Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৩৯



                                     


     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 












              কালের কারিগর
              

                            অর্ঘ্য ঘোষ  

                       (  কিস্তি -- ৩৯ )



সেইমতো ভুবনবাবুদের দিন গোনার পালা শুরু হয়। খুব বেশিদিন অবশ্য অপেক্ষা করতে হয় না তাদের। শিক্ষা দফতর থেকে ফেরার কয়েকদিন পরেই এসে পৌছোয় স্কুল পরিদর্শনের চিঠি। সেই খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই এলাকায় বয়ে যায় খুশীর হাওয়া। সবাই ধরেই নেন স্কুলের উচ্চ মাধ্যমিকের অনুমোদন যেন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তাই স্কুল পরিদর্শনের দিন স্কুলে উপচে  পড়ে ভীড়। আসেন শাসকদলের নেতারাও। সবকিছু দেখে শুনে সন্তোষ প্রকাশ করেন পরিদর্শক দলের সদস্যরা। তাদের সামনেই উপস্থিত জনতা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শ্লোগান দিয়ে ওঠেন - উচ্চস্তরের অনুমোদন চাই / নাহলে এবারে আর ভোট নাই।
শাসকদলের নেতা আর পরিদর্শক দলের সামনে এহেন স্লোগানে অস্বস্তিতে পড়েন ভুবনবাবুরা।হিতে বিপরীত হবে কিনা সেই দুশ্চিন্তায় পড়েন তারা।কিন্তু পরিদর্শক দল কিম্বা শাসকদলের নেতাদের চোখে মুখে বিরক্তির কোন ছাপ দেখা যায় না। বরং পরিদর্শক দলের এককর্তা বলেন , আপনাদের দাবির সঙ্গে আমরাও একমত। আমরাও মনে করি এই স্কুলের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের অনুমোদন একান্ত প্রয়োজন। সেই মর্মেই আমরা শিক্ষা দফতরের কাছে রিপোর্ট পাঠাব। তারপর দেখুন কতদুর কি হয়।
শাসকদলের নেতারা বলেন , না-না দেখাদেখির কিছু নেই। এটা করতেই হবে। আমরা ক্ষমতায় রয়েছি , তাসত্ত্বেও কাজটা নাহলে ব্যর্থতার দায় যে আমাদের ঘাড়েও চাপবে।
পরিদর্শক দলের কর্তারা হাসতে  হাসতে বলেন , আপনারা উপরের মহলে একটু বলুন তাহলেই হবে।
---- সেতো আমরা বলবই।
তারপর থেকে আবার শুরু হয়ে যায় প্রতীক্ষার পালা। তারই মাঝে ছন্দাকে নিয়েও দোটানায় পড়েন ভুবনবাবু। উচ্চমাধ্যমিকের অনুমোদের নিশ্চয়তা নেই। তাই মেয়েটার ভর্তির ব্যাপারে কি করবেন তা নিয়েই তার অস্থিরতা দেখা দেয়।এবারেও বেশিদিন অবশ্য তাকে সেই দুশ্চিন্তা ভোগ করতে হয় না।কয়েকদিনের মধ্যেই স্কুলে এসে পৌঁচ্ছে যায় উচ্চ মাধ্যমিকের অনুমোদনের চিঠি।সবাই ভুবনবাবুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন।তারা বলাবলি করতে থাকেন , ভুবনবাবু লেগেছিলেন বলেই কাজটা হলো।
লাগাতার  সবার সামনে নিজের প্রশংসা শুনতে শুনতে খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়েন ভুবনবাবু।অস্বস্তি এড়াতে তিনি বলেন , না-না আমি একা কিছু করি নি। সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম বলেই সুফল পেলাম।
কিন্তু কেউ তার কথা কানেই তোলেন না। অগত্যা ভুবনবাবুকে মেনে নিতে হয় খ্যাতির বিড়ম্বনা। তারই মধ্য একদিন মহা আড়ম্বরে আনুষ্ঠানিক ভাবে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের উদ্বোধন হয়। সেই অনুষ্ঠানে মাইক্রোফোন কাঁপিয়ে উপস্থিত জনপ্রতিনিধি , শাসকদলের নেতা , প্রশাসনিক আধিকারিকরা যথারীতি লম্বা-চওড়া ভাষণের পাশাপাশি নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে ছাড়েন না। আর দর্শক আসনে বসে ভুবনবাবু মনে মনে আউড়ান -- " রথ ভাবে আমি দেব,
পথ ভাবে আমি।মুর্তি ভাবে আমি দেব  হাসেন অর্ন্তযামী। "




          কেউ জানুক আর না'ই জানুক তিনি তো জানেন এই কর্মকাণ্ডের আসল হোতা অম্লান।তিনি  শিক্ষা দফতরে খোঁচা না মারলে অত সহজে যে উচ্চ মাধ্যমিকের অনুমোদন মিলত না তা তিনি ভালো করেই জানেন। এই অনুষ্ঠানে অম্লানকেও আসতে বলেছিলেন ভুবনবাবু। কিন্তুকাজের চাপের জন্য সে আসতে পারে নি।পরে একদিন আসবে বলেছে।ভুবনবাবু ঠিক করেছেন তাকে তাদের পিকনিকের দিন আসতে বলবেন। সেদিন প্রভাতরাওথাকবে। ততদিনে  বি,এ পড়া সম্পূর্ণ হয়ে যাবে প্রভাতের। নিজের জন্য তো কারও কাছেকোনদিন কিছু চান নি , চাইতে পারবেনও না।অম্লানকে তিনি প্রভাতের একটা কাজেরজন্য ধরবেন। তাহলে তিনি মনে মনে যা ভেবে রেখেছেন সেটা করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।অনুষ্ঠান শেষে সেদিন শুরু হয়ে যায় ভর্তি প্রক্রিয়া। ভুবনবাবুও ছন্দাকে সেদিনই ভর্তি করে দেন। প্রথমদিনেই পঞ্চাশ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়। তার মধ্যে পনেরো জনইমেয়ে। এই স্কুলে এবার উচ্চ মাধ্যমিক চালু না হলে ওইসব মেয়েদের অধিকাংশইলেখাপড়া ছেড়ে দিত।অভিভাবকদের কথা থেকেই সেই ইঙ্গিত মেলে। মেয়েদের ভর্তি করার পর বেশিরভাগঅভিভাবকই বলেন , দারুন একটা কাজ এতদিনে আপনারা করলেন মাস্টার মশাই। ইচ্ছে স্বত্ত্বেও মেয়েগুলোকে আমরা পড়াতে পারছিলাম না। এবারে সেই সমস্যাটা ঘুচল।



উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ভর্তির রেশ কাটতে না কাটতেই বের হয় উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট।মনোতোষ ভালো নম্বর নিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। সামান্য কিছু নম্বরের জন্যএবারে মেধা তালিকায় ঠাঁই হয়নি তার। তাই রেজাল্টের খবরটা পাওয়ার পর থেকেই কিছুটামুষড়ে পড়ে সে। ভুবনবাবু তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন , সব পরীক্ষাতেই যে মনোমত রেজাল্ট হতেই হবে তার কোন মানে নেই। আর তা নিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকাটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং পরের লড়াইয়ে এই ঘাটতি পূরণের জন্য মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
---- কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কোথাও কিছু গন্ডগোল হয়েছে। গণিত  আর পদার্থ বিদ্যায় আমার আরও নম্বর পাওয়ার কথা।
---- তুই নিশ্চিত ?
মনোতোষ দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘাড় নাড়ে। ভুবনবাবুরও মনে পড়ে যায় পরীক্ষার পর তিনিও ওইসব বিষয়ে প্রশ্নপত্র মিলিয়ে যে নম্বর আশা করেছিলেন তা ওঠে নি। সেই হিসাবে দুটি বিষয়ে মনো তিরিশ নন্বর কম পেয়েছে। তার মধ্যে যদি দশ নম্বরও পায় তাহলে সে মেধা তালিকার সপ্তম স্থানে চলে যাবে। তাই আরও একবার ছেলেকে নিয়ে প্রশ্নপত্র মিলিয়ে দেখেন তিনি। তারপর তিনিও নিশ্চিত হয়ে যান কোথাও ভুলচুক একটা কিছু হয়েছে।শেষপর্যন্ত ' রিভিউ ' করার আবেদন জানানো হয়। রিভিউয়ের পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এসে পৌঁছোয় নতুন মার্কশিট।তাতে দেখা যায় মনোতোষের দাবিই ঠিক।দুটি বিষয়ে তার নম্বর বেড়ে কুড়ি হয়েছে। আর এক ধাক্কায় সে মেধা তালিকার পঞ্চম স্থান দখল করে নিয়েছে। কিন্তু সেই খবর সবার অজানাই থেকে যায়। কারণ ততদিনে প্রচারের সব আলো শুষে নিয়েছে প্রথম প্রকাশিত মেধা তালিকায় ঠাই পাওয়া ছেলেমেয়েরা। ভুবনবাবু ভাবেন , এই তো প্রথম নয়। বছরের পর বছর ধরে একই ঘটনা ঘটে চলেছে।যার জেরে বহু ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছে আত্মঘাতী ছাত্রছাত্রীরা আরও বেশি নম্বর পেয়েছে। অথচ কারও টনক নড়ে না। যাদের ভুলে এমনটা ঘটে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে ভুবনবাবুর জানা নেই। নানান বাধ্যবাধকতার কারণে সরকার ব্যবস্থা নাই নিক , কিন্তু যাদের ভুলে এমনটা হয় তাদেরই তো উচিত দায় স্বীকার করে সরে যাওয়া। অথবা আরও যত্নবান হওয়া উচিত।এতো মুদিখানার দোকানে অচল নোট চালানোর ব্যাপার নয় , ধরা না পড়লে ভালো , ধরা পড়লে পাল্টে দিলেই হোল। এটা তো ছেলেমেয়েদের ভবিষতের ব্যাপার , জীবন মরণের প্রশ্ন। ভুল করলে প্রকাশ্যে যদি তার দায়ই স্বীকার করতে না পারব তাহলে কিসের আমরা মানুষ গড়ার কারিগর ?



                              এক টানা নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে ওঠেন ভুবনবাবু। অনুভুতিশীল মানুষ মাত্রেই বিষয়টি নিয়ে ভাবলেই রক্তাক্ত হবেন। তাও মন্দের ভালোরিভিউ করার সুযোগটা রয়েছে। না হলে তো গলদের কথাটা জানাই যেত না। আর তাতে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আরও বেড়ে যেত। যত ভাবেন ততই ক্লান্ত হয়ে পড়েন ভুবনবাবু। তাই ওইসব ভাবনা দূরে সরিয়ে ছেলের পরবর্তী পড়াশোনা নিয়ে ঘনিষ্ঠজনেদের সঙ্গে আলোচনা করেন। সবাই মনোকে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়ার ব্যাপারেই সওয়াল করেন। মনো এবং তারও মত এক। অনেকে অবশ্য রামরতনের  মতোই মনোকে ডাক্তারি কিম্বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারাও কেউ কেউ মনোকে জামাই করার অভিপ্রায়ে পড়ানোর সমস্ত দায়িত্বও নিতে চেয়েছিলেন। ভুবনবাবু সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবুও হাল ছাড়েন নি তারা। উপযাচক হয়ে বলছেন , ছেলের এমন ব্রাইট রেজাল্ট। নিজের বস্তাপচা সেন্টিমেন্টের জন্য জলাঞ্জলি দিয়ে দেবে ?
ভুবনবাবু তাদের কথা কানেই তোলেন নি। তিনি চান মনো একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে ঊঠুক।আজকের দিনে আদর্শ শিক্ষকের যে বড়ো অভাব।ছেলেমেয়ে মানুষ করার দোহাই দিয়ে বেশিরভাগ শিক্ষকই শহরে ভীড় জমাচ্ছেন। ছেলেমেয়ে মানুষ করার কথা একটা বাহানা মাত্র।আসলে চুটিয়ে টিউশানির ব্যবসা করার জন্য সব শহরে ছুটছেন।আর যে গ্রামের স্কুলে তারা শিক্ষকতা করেন সেইসব স্কুলের ছেলেমেয়েদের তাদেরই কাছে কুড়ি - তিরিশ কিলোমিটার দুরের শহরে গিয়ে পড়ে আসতে হচ্ছে।যাওয়া আসাতেই   অনেকখানি সময় নষ্ট হয়েযাচ্ছে। তাহলে ছেলেমেয়েরা পড়বে কখন ? কিন্তু কে আর সেই সমস্যার কথা ভাবে ? সরকার আইন করেও ডাক্তারদের প্রাইভেট প্রাকটিসের মতোই শিক্ষকদের টিউশানি বন্ধ করতে পারে নি। পারবে কি করে ? সরষের মধ্যেই যে ভুতের বাস। ডাক্তার-  শিক্ষকেরা এখন শাসক দলের ইউনিয়নে নাম লিখিয়েছেন। তাছাড়া আইন করেও সবকিছুর সমাধান হয় না , তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা। সেই সদিচ্ছা কোথায় এখন ? একশো  কিমি দূর থেকে যাতায়াত করে অনেকে শিক্ষকতা করেন। ভুবনবাবু ভেবে পান না , কি করে প্রতিদিন ওইভাবে যাতায়াতের ধকল সহ্য করার পর পড়ানোর মানসিকতা থাকে ! কখনই বা নিজেরা পড়ার সময় পান।ভালো পড়াতে গেলে যে নিজেদেরও পড়তে হয়।কিন্তু এখন কেই বা আর সেসব নিয়ে মাথা ঘামান ?  এখন তো বেশিরভাগ শিক্ষকের মাথায় দিন রাত ঘুর ঘুর করে পি,এফ ,গ্রাচুইটি, ডি,এ, বেতন কমিশন।অথচ একসময় তো এই অবক্ষয় ছিল না।ছেলেমেয়ে মানুষ করার জন্য শিক্ষকদের শহরে ছুটতে হয়নি।বহু ব্রিলিযান্ট ছাত্রছাত্র এমন কি আজ যেসব শিক্ষক শহরে ছুটছেন তারাও গ্রামেরই গাছতলার স্কুলে পড়েই মানুষ হয়েছেন।কারণ পরিকাঠামো নয় ,সেই সময় মুখ্য ব্যাপার ছিল শিক্ষকদের নীতি আর আদর্শবোধ।চূড়ান্ত অভাবের মধ্যে শিক্ষাটাকে তখনকার শিক্ষকেরা পণ্য করেন নি।তখন বিদ্যাছিল যথার্থ অর্থেই দান। ভুবনবাবুর আজও মনে আছে , সেইসময় ছেলেমেয়েদের ভাল রেজাল্টের জন্য মাস্টারমশাইরা বিনা পয়সায় মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষার পর কোচিং ক্লাস করাতেন। কেউ কেউ আবার সারাবছরই ছাত্রছাত্রীদের জন্য ছিলেন নিবেদিত প্রান। টাকা পয়সার তোয়াক্কাই করতেন না। গ্রামের মানুষ ভালোবেসে খেতের আলুটা - মুলোটা, আখের গুড় তাদের না দিয়ে খেতেন না। একটা সৌহার্দ্য ছিল ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকের পরিবারে মধ্যে। অনেক মাস্টারমশাই তখন শখের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। ছাত্রছাত্রী তো বটেই তাদের বাবা মায়েরও অসুস্থতার খবর পেলেই ওষুধের বাক্স নিয়ে তাদের বাড়িতে ছুটতেন। সেই সবদিনগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার নয় , মনোকে তিনি সেই হারানো দিনের কারিগর হিসাবে দেখতে চান।

                             ( ক্রমশ )

 নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                      ----০----

No comments:

Post a Comment