( কিস্তি --- ৬৩ )
মাকে জড়িয়ে ধরে সে'ও কান্নায় ভেঙে পড়ে। পাড়া-প্রতিবেশী , সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা তাদের সান্ত্বনা দেন। সবাই ভুবনবাবুর বিভিন্ন ভাল দিকের কথা উল্লেখ করে স্মৃতিচারণ করেন। সেই সব কথা শুনতে শুনতে তাদের মন কিছুটা শান্ত হয়। তারাও চলে যাওয়া প্রিয় মানুষটার ফেলে যাওয়া নানা স্মৃতি তাদের সঙ্গে আদান প্রদান করেন। শোক ভুলতে সব মানুষ এভাবেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরে। সাধনাও তেমনই মনের মনিকোঠায় জমে থাকা স্মৃতিগুলো একের পর এক তুলে আনেন।স্মৃতি হাতড়ে বলেন , লোকটার কোন দিকে কোন লোভ ছিল না। একটু খেতে ভালবাসতেন এই যা।মোটা মাছ , মাংসের প্রতি খুব আশক্তি ছিল। কিন্তু ভালো মাছ মাংস কিনে খাওয়ার তো সামর্থ্য ছিল না। তাই সস্তা খুঁজতেন। তাবলে কৃপণ ছিলেন না। বরং বিরাট মনের মানুষ ছিলেন। আসলে অর্থনৈতিক দুরবস্থাই তার হাত টেনে ধরত।কতই বা মাইনে পেতেন তখন ? ৭০/৮০ টাকা মাস মাইনের উপরেই মনোর পড়াশোনা , সংসার খরচ সহ সব কিছু নির্ভর ছিল।তার উপরে আপদ বিপদে যে যখন হাত পেতেছে , তাদের কাউকেই ফেরাতে পারেন নি তিনি।এমনও দিন গিয়েছে মাসের শেষ , হাতে কানাকড়িও নেই।কেউ হয়তো বলেছে , মাস্টার ছেলেটা খুব ভুগছে।
ডাক্তারবাবু একটা ওষুধ খাওয়াতে বলেছেন। কিন্তু টাকার অভাবে কিনতে পারছি না। গোটা কতক টাকা হলে ভালো হত। লোকটির কথা শুনে খুব বিব্রত হয়ে পড়তেন উনি। নিজের হাতে তো টাকা পয়সা রাখতেন না। মাইনে পেয়েই তুলে দিতেন আমার হাতে। তাই মুখ কাচু - মাচু করে সামনে এসে দাঁড়াতেন। খুব সংকোচের সঙ্গে বলতেন , তোমার তো মাসের শেষ। মনোকেই তো এখনও পরীক্ষার ফি'টা দিতে পারো নি।রতন বলছে ওর ছেলেটার খুব অসুখ। ওষুধ কিনতে কয়েকটা টাকা লাগবে। কি বলি বলো তো ওকে ? ক'টা দিন পরেই তো মাইনে পাব। তখনই বরং ওকে আসতে বলি নাকি ?
তখন দুঃসময়ের জন্য জমিয়ে রাখা সঞ্চয় থেকেই কয়েকটা টাকা হাতে এনে তুলে দিয়েছি। আর টাকা ক'টা রতনের হাতে তুলে দিতে পেরে ওর মুখে ফুটে উঠেছে প্রশান্তির হাসি। কাউকে টাকা দিতে না পারলে খুব কষ্ট পেতেন। তাই হাজার অভাব স্বত্ত্বেও ওর মুখের ওই অমলিন হাসিটা সব সময় ধরে রাখার জন্যই আমি কিছু কিছু করে টাকা জমিয়ে রাখতাম। কতজন পরে শোধ দেব বলে নিয়ে আর শোধ দেয় নি। তবু উনি তা মনে রাখেন নি কোনদিন। সেই লোকটাই ফের হাত পাতলে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন নি। সান্ধ্য আসরের বন্ধুরা বলেন, আমরাও যখনই কোন বিপদে হাত পেতেছি যেমন করে হোক ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু কোনদিন সেই টাকা ফেরতের জন্য তাগাদা করেন নি।
স্মৃতিচারণ করতে করতেই দুটো দিন কেটে যায়। ঘুরে ফিরে বাবার কথাই মনে পড়ে মনোতোষের। দুদিন হোল বাবা চলে গিয়েছেন। এখনও আনাচে কানাচে দগদগে হয়ে রয়েছে তার নানা স্মৃতি চিহ্ন। পেরেকে ঝোলানো রয়েছে ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট, প্রেসারের ওষুধের ফয়েল, পেন, ডাইরি আরও কত হাবিজাবি। বৈঠকখানা ঘরের দেওয়ালে তার নিত্য বসার জায়গাটি এখনও মাথার তেলে তেমনই সমান কালো আছে। সেই সব দেখে আর জলে ভিজে যায় মনোতোষের চোখ। আত্মীয় স্বজন , পাড়া প্রতিবেশীরা বলেন - শক্ত হও , তোমার এখন অনেক দায়িত্ব। মাকে দেখতে হবে। মাকে দেখতে গিয়েই আরও বেশি করে মনে পড়ে যায় বাবাকে। মায়ের সিথিটা বড্ড সাদা দেখায়। তার সর্বাঙ্গে বাবার চলে যাওয়ার ছাপ। সাদা মাটা আটপৌরে মায়ের না ছিল ভালো শাড়ি, না ছিল অলংকার।
তবু বাবা যতদিন ছিল ততদিন মাকে এত ফাঁকা ফাঁকা লাগেনি। সাধারণ খোলের শাড়ি আর শাঁখা নোওয়াতেই দিব্যি পরিপূর্ণ দেখাত মাকে। বাবা চলে যাওয়ার সময় পাড়ার মহিলারা ঠুঁকে তার শাঁখা ভেঙে দেয় , নোওয়া খুলে নিয়ে পড়িয়ে দেয় থান কাপড় , সিথির সিঁদুর মুছিয়ে দিয়ে শেষ বারের মতো পায়ে পড়িয়ে দেয় আলতা। মা তখন কান্নায় বাবার বুকে আছড়ে পড়েছিল। ওইটুকুই তো ছিল মায়ের অলংকার। এখনও সযত্নে তাকে তোলা রয়েছে মায়ের অব্যবহৃত আলতা , সিদুর, সস্তার সুগন্ধী তেল , বাক্সে পুজোয় কেনা একবারই পড়া শাড়ি। আর তো কোনদিন মায়ের ওই সব পড়া হবে না। বাবা আজ ছবি হয়ে দেওয়ালে ঝুলছেন। মায়ের বৈধব্য বেশ ঘুরে ফিরে বাবার চলে যাওয়াটা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে।
অসময়ে এভাবে বাবার চলে যাওয়াটা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না মনোতোষ। বৈঠকখানা ঘরে একা একা বসে বাবার কথাই ভাবছিল সে। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবারও অবকাশ হয় না তার।তিন দিনের মাথায় বাবার পারলৌকিক কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এমনিতে তাদের পরিবারে ১৫ দিন অশৌচ পালনের রীতি আছে। কিন্তু ছন্দার ঠাকুমা বলেছেন , এই সব মৃত্যুর ক্ষেত্রে তিন দিন অশৌচ পালনের পর আত্মীয়স্বজন - পাড়া-প্রতিবেশীদের খাওয়ানোর বিধি আছে। বাবা চলে যাওয়ার পরদিন থেকেই ছন্দার ঠাকুমা এবাড়িতে এসে রয়েছেন। সবদিক একরকম তিনিই সামলাচ্ছেন। তার কথা অনুযায়ীই তিনদিন পর পারলৌকিক কাজ এবং লোক খাওয়ানোর আয়োজন করা হচ্ছে। বাবার সান্ধ্য আসরের বন্ধু, রুম্পা , খুঁকী, ছন্দার বাবা আর ডাক্তারদাদুরাই সব ব্যবস্থাপত্র করছেন। লোক খাওয়ানোর বিষয়টা মনোতোষের যেন কেমন লাগে। অনেকটা লোক দেখানোর মতোই মনে হয় তার।সে শুনেছে দাহ করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্মশানবন্ধুরা বেহেড মাতাল হয়ে মাতলামি করে। কেউ ভেবেও দেখে না যাদের বাড়ির লোক চলে গেলেন তাদের মনে ওই আচরণ কি প্রভাব ফেলতে পারে। কেউ কেউ আবার গাড়িতে বাড়ি ফেরার সময় থালা বাজিয়ে চটুল গানও গায়। আর মৃতের পরিজনদের তা অসহায় ভাবে সহ্য করতে হয়।
সহমর্মিতা নয় , বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওই ধরনের হুল্লোড় করার জন্যই পাড়ায় কারও মৃত্যু হলেই কিছু লোক অযাচিতভাবে শ্মশানে যাওয়ার জন্য লাইন দেয়। আর তাদের নিয়ে মৃতের বাড়ির লোকেদের ছুঁচো গেলার অবস্থা হয়।তাদের না পারেন ফেরাতে , না পারেন সবাইকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতিতে কুলিয়ে উঠতে। তবু নিজের আর্থিক সামর্থ্যের বাইরে গিয়েই লোক দেখাতে তাদের নিয়ে যেতে হয়। যারা বাবা-মাকে দুবেলা দুমুঠো ভাত দেয় না লোক দেখাতে তারাই আবার বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তাদেরই সম্পত্তি হাতিয়ে মহা আড়ম্বরে পারলৌকিক কাজ করে। মনোতোষের মনে হয় বাবা-মায়ের উপর প্রকৃত ভক্তি, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থাকলে ওইসব আড়ম্বর দেখানোর কোন মানেই হয় না। বাবা অবশ্য বলতেন , আমরা সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের প্রচলিত কিছু প্রথা , সংস্কার , রীতি-নীতিতে বাঁধা। তাই মন না চাইলেও বংশ পরম্পরাক্রমে প্রচলিত ওই সব সংস্কার আমাদের মেনে চলতেই হয়। বাবার সেই কথা সে অমান্য করবে কেমন করে ? তাই প্রচলিত রীতি মেনেই পারলৌকিক কাজের আয়োজন করা হয়।
কাজের দিনই সকালে এসে পৌঁছোন অম্লানবাবু , সুধাদি, জয়ন্তবাবুরা। কয়েকজন আত্মীয়স্বজনও। তাদের দেখে থিমিয়ে থাকা শোকটা আর চেপে রাখতে পারেন সাধনা। সুধাদিকে জ্বড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সুধাদি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। মনোতোষ , ছন্দার চোখের জলও বাঁধ মানে না।কিন্তু শোক সামলে পারলৌকিক কাজে নামতে হয় তাদের। সবার সহায়তায় নির্বিঘ্নেই কাজ সম্পূর্ণও হয়ে যায়। তারপর থেকেই আত্মীয় স্বজনেরা বাড়ি ফিরতে শুরু করেন। কাজের লোকেরাও তাদের জিনিস পত্র গুটিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করে দেয়।একে একে প্যান্ডেলের শেষ বাঁশটাও খোলা হয়ে যায়। আর গোটা বাড়িটাকে গ্রাস করে নেয় এক নিঃসীম শুন্যতা। চারদিন আগে বাবা চলে গিয়েছেন। তবু তার পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম, আত্মীয় পরিজনদের আসা যাওয়া ঘিরে মনে হচ্ছিল বাবাও যেন কোথাও আছেন। তার সংস্পর্শ মিশে রয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে।আজ শুধু দেওয়ালে ছবি হয়ে ঝুলে রয়েছেন বাবা।
আর পড়ে রয়েছে তার হাতে গড়া সাম্রাজ্য এই বাড়ি। দোল খাচ্ছে তারই লাগানো নারকেলের গাছের পাতা , টুপ-টাপ করে ঝড়ে পড়ছে পাকা আমড়া, বাঁশঝাড়ে কিচির মিচির করছে পাখির দল। মনে হচ্ছে বাবা যেন বলছেন, ভয় কি রে ? এসবের মধ্যেই আমি আছি। বাস্তবিকই , বাবা সবকিছুর মধ্যেই আছেন। সবকিছু সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। নবজাতকের মাথার বালিশের শিমুল তুলোর গাছ থেকে শেষ যাত্রার খাটের বাঁশের ঝাড় পর্যন্ত লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।আগে তাদের কোন বাঁশবন ছিল না। অন্যান্য কাজ তো বটেই , মৃত দেহের খাট তৈরির বাঁশের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হত। বাবা নিজ হাতে বাঁশ বন তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন। সেই বাঁশ দিয়েই দাদু- ঠাকুরমার খাট তৈরি হয়েছে। ওই বাঁশের খাটেই শেষ যাত্রায় গিয়েছেন বাবা নিজেও। বাবার কথা বড্ড বেশি করে মনে পড়ছে তার। আজ বাবার ভোজের কর্মীদের খাওয়া দাওয়া আয়োজন করা হয়েছে। কসা মাংসের গন্ধে ম-ম করছে সারা বাড়ি। চোখের জল কিছুতেই বাঁধ মানছে না। বাবা মোটা মাছ - মাংস খেতে খুউব ভালোবাসতেন। ওইটুকুই ছিল তার বিলাসিতা। মনে পড়ে, ছোটবেলায় ১০ টাকা দিয়ে বাবা তাকে গঞ্জের হাট থেকে ছাট মাংস আনতে পাঠাতেন। ছাট মাংস কিনতে খুব লজ্জা হোত। রাগও হোত বাবার উপর। তখন তো আর সে বুঝতো না , মাসিক ৭০/৮০ টাকা বেতনের স্কুল শিক্ষকের পক্ষে সংসারের সব দিক সামলে ছাট ছাড়া ভালো মাংস কিনে খাওয়া সম্ভব নয়। আর আজ তারই ভোজের কর্মীদের খাওয়া-দাওয়ার কত এলাহি আয়োজন। কিছুতেই মাংস মুখে তুলতে পারছে মনোতোষ। মনে হচ্ছে বাবা এমন মাংস ভাত পেলে কত খুশী হতেন।এসব ভাবতে ভাবতে চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে মাখা ভাত।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment