সবাই আঁতকে ওঠেন। রুম্পার বাবা বলেন , ভাবতেই পারছি না। সেই জন্যই তো মেয়েকে আর পড়াতে চাইছিলাম না। নেহাৎ আপনি বললেন তাই আর না করতে পারলাম না। যাক, শেষ ভালো যার সব ভালো তার।
ভুবনবাবু লক্ষ্য করেন রুম্পার বাবা প্রভাতের প্রতিবাদী ভূমিকার কোন প্রশংসা করেন না ঠিকই , কিন্তু কোন নেতিবাচক কথাও বলেন না। সেটাই আশান্বিত করে তোলে তাঁকে। এভাবেই হয়তো জমাট বেঁধে থাকা বরফ গলে জল হলেও হতে পারে বলেই তার মনে হয়। ভুবনবাবুকে চুপ করে থাকতে দেখে সুবলবাবু বলেন , মনে হচ্ছে জঙ্গলের রাজত্বে বাস করছি। শুনেই তো আতঙ্ক হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের এর পর আর কোন ভরসায় বাইরে পরীক্ষা দিতে পাঠাব ? সবক্ষেত্রে তো আর তোমার পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। ভুবনবাবুও উপলব্ধি করেন সুবলদের আশংকা অমূলক নয়। কিন্তু সে একবার তাদের কথায় সায় দিলে গ্রামের মেয়েগুলোর মাধ্যমিকের পর আর পড়া এগোবে না। তাই তিনি ভরসা যোগাতে বলেন , সে নিয়ে তোমরা চিন্তা কোর না। আমি যতদিন পারব , তোমাদের মেয়েদের নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
জবাবে সুবিনয় বলে , সেটা কোন কাজের কথা হলো না মাস্টার। তুমি একসঙ্গে ক'টা মেয়ের দায়িত্ব নেবে ? আমরাও যে কাজ কামাই করে বাইরে গিয়ে পড়ে থাকব সেও সম্ভন নয়।
---- তাহলে তোমরা কি চাও মাধ্যমিকের পর এ গ্রামের মেয়েরা লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দিক।
---- না, তাও আমরা চাই না। আমরা চাই স্থায়ী সমাধান।
---- কিসের স্থায়ী সমাধান ? 
---- আমাদের গ্রামের স্কুলটাকে তুমিই উদ্যোগ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক করার চেষ্টা করো। আমরা সবাই তোমার পিছনে আছি।
অন্যান্যরাও সমস্বরে সমর্থন জানান। ভুবনবাবুও ওই দাবির যৌক্তিকতা অস্বীকার করতে পারেন না। তাছাড়া তিনি নিজেও একবার ভেবেছিলেন অম্লানের কাছে বিষয়টি নিয়ে দরবার করবেন। ছন্দার এক্সটারনাল হিসাবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য তো তাকে বার কয়েক শিক্ষা দফতরে যেতেই হবে , তখনই তো বিষয়টি নিয়ে কথা বলে কিছু করা যায় কিনা তা দেখা যেতে পারে। তাই তিনি বলেন ,  সে চেষ্টা করা যেতেই পারে। এজন্য আশপাশের গ্রামের মানুষের সই সংগ্রহ করতে হবে।
সবাই বলে , সেটা কোন ব্যাপারই নয়। আমরা কাল থেকেই সাইকেলে করে পালা করে গ্রামে গ্রামে সই সংগ্রহ করতে নেমে পড়ব। তুমি কেবল দরখাস্তটা লিখে আমাদের দাও।
সেই মতো রাতেই দরখাস্ত লিখে সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের হাতে তুলে দেন ভুবনবাবু। তারপরই শুরু হয়ে যায় এক নতুন উন্মাদনা।

                                             
                           ( ক্রমশ )


 নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                     ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                      ----০----




No comments:

Post a Comment