Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৬২


     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











              কালের কারিগর
              


                          অর্ঘ্য ঘোষ


                              ( কিস্তি --- ৬২ ) 

ভোর হতে না হতেই তার ঘুম ছুটে যায়। অন্যান্য দিনের মতো অভ্যাস বশেই স্বামীর বুকে হাত রাখতে গিয়েই  টনক নড়ে যায় তার। সারা শরীর একেবারে বরফের মতো ঠান্ডা। বুকে কান লাগিয়েও কোন স্পন্দন শোনা যায় না। স্বামীর বুকের উপরে আছড়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠেন সাধনা। মায়ের কান্না শুনে পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে ছন্দা আর মনোতোষ। তাদের দেখে সাধনা কাঁদতে কাঁদতে বলেন , মনো তোর বাবার কোন সাড়া শব্দ নেই।তুই বাবা তাড়াতাড়ি একবার ডাক্তারকাকে ডেকে আন। মায়ের কথা শুনেই মনোতোষ উর্ধশ্বাসে সাইকেল নিয়ে  বেরিয়ে যায়। সাধনা আর ছন্দা কেঁদেই চলে। তাদের কান্না শুনে পাড়া প্রতিবেশীরা ভীড় জমান।খবর পেয়ে ছুটে আসেন খুঁকি আর ছন্দার বাবা মা , আসেন শান্তিলতা আর মাধবী, সান্ধ্য আসরের বন্ধুরাও আসেন। ছুটে আসেন স্কুলের সহকর্মীরাও। সেই সময় নজরে আসে টেবিলের উপরে  পড়ে রয়েছে ওষুধের কিছু খালি প্যাকেট। পাশেই পেন চাপা একটা কাগজ। কাল রাতে স্বামীর ঘুম ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় সাধনা আর আলো জ্বালেন নি। তাই ওগুলো নজরে আসে নি। খালি প্যাকেটগুলো দেখেই দেওয়ালে মাথা ঠুঁকতে শুরু করে দেন সাধনা। ছন্দা ছুটে গিয়ে তার মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে বলে , মা তুমি এমন করছ কেন ? তোমার ছেলে তো ডাক্তারদাদুকে ডাকতে গিয়েছে। উনি এলেই বাবা ভাল হয়ে যাবেন দেখো। 
---- ওরে তোর বাবা আর ভালো হবে না। উনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। ওই দেখ ডাক্তারকাকার দেওয়া ঘুমের ওষুধ গুলো সব খেয়ে নিয়েছেন।
ছন্দা টেবিলে পড়ে থাকা খালি ওষুধের প্যাকেট গুলো দেখে বলে ,  হ্যা হ্যা এই ওষুধ গুলো থেকেই তো একটা নিয়ে কাল আমি বাবাকে খাইয়ে ছিলাম। তখন বাবা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়ে ছিলেন কোনটা কিসের ওষুধ। একবারের জন্যও বাবাকে দেখে মনে হয় নি মনে মনে এত বড়ো একটা পরিকল্পনা নিয়ে বসে আছেন।
---- পরিকল্পনাই তো নিয়েছিলেন। নাহলে হঠাৎ করে একের পর এক গানে গলা মেলানো , একসঙ্গে খাওয়া দাওয়ার কথা বলতেন না। তখন কেন যে ব্যাপারটা তলিয়ে ভাবলাম না। এতদিন একসঙ্গে থেকেও মানুষটার মনের ভাব আমি বুঝতে পারলাম না। 
আক্ষেপ ঝড়ে পড়ে সাধনার গলায়।সেই সময় হাজির হন রাম আর কুনাল। তাদের দেখে শোক ভুলে অবাক হয়ে যান সাধনা।স্বামীর মুখেই শুনেছেন পিছন থেকে ওরাও তাকে চোর অপবাদ দিতে ছাড়ে নি।সেই হিসাবে স্বামীর আত্মহননের দায় কিছুটা হলেও তো ওদের উপরেও বর্তায়। তাই ওদের দেখে তীব্র ক্ষোভের জন্ম হয় সাধনার মনে।তার মনে হয় নিশ্চয় কোন অভিসন্ধি আছে ওদের। তার ধারণা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। সাধনার কথার রেশ ধরে রাম বলে , আপনিই বা ভাববেন কি করে ? এতদিন সংসার করেছন ,  কই কোন কিছু হয়েছে বলে তো শুনি নি।এই অপয়া মেয়েটা যেই বউ হয়ে ঘরে এল আর শ্বশুরকে আত্মহত্যা করতে হল। ওই তো খেল গো ভুবনকে। 




                           তাদের কথা শুনে কান্না থেমে যায় ছন্দার। কিছু বলতে পারে না সে।অপরাধীর মতো মুখ করে চেয়ে থাকে সাধনার দিকে। তারও যেন মনে হয় , সে সত্যিই বুঝি অপয়া। সাধনার অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হয় না সেই দিনের সেই রাগ মেটাতেই পরিকল্পিত ভাবে কথা গুলো বলেছে রাম। সে ভেবে পায় না একজন মৃত মানুষের উপর রাগ মেটাতে গিয়ে কি করে  একটা নিরপরাধ মেয়ের ঘাড়ে এভাবে দায় চাপাতে পারে। ওই পরিস্থিতিতেও বিবেচনা শক্তি হারান নি সাধনা। তাই তীব্র প্রতি আপত্তি জানিয়ে বলেন , খবরদার কেউ আমার ছন্দামাকে অপয়া বলবে না। মনোর বাবা ওকে মা লক্ষ্মী বলতেন। আমার দুর্ভাগ্য , ওকে ধরে রাখতে পারি নি।কথাটা মনোপুত হয় না ওদের। তাই যেমন এসেছিল তেমনই চলে যায়। সেই সময়  এসে পৌঁছোন ডাক্তারকাকা। ভুবনবাবুর হাত ধরেই বলে দেন অনেকক্ষণ আগেই সব শেষ হয়ে গিয়েছে।কথাটা শুনেই ঘন ঘন মুর্ছা যান সাধনা।জলের ছিটে দিয়ে তার চেতনা ফেরানো হয়।এক সময় আর কাঁদার ক্ষমতাটুকু ও  থাকে না তার। কখনও ভাবলেশহীন চোখে চেয়ে থাকেন স্বামীর মুখের দিকে। আবার কখনও বা পরম মমতায় স্বামীর কপালে বুকে হাত বুলিয়ে দেন। যেন ওই ভাবে স্বামীকে ঘুম পাড়াচ্ছেন। ছন্দা ভুবনবাবুর লেখা ' সুইসাইড নোট টা মনোতোষের হাতে তুলে দেয়। সেটা পড়তে পড়তে তার চোখের জ্বলে ঝাপসা হয়ে যায় অক্ষর গুলো। পুরোটা পড়তেও পারে না সে। ডাক্তারবাবু সেটা হাতে নিয়ে পড়েতে থাকেন ---
সাধনা , তোমাদের সঙ্গে ছলনা করে এভাবে চলে যাওয়া কথা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবি নি।তবু স্বার্থপরের মতোই চলে গেলাম। মতাদর্শ এবং নীতির সঙ্গে আপোষ করতে না পেরেই আমি এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হলাম। নীতি আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে বেঁচে থাকা তো মরার সামিল। আবার আমার নীতি  আদর্শ  আঁকড়ে থাকার জন্য তোমাদের হেনস্থাও আর আমি সইতে পারছিলাম না।সেই মানসিক টানা পোড়ানের জন্যই আত্মহনের পথ বেছে নিলাম। মনো , ছন্দাকে রেখে  গেলাম। পারলে তুমি ওদের আগলে রেখো। পরপার বলে যদি কিছু থাকে তাহলে সেখানে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তোমার মতো স্ত্রী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তোমরা সবাই ভালো থেকো। আর পারলে আমাকে ক্ষমা কোর। --     
                                                                                                            তোমার হতভাগ্য স্বামী
চিঠি পড়তে পড়তেই গলা বুজে আসে ডাক্তারবাবুর। তার চোখ ভিজে যায়। চিঠি পড়া শেষ হতেই সাধনা স্বামীর মুখটা ধরে কান্না ভেজা গলায় তিনি বলেন,  তোমার মতো স্বামী ভাগ্যের ব্যাপার। সাত জন্ম  তপস্যা  করলে তবেই তোমার মতো স্বামী পাওয়া যায়।তুমিই তো সুখ দুঃখ দুজনে ভাগ করে নেবার কথা বলেছিলে।কিন্তু দুঃখ যন্ত্রণা নিজে একাই ভোগ করলে।কই আমাকে তো তার ভাগ দিলে না।আমাকে কোন কষ্ট পেতে দেবে না বলেই বুঝি  ভাগ দিলে না ? কেন এই ছলনা করলে তুমি ? কেন খুলে আমাকে বললে না তোমার মনের তিতিক্ষার কথা। সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতাম। কেন আমাদের সেই সুযোগ দিলে না ?  
সাধনার বিলাপ প্রতিধ্বনিত হয়ে পরিবেশটা আরও শোকবহ করে তোলে। ডাক্তারবাবু তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিষন্ন গলায় তিনি বলেন , এমন আদর্শবাদী মানুষ আজকের দিনে দুর্লভ।সমাজের নির্মমতার জন্য চলে যেতে বাধ্য হলেন তিনি। অথচ কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ কিম্বা অনুযোগ নেই। গতানুগতিকতার স্রোতে গা ভাসাতে না পারার দায় নিজের ঘাড়েই তুলে নিয়ে চলে গেলেন। আজ আমরা তার মুল্য বুঝলাম না। কিন্তু একদিন ভাবীকাল তার মুল্যায়ন করবে। সেদিন বুঝব অনাদরে কি হারিয়েছি আমরা। 




                              সেই সময় কান্না থামিয়ে  মনোতোষ বলে উঠে -- ওদের কাউকে আমি ছাড়ব না।পুলিশের কাছে অভিযোগ করব ওদের বিরুদ্ধে। ওদের জন্যই বাবাকে চলে যেতে হল বলেই পাগলের মতো করতে থাকে সে।তাকে জড়িয়ে ধরেন মলয় আর ডাক্তারকাকা। সান্ত্বনার সুরে ডাক্তারকাকা বলেন -- এ সময় মাথা গরম করিস না ভাই। তোর এখন অনেক কাজ। বাবার মুখাগ্নি, ময়নাতদন্তের পর সৎকারের ব্যবস্থা যে তোকেই করতে হবে। মা আর স্ত্রীকে তো তোকেই দেখতে হবে।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না মনোতোষ।  তীব্র বেগে মাথা নাড়তে নাড়েতে বলে, না আমি বাবার মুখে আগুন ছোঁওয়াতে কিছুতেই পারব না।
---- পারব না বললে তো হবে না ভাই। তোর হাতে আগুন না পেলে বাবার যে সদগতি হবে না।
ততক্ষণে মৃতদেহ বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। বাবার পাশে বসেই মনোতোষ দেখতে পায় তাদের বাড়ির পিছনের ঝাঁড় থেকে বাঁশ কেটে খাট তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছেন পাড়ার লোকেরা। মহিলারা মাকে শেষ বারের মতো মাথায় ঢেলে দিচ্ছেন সিঁদুর। পড়িয়ে দিচ্ছেন আলতা। তারপর ইট দিয়ে হাতের শাখাটা ঠুকে ভেঙে দিতেই মা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।ছন্দা গিয়ে মাকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে। বাবাকে নিয়ে গিয়ে শোওয়ানো হয় খাটে। আলতা মাখিয়ে কাগজে বাবার পায়ের ছাপ নেওয়া হয়। ডাক্তারবাবু মনোকে ধরে নিয়ে গিয়ে বলেন , ভাই বাবাকে একটু কাঁধ দে। বাবার খাটের একদিকে কাঁধ লাগায় সে। বাবাকে নিয়ে গিয়ে তোলা হয় গাড়িতে।গাড়ি থেকেই মনো দেখতে পায় বাবাকে আর একটি বার দেখার জন্য ছুটে আসার চেষ্টা করছে মা। ছন্দা আর পাড়ার মেয়েরা তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যায় সব। পোষ্টমর্টের পর মৃতদেহ পেতে বিকেল গড়িয়ে যায়। মৃতদেহ নিয়ে গাড়ি যখন তারাপীঠ মহাশ্মশানে পৌঁছোয় তখন বিকালের আলো মরে এসেছে।তাই দ্রুত মুখাগ্নির ব্যবস্থা করা হয়। মনোতোষ কিছুতেই বাবার মুখে আগুন ছোঁওয়াতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারদাদুই তার হাতে ধরে আগুন ছুঁইয়ে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় বাবা। ঘুরে ফিরে বাবার কথাই মনে পড়ে তার। কালই একসঙ্গে বসে খাওয়ার সময় বাবা তার পাতে আধখানা ডিম তুলে দিলেন। সে ডিম ভালো বাসে বলে বাবা বরাবর নিজে আধখানা খেয়ে বাকিটা তার পাতে তুলে দিয়েছেন। সেই মানুষটাই কোথাই হারিয়ে গেল ? মনোতোষের মনে হয় ওই একটি মানুষের অভাবে  পৃথিবীতে তারা যেন একা হয়ে গেল। ওই মানুষটাই তো তাদের মাথার উপর ছাতা হয়েছিল এতোদিন। সারা জীবন ধরে মানুষটা নিজে ঠায় ভিজেছে কিন্তু তাদের গায়ে এক ফোঁটা জলও পড়তে দেয় নি , নিজে পুড়েছে কিন্তু তাদের গায়ে  গ্রীষ্মের কোন  আঁচ লাগতে দেয় নি।বরং তাদের সুশীতল ছায়া দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিল। ওই মানুষটার জন্যই শীতভোগ করতে হয় নি। নিজে কেপেছে থর থর, কিন্তু তাদের মাথায় পড়তে দেয়নি এক ফোটাও হিম। মানুষটা ছিল বলেই তারা শরতের মেঘ হয়ে কাশের বনে লুকোচুরি খেলেছে।হেমন্তের সুঘ্রান মেখে রোদেলা আকাশে উড়েছে। বসন্ত বাতাসে উড়িয়েছে ভালোবাসার আবীর। সেই মানুষটাই আজ আর নেই। চোখের সামনে ছাতাটা নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ছাতাটা বিশাল বড়ো বটগাছের মতো  ছায়া হয়েছিল তাদের মাথার উপর। আজ ছাতাটাকে হারিয়ে নিরাশ্রয় হয়ে পড়ল তারা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁচ্ছে যায় গাড়িটা। আর তখনই বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসে কান্নার রোল। মনোতোষ বাড়ির ভিতরে যেতেই সাধনা কাঁদতে কাঁদতে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে ,  বাবাকে একা কোথাই রেখে এলি বল বাবা  , বল বল ? কোন কথা বলতে পারে না মনোতোষ। মাকে জড়িয়ে ধরে সে'ও কান্নায় ভেঙে পড়ে।

                             ( ক্রমশ )


নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                 ----০----






No comments:

Post a Comment