( কিস্তি -- ৪০ )
ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নয় , মনোকে তিনি সেই হারানো দিনের কারিগর হিসাবে দেখতে চান।সেই মতো একদিন মনোকে ভর্তি করার জন্য রামপুরহাট কলেজে যান।ফেরার পথে সুধাদির বাড়িতেও যান।ভেবেছিলেন দেখা করেই ফিরে আসবেন। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয় না। সুধাদি তাকে কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়বেন না। তাছাড়া তার আসার খবর পেয়ে হাজির হন রুম্পাদের আত্মীয় জয়ন্তবাবু আর তাদের প্রতিবেশী ভোম্বলবাবু। তাদের সঙ্গে গল্প করতে করতেই ভুবনবাবু প্রভাতকে কলেজ থেকে হাসি মুখে বাড়ি ফিরতে দেখেন।তাকে খুব উৎফুল্ল দেখায়।ভুবনবাবু যখন কলেজে গিয়েছিলেন তখন হয়তো সে রাস্তায় ছিল। তাই দেখা হয় নি। এখন দেখা হতেই ভুবনবাবুকে প্রণাম করে প্রভাত। একই সঙ্গে জয়ন্তবাবুদেরও প্রনাম করে সে। তার পরেই সে রান্নাঘরে গিয়ে মাকেও প্রণাম করে।
ছেলেকে হঠাৎ প্রণাম করেতে দেখে যেন আশ্চর্য হন সুধাদেবী। আশ্চর্য হন ভুবনবাবুও।এমনিতে কোথাও যাওয়া আসা , কোন শুভকাজে বেরনোর আগে কিম্বা অনাত্মীয় অন্য কাউকে প্রণাম করার সময় সেখানে বাবা-মা থাকলে তাদেরই আগে প্রণাম করার কথা। সেই হিসাবে ভুবনবাবুকে প্রণাম করার সময় সেখানে হাজির থাকার কারণে জয়ন্তবাবুদেরও প্রভাত প্রণাম করতেই পারে। কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে মাকেও প্রণাম করাটা ভুবনবাবুকে কৌতুহলী করে তোলে। পরক্ষণেই তার মনে হয় , এতে অস্বাভাবিকতাও তো কিছু নেই। প্রভাতের মতো মাতৃভক্ত ছেলের মাকে প্রণাম করাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সুধাদির কথায় ফের তার কৌতুহলটা বেড়ে যায়। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আর্শিবাদ করতে করতে তিনি বলেন , কি ব্যাপার রে আজ এত প্রণামের ঘটা ? এই তো একটু আগে অন্যদিনের মতো প্রণাম করে বের হলি। ফিরেই আবার প্রণাম কেন ?
মায়ের কথা শেষ হয় না। প্রভাত তাকে দুহাতে তুলে ধরে পাক কতক ঘুরে নেয়। তারপর নামিয়ে দিয়ে বলে , মা আজ আমাদের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে পাশ করেছি।
--- এত বড়ো একটা সুখবর আগে বলবি তো।
--- কি করে জানব ? কয়েকদিন থেকেই শুনছিলাম আজ বেরোবে - কাল বেরোবে। আজ কলেজে গিয়ে শুনি রেজাল্ট বের হয়েছে। সেটা শুনেই তো সোজা তোমার কাছে।
ভুবনবাবু গল্প করতে করতেই দেখতে পান সুধাদি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দেওয়ালে ঝোলানো স্বামীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখের জল মুছছেন। তারপর প্লেটে মিস্টি নিয়ে ছেলের মুখে একটা দিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। তাদের সামনে মিস্টির প্লেটটা নামিয়ে রেখে বলেন , নাও ভাই সবাই একটু মিস্টিমুখ করো। ভুবনবাবু মিস্টিমুখের উপলক্ষ্যটা বুঝতে পারলেও জয়ন্তবাবুদের বিষয়টা ঠিক বোধগম্য হয় না।কারণ আসার পরই একবার মিস্টিজল খাইয়েছেন সুধাদি। তাই জয়ন্তবাবুরা বলেন , কি ব্যাপার বৌদি এসেই একবার তো মিস্টিমুখ হয়েছে , আবার কেন ?
--- ভাই আজ আমার বড়ো আনন্দের দিন। তোমাদের আর্শিবাদে প্রভাত আমার ভালোভাবে পাশ করেছে।
--- তাহলে তো শুধু মিস্টিতে হবে না বৌদি। কবজি ডুবিয়ে মাংসভাত খাওয়াতে হবে।
---- নিশ্চয় ভাই। আজ ওর বাবা বেঁচে থাকলে তিনিইতোমাদেরকে বলতেন।তোমাদের নিজে মুখে বলতে হত না ভাই। আজ তো উনিই সব থেকে খুশী হতেন। ছেলেকে মানুষ করার জন্য দিনরাত এক করে খাটতেন। সেই ছেলে আজ মানুষ হল।কিন্তু উনিই দেখে যেতে পারলেন না।এখন ছেলেটার একটা গতি লাগলে বিয়ে-থা দিয়ে মনে একটু শান্তি পাই।
বলতে বলতেই চোখ ভিজিয়ে ফেলেন সুধাদেবী। সেটা লক্ষ্য করে ভুবনবাবু বলেন , উনি উপর থেকেই সব দেখতে পাচ্ছেন। প্রভাতকে আর্শিবাদও করছেন। ওনার অভাব তো পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু তাই বলে আমরা থাকতে এতবড়ো একটা সুখবরের পরে ভালো খাওয়া দাওয়া হবে না তাই কখনও হয় ? আমি তো ওর কাকা নাকি ? সেই দায়িত্বটা না হয় আমিই নিলাম। চাকরি বাকরি কিম্বা বিয়ে-থা নিয়েও তোমাকে কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
ভুবনবাবুর গলায় গলা মিলিয়ে জয়ন্তবাবুরাও বলেন , হ্যা- হ্যা আমরাও তো ওর কাকা। এর আগে এই পাড়ায় এত ভালো রেজাল্ট কেউ করে নি। সেই উপলক্ষ্যে আমাদেরও কিছু করণীয় আছে। আমরাই আজ খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করব।সুধাদেবী ইতস্তত করে কিছু বলতে যান। কিন্তু কেউ আর তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বাজার করতে বেরিয়ে পড়েন।অগত্যা ছেলেকে মনোকে নিয়ে আসার জন্য আবার কলেজ হোস্টেল পাঠিয়ে রান্নাবান্নার
যোগাড়পাতি করতে শুরু করেন সুধাদেবী।সেদিন আর ভুবনবাবুর ফেরা হয় না। খাওয়া দাওয়া উপলক্ষ্যে বাড়ির পরিবেশটাই সেদিন পাল্টে যায়। অনেক রাত্রি পর্যন্ত গল্পগুজবেই কেটে যায়। সুধাদির রান্নার পাশাপাশি প্রভাতেরও খুব সুখ্যাতি করেন জয়ন্তবাবুরা।ভুবনবাবু একটা পথের রেখা দেখতে পান। সেই পথ ধরেই জয়ন্তবাবুদের দিয়ে তিনি প্রভাত সম্পর্কে রুম্পার বাবা-মায়ের নেতিবাচক মনোভাব দুর করতে চান। সেটা আরও সহায়ক হয় ভোম্বলবাবুর কথাতে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন , এবারে তো প্রভাতের দুঃখের দিন ঘুচতে চলল। ও যা রেজাল্ট করেছে তাতে চাকরি পাওয়াটা সময়ের অপেক্ষামাত্র। তারপর দরজার সামনে মেয়ের বাবাদের লাইন পড়ে যাবে। কেউ আর খড়ের চালের বাড়িও দেখবে না , জাতপাত নিয়েও মাথা ঘামাবে না।
ভুবনবাবু মনে মনে ভাবেন , ভোম্বলবাবু ঠিক কথাই বলেছেন। এখন তো বিয়ের বাজারে সরকারি চাকরিওয়ালা ছেলেরাই ' হট - কেকে'র মতো বিক্রি হয়। তখন সেই কেক কোন বেকারির তৈরি , টাটকা না পচা তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তাই তার কথায় সায় দিয়ে ভুবনবাবু বলেন , প্রভাতের একটা চাকরির জন্য ভেবেছিলাম আমার এক বন্ধু বলব। কিন্তু এখন দেখছি আর বলার দরকার হবে না।নিজের যোগ্যতাতেই চাকরি পেয়ে যাবে। তখন আর হয়তো আমাদের তার বিয়ের জন্য পাত্রীও খুঁজে বেড়াতে হবে না।
ভোম্বলবাবু সায় দিয়ে বলেন , খুঁজে বেড়াতে হবে কি বলেছেন দাদা , এই বাড়ির সামনে তখন লম্বা লাইন পড়ে যাবে।
তার কথার পিঠে ভুবনবাবু বলেন , লাইন পড়ে যাবে ঠিকই , কিন্তু আগে থেকেই যে সেই লাইনের সামনে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে সরিয়ে যে অন্য কাউকে প্রভাতের বৌ করে ঘরে তোলা সম্ভব নয়।
---- তার মানে ? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন ভোম্বলবাবু।
---- যদি কথাটা আমাদের তিনজনের মধ্যে থাকে তাহলে বলতে পারি।
---- নিশ্চয় , নিশ্চয় , বলে ওঠেন ভোম্বলবাবুরা।
রুম্পা আর প্রভাতের সম্পর্কের কথাটা বলতে গিয়ে কিছুটা ইতস্তত করেন ভুবনবাবু। হিতে বিপরীত হবে কিনা সেই আশংকায় বলতে গিয়েও থমকে যান তিনি। পরক্ষণেই ভাবেন এছাড়া তো কিছু উপায়ও নেই। জয়ন্তবাবুকে দিয়েই তাকে প্রভাত সম্পর্কে রুম্পার বাবা- মায়ের বিরাগ মনোভাবটা কাটাতে হবে। আজই সেই ক্ষেত্রও তৈরি হয়ে গিয়েছে। গল্পে গল্পে জয়ন্তবাবুরা তার অনেকটাই কাছে চলে এসেছেন। সেই ভরসাতেই তিনি বলেন , আপনারা জানেন কিনা জানি না, কিন্তু আমি যতদুর জানি তাতে মনে হয় রুম্পা এবং প্রভাত দুজন দুজনকে ভালোবাসে। ওদের দুজনকে মিলিয়ে দিলে কেমন হয় ?
---- এর মতো ভালো আর হয় নাকি ? ঘরের ছেলে-মেয়েদুটি ঘরেই থাকে যাবে তাহলে। দু'জনকে মিলিয়ে দিতে আটকাচ্ছে কোথায় ? বৌদির কি মত হচ্ছে না ? একটানা কথাগুলো বলেন ভোম্বলবাবু।
---- না না, সুধাদির অমত হবে বলে মনে হয় না। রুম্পার বাবা-মায়েরই প্রভাতকে পচ্ছন্দ নয়। এখন জয়ন্তবাবুই ভরসা , একমাত্র উনিই পারেন রুম্পার বাবা মাকে রাজী করাতে।
তারপর জয়ন্তবাবুর হাত দুটো ধরে ভুবনবাবু বলেন , যে করেই হোক আপনাকে এই কাজটা করতেই হবে।
খুব অস্বস্তিতে পড়ে যান জয়ন্তবাবু। তিনিও ভুবনবাবুর হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, ছি ছি এইভাবে বলবেন না। এই ঘটনায় রুম্পার বাবা-মায়ের খুব একটা দোষ নেই। আমাদের বাড়ি যাওয়া আসা করতে করতেই তো ওদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। নিচু জাতি এবং অভাবী সংসার বলে আমরাই ওদের কান ভারী করেছিলাম। কিন্তু এখন আমাদের সেই ভুল ভেঙেছে। যে ছেলে নিজের জীবন বিপন্ন করে ভালোবাসার জনকে বাঁচায় তার যোগ্যতা জাত কিম্বা আর্থিক সঙ্গতির মাপকাঠিতে মাপা যায় না।তাই আপনাকে কথা দিচ্ছি যে করেই হোক রুম্পার বাবা-মাকে রাজী করানোর চেষ্টা করব। আর সেটা পিকনিকে গিয়েই করতে পারব বলে মনে হয়।
কথাটা শুনে যেন একটা পাষাণভার নেমে যায় ভুবনবাবুর বুক থেকে। আরও কিছুক্ষণ টুকটাক গল্পের পর পান চিবুতে চিবুতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন জয়ন্তবাবুরা। আর বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভুবনবাবু ভাবতে থাকেন রুম্পাকে ঘিরে তাঁর ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা। কারণ রুম্পার বিষয়টিই তার কাছে এখন একমাত্র ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতদিন আঠারো বছর বয়েস পূর্ণ না হওয়ার কথা বলে তার বিয়েটা আটকে রাখতে পেরেছিলেন ভুবনবাবু। সেইজন্য পড়াশোনাও চালু ছিল। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুম্পার আঠারো বছর বয়েস পূর্ণও হয়ে গিয়েছে। তাই আর রুম্পাকে পড়তে দিতে চান নি ওর বাবা - মা। পরিবর্তে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। যেন মেয়েদের বিয়েটাই একমাত্র লক্ষ্য। কোনরকমে একবার কারও গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারলেই অপার শান্তি।
এই মানসিকতা শুধু রুম্পার বাবা-মায়েরই নয় , অধিকাংশ মেয়ের বাবা- মা'ই একই মানসিকতার শিকার। লেখাপড়া ছাড়িয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অদ্ভুত সব যুক্তি খাডা করেন তারা।কারও মতে মেয়েদের বেশি লেখাপড়া শেখালে নাকি যোগ্য পাত্র জুটবে না। শিক্ষিতা মেয়েদের সংসার করার মানসিকতা থাকে না। মেয়ের বিয়ে দিতে দেরি করলে তারা নাকি বংশের মুখে চুনকালি লেপে দেয়। তাই বাবা-মায়েদের বলতে শোনা যায় , মেয়ের বিয়ে বলে কথা , ভাল পাত্র পেলাম বলে আর হাতছাড়া করলাম না। বিয়েটা লাগিয়ে দিলাম। রুম্পার বাবা-মা তাও তো আইনের কথা ভেবে এতদিন বিয়েটা দেন নি। কিন্তু অনেক বাবা - আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আঠারো বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।কিন্তু এবার রুম্পার বাবা-মাকে কি করে ঠেকিয়ে রাখবেন তিনি ? কিন্তু যে করেই হোক রাখতে তো হবেই। মনে মনে জাতের নামে বজ্জাতি ঘোচানোর প্রতিজ্ঞা করেছেন তিনি। তাই পরদিন সকালেও সেই রুম্পার চিন্তা নিয়েই বাড়ি ফেরেন তিনি। আর বাড়ি ফিরেও সেই রুম্পার কথা শুনেই চিন্তায় পড়ে যান।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment