( কিস্তি --- ৩৮)
তারপরই শুরু হয়ে যায় এক নতুন উন্মাদনা। উচ্চ মাধ্যমিকের অনুমোদনের জন্য ভুবনবাবু স্কুল থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে শুরু করেন। আর তাঁর সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা গ্রামে গ্রামে সই সংগ্রহের কাজে নেমে পড়েন।সই সংগ্রহের মাধ্যমেই তাদের দাবির সপক্ষে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। সেটা লক্ষ্য করেই শাসক বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েন। এতদিন কারও কোন মাথাব্যাথা ছিল না। কিন্তু যেই দেখেছে একটা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে অমনি নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব জাহিরের জন্য গায়ে পড়ে তাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা শুরু করে দিয়েছে। তাদের অভিপ্রায় বুঝতে অসুবিধা হয় না ভুবনবাবুর। যদি কোনও ভাবে তাদের দাবি পূরণ হয় তখন ওইসব নেতারাই সর্বাগ্রে তাদের কৃতিত্ব দাবি করবেন।সেটার জন্যই দরজা খোলা রাখতে ওই পথ নিয়েছেন নেতারা।সেটা আন্দাজ করেই প্রমাদ গোনেন ভুবনবাবু।বিষয়টাতে একবার রাজনৈতিক রঙ লেগে গেলে হওয়া কাজ আর হবে না।
শাসকদলের নেতারা ভালো কাজ করতে পারুন বা নাই পারুন পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে হওয়া কাজ আটকে দিতে ভালোই পারেন। আর নিচের তলার নেতাদের ছাড়পত্র না পেলে উপরতলাও উপুড় হাত করবে না। কথাটা তাকে অম্লানও বার বার করে বলে দিয়েছে। তাই সে স্কুলের শিক্ষক আর সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের নিয়ে ছুটে যায় শাসকদলের নেতাদের কাছে। তাদের দাবির বিষয়টি খুলে বলেন ওইসব নেতাদের কাছে।সব শুনে নেতারাও সহমত পোষণ করেন। তাদের দাবিপত্রে শীলমোহর সহ সই করে দেন। হাফ ছেড়ে বাঁচেন সবাই। ফেরার সময় নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করেন - এত সহজেই যে নেতাবাবুরা এক কথায় সই করে দেবেন তা ভাবতে পারি নি।
কেউ কেউ বলেন , দিয়েছে কি আর সাধে , ভোট আসছে যে। কথায় আছে না ' ভোট বড়ো বালাই।' দেখছে বেশি বেগোরবাই করলে যদি জনমত উল্টো দিকে ঘুরে যায় তখন ঠেলার নাম বাবাজী হয়ে যাবে। তাই সুবোধ বালকের মতো সই করে দিয়েছে।ভুবনবাবু মনে মনে ভাবেন এই বিষয়টাকে কাজে লাগাতে হবে। সে'ও শুনেছে চেষ্টা করলে ভোটের আগে অনেক না হওয়া কাজও নাকি হয়ে যায়। সেইমতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাই। সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের সঙ্গে ভুবনবাবুর কিছু সহকর্মীও আরও সই সংগ্রহের কাজে নেমে পড়েন।
আর কিছু সহকর্মীকে নিয়ে ভুবনবাবু প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন।প্রথমে নিজেদের স্কুলের পরিকাঠামো সহ শিক্ষক শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীর তালিকা তৈরি করেন। তারপর এলাকার মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলিতে পৌঁছোন। ওইসব স্কুলে প্রতিবছর কতজন ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক পাশ করে আর তারপর কতজন স্কুলছুট হয়ে যায় তারও তালিকা তৈরি করেন। স্কুলগুলির কাছে থেকে আলাদা আলাদা সুপারিশপত্রও নেওয়া হয়।সব দেখেশুনে সবাই বলতে শুরু করে এতদিনে একটা কাজের কাজ হচ্ছে বটে। আগে এভাবে তো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নিয়মমাফিক স্কুলের পক্ষ থেকে শিক্ষাদফতরে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েই কাজ সারা হয়েছিল। উপযুক্ত জায়গায় ধরা করা কিম্বা তদ্বিরের কোন উদ্যোগই নেওয়া হয় নি। এরফলে যা হওয়ার কথা তাইই হয়েছে। আর পাঁচটা চিঠির ভাঁজে তাদের স্কুলের চিঠিও চাপা পড়ে গিয়েছে শিক্ষাদফতরের টেবিলের নীচে।
ভুবনবাবুর সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা বলেন , মাষ্টার তুমি লাগলে কবেই আমাদের স্কুল উচ্চ মাধ্যমিক হয়ে যেত।
ভুবনবাবু বলেন , স্কুলে প্রধানশিক্ষক থাকা স্বত্ত্বেও আগ বাড়িয়ে আমার সেটা করতে যাওয়াটা ভালো দেখায় না।উনি ক্ষুন্ন হতে পারেন। নেহাৎ তোমরা ধরলে বলে আমি বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামালাম। কিন্তু সবকিছু আমি প্রধানশিক্ষককে নিয়েই করব।
জবাবে সুবিনয় বলেন , সে তুমি করতেই পারো। তবে কে ক্ষুন্ন হলো , না হলো তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যাথা নেই।আর এনিয়ে প্রধানশিক্ষকের তো মনোক্ষুন্ন হওয়ার কথা নয়। আসল কথা হল কাজ। কে করছে সেটা বড়ো কথা নয়। গ্রামের মানুষের উপকারে যার দ্বারা যে কাজ হবে তারই তো সেই কাজ করা উচিত। সবার দ্বারা সব কাজ হবে এমন কথাও নয়।
সুবিনয়ের যুক্তি সবাই সমর্থন করেন। সবাই একবাক্যে বলেন , তুমি তো নিজের জন্য কিছু করছো না। এলাকার মানুষের অসুবিধার কথা ভেবেই করছো। তাতে কে চটল আর ফুটল, তা নিয়ে অত ভেব না তো।
ভুবনবাবু বলেন , না-না কাউকে চটিয়ে কোন ভালো কাজ করা যায় না। হাজার হোক উনি আমার থেকে পদে এবং বয়সে দুদিক থেকেই বড়ো। তাই তাকে মান্যতা দিয়েই আমাকে সবকিছু করতে হবে।সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা বলেন, মাস্টার তুমি খুব উদার মনের মানুষ। বেশ তুমি যেটা ভালো বুঝবে করো। আমাদের দাবি কিন্তু পূরণ হওয়া চাই।
সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের কথায় কিছুটা চাপের মুখে পড়ে যান ভুবনবাবু।তাই বিষয়টিকে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নেন। সমস্ত ফাঁকফোকর মারার জন্য এলাকার জন প্রতিনিধি , প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছে থেকেও শংসাপত্র যোগাড় করেন। তাদের আরও ভালোভাবে জড়িয়ে নেওয়ার জন্য প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে স্কুলে পর পর বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন ভুবনবাবু।
সেইসব অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্রে শাসকদলের জনপ্রতিনিধি , প্রশাসনিক আধিকারকদের নাম অনুমতিক্রমে ছাপানো হয়। অনুষ্ঠানের মধ্যমণিও করা হয় তাদের। বিষয়টি তার অবশ্য খুব একটা মনোপুত হয় না। কেমন যেন তোয়াজ মারার মতো মনে হয়। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে তাকে বিষয়টি মেনে নিতেও হয়। তার সান্ধ্য আসরের বন্ধুরাও তাকে বোঝান , এতে তোমার মন খারাপ করার কিছু নেই। তুমি তো নিজের জন্য কাউকে তেল দিচ্ছো না। তুমি গ্রামের কথা ভেবেই সব করছো। কথায় আছে না , যেমন কলি তেমনি চলি। অনেকসময় অনিচ্ছা স্বত্ত্বে আমাদের কারও কাজের পায়ে পড়তে হয়।
বন্ধুদের কথায় ভুবনবাবুর মনে কিছুটা সান্ত্বনার প্রলেপ পড়ে। মনে মনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান। তাই বাকি নথিপত্র যোগাড়ের কাজে পুরোদ্যমে নেমে পড়েন। সমস্ত নথিপত্র যোগাড় করতে করতেই ছন্দার পরীক্ষার ফল বেরিয়ে যায়।দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে ছন্দা। ভুবনবাবুর কাছে সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। তাই দুই বাড়িতেই বয়ে যায় খুশীর হাওয়া। ভুবনবাবু মনে মনে ভাবেন ভালোই হলো। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। স্কুলের উচ্চ মাধ্যমিকের অনুমোদনের ব্যাপারে শিক্ষা দফতরে অম্লানের কাছে যেতেই হত , ওই সঙ্গে একবারে ছন্দার এক্সটারনাল হিসাবে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাটাও করা যাবে। তার আগে একবার ছন্দার বাবার সঙ্গে কথা বলে নেওয়া দরকার। ভুবনবাবু ভালো করেই জানেন মলয় তার ইচ্ছার বাইরে যাবে না। কিন্তু হাজার হোক সে মেয়ের বাবা। তাকে বড়ো করে বলাটা তারও একটা কর্তব্য। তারও একটা সম্মতির প্রয়োজন। তাই একদিন মলয়ের কাছে কথাটা পাড়েন তিনি। কথাটা শোনার পর মলয় বলে , এ ব্যাপারে আমি আর কি বলব ? আপনি যেটা ভালো বুঝবেন সেটাই করবেন। আমাকে বলারও দরকার ছিল না।
মলয় যে এমন কথা বলে তো জানতেনই ভুবনবাবু। তাই আর কথা বাড়ান না।প্রধানশিক্ষক ধীরেনবাবুকে নিয়ে শিক্ষা দফতরে যাওয়ার একটা দিন ঠিক করে ফেলেন তিনি। যাওয়ার আগের দিন মলয় তাকে কিছু টাকা দিতে আসে। টাকাটা যে ছন্দার ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়ে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। তাই ভ্রু কুঁচকে তাকান মলয়ের দিকে।সেই চাউনির সামনে কথা হারিয়ে তো-তো করতে থাকে মলয়। ভুবনবাবু বলেন , ছন্দা আমারও তো মেয়ে নাকি ?
---- না , মানে , আসলে মনোর পড়ার খরচ আছে আবার ছন্দার ভর্তির খরচ , আপনার চাপ হয়ে যাবে ভেবেই ----।
----- সে যেদিন চাপ হবে সেদিন দেখা যাবে। তোমরা তো আছোই। তখন নাহয় বলব তোমাদের।
মলয় আর কিছু বলার সাহস পায় না।নির্ধারিত দিনে প্রধান শিক্ষককে নিয়ে শিক্ষা দফতরে অম্লানের কাছে পৌঁচ্ছোন ভুবনবাবু।তাকে দেখেই আবেগে অফিসের মধ্যেই বুকে জড়িয়ে ধরেন অম্লান।তারপর তাদের নিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে বসে। সেখানেই তার হাতে স্কুল সংক্রান্ত কাগজপত্র তুলে দেন ভুবনবাবু। কাগজপত্র দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে অম্লান।
হাসিমুখে ভুবনবাবুকে বলেন , এ যে দেখছি সব আটঘাট মেরে এনেছিস। এবার মনে হচ্ছে হলেও কাজ হতে পারে। দেখছি কতদুর কি করতে পারি।
ভুবনবাবু বন্ধুর দুই হাত ধরে বলেন , সবই তো ভাই তোর পরামর্শ মতো হয়েছে। দেখছি নয় , যে করেই হোক তোকে এই কাজটা করে দিতেই হবে। এলাকার মানুষ বড়ো আশা করে রয়েছেন। মেয়েগুলো মাধ্যমিকের পর আর এগোতে পারছে না। তারাও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে।
অম্লানবাবুও বন্ধুর হাত জড়িয়ে বলেন , আমি যথা সাধ্য চেষ্টা করব। বুঝিসই তো সব আমার হাতে নেই। তবে সামনে ভোট আসছে , মনে হয় কাজটা হয়ে যাবে।
চা-টা খেয়ে বিদায় নেওয়ার আগে ছন্দার কাগজপত্রগুলোও অম্লানের হাতে জমা দেন ভুবনবাবু। সেগুলো দেখে অম্লানবাবু বলেন , মনে হয় এবারে আর এক্সটারনাল হিসাবে ছন্দাকে পরীক্ষা দিতে হবে না। হলে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই তোদের স্কুল উচ্চমাধ্যমিকের অনুমোদন পেয়ে যাবে। তবুও কাগজপত্র গুলো থাক আমার কাছে , নাহলে সময়মতো ব্যবস্থা করা যাবে। দেখ কতদুর কি হয়।সেই মতো ভুবনবাবুদের দিন গোনার পালা শুরু হয়।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment