Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৬৪




     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











              কালের কারিগর
              


                          অর্ঘ্য ঘোষ


                      (  কিস্তি --- ৬৪  )


     

ওইসব কথা ভাবতে ভাবতে চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে মাখা ভাত। কর্মী ভোজনের দিন সাধনাও নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নি। বার বার স্বামীর কথা ভেবে চোখের জল মুছেছেন। তিনিও মুখে সেদিন কুটোটি কাটতে পারেন নি। নানা কাজের অছিলায় মনকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন সাধনা। শোক ভুলতে মানুষ কাজকে আঁকড়ে ধরে। মনোতোষও সেই উদ্দেশ্যেই ছুটি নিয়ে রাখা স্বত্ত্বেও স্কুলে যাতায়াত শুরু করে দেয়। কিন্তু স্কুলই তাকে বার বার বাবার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। মনে পড়ে যায় এই স্কুলেই সে বাবার কাছেও পড়েছে। বাবার হাতেই নিয়োগ পত্র জমা দিয়ে শিক্ষক হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছে। প্রধান শিক্ষকের চেয়ারটা এখনও পর্যন্ত ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। হয়তো বেশি দিন থাকবে না। কেউ এসে দখল করে নেবে ওই চেয়ার। কেবল তার বুকের ভিতর বাবার আসনটা শুন্যই থেকে যাবে। সবার অলক্ষ্যে পরম মমতায় সে চেয়ারটায় একবার হাত বুলিয়ে নেয়।চেয়ারটার গায়ে যেন বাবার স্পর্শ লেগে আছে। কি আশ্চর্য মানুষের জীবন।চেয়ারটা রয়ে গেল , চলে গেল কেবল মানুষটা। জীবনের চেয়ে জড় পদার্থের স্থায়িত্ব কত বেশী ! শুধু স্কুলেই নয়,  স্কুল যাওয়া আসার পথেও বাবার স্মৃতি মাখা  তেমনই কত নির্দশন ছড়িয়ে রয়েছে। সেই সব নির্দশনের সঙ্গেও মিশে রয়েছে বাবার স্পর্শ। তার স্পষ্ট মনে আছে ,  সে যখন খুব ছোট তখন বাবার সঙ্গে স্কুলে আসার জন্য খুব ঝোঁক ধরত। বাবার দেখাদেখি স্থান করে পিঁড়ি পেতে খেত বসে যেত। স্কুলে নিয়ে গিয়ে ক্লাস করতে সমস্যা হবে ভেবে বাবা নানা ভাবে তাকে এড়িয়ে যাওয়ারচেষ্টা করতেন। তবে  মাঝে মধ্যে দু-'একদিন তাকে নিয়েও যেতেন। তারপর কাউকে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। আজ সেই রাস্তা দিয়ে  যাওয়ার সময় সেই সব কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছিল মনোতোষের। কয়েকদিন হলো বাবা চলে গিয়েছেন। তার অভাব এখন প্রতি পদে অনুভব করছে সে। আজ স্কুল থেকে ফেরার সময় বাবাকে ঘিরে সে ফিরে পায় তার হারানো শৈশব। তখন সে গ্রামের স্কুলেই দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মাঝে মধ্যে গ্রামের স্কুল কামাই করে বাবার সঙ্গে যাওয়ার বায়না ধরত।  তার অন্যতম দুটি কারণ ছিল। প্রথমটি হলো বাবা কারও সঙ্গে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে পাঠানোর সময় স্কুলের পাশেই গঙ্গা জ্যেঠুর দোকান থেকে খাট্টাই বিস্কুট কিনে দিতেন।আর দ্বিতীয় কারণটা হলো  আলপথ ভেঙে গ্রামের মাঝে দিয়ে যেতে কি রকম যেন একটা ভালো লাগত।গ্রামের কামারগড়ের পাশ দিয়ে  গোন আল ভেঙে যেতে হত। দুপাশে পড়ে থাকত বুড়ো দীঘি আর রানীভবানী। ছাতা মাথায় বাবা যেতেন আগে আগে। পিছনে পিছনে সে যেত কখনও নাচতে নাচতে, কখনও বা হেলতে দুলতে। নানা অঙ্গ ভঙ্গি সহ মাঠে টানানো ছাগল-গরুকে ভেংচি কাটতে কাটতে। বাবা একের পর এক ধারাপাত , কবিতা , ছড়া মুখস্থ করাতে করাতে হাঁটতেন।আর সে বাবার সঙ্গে ধারাপাত ঘষতে ঘষতে হঠাৎ দুহাতের তালু প্রসারিত করে ফড়িং ধরতে সংলগ্ন আখের জমিতে নেমে যেত।বাবা টের পেয়ে বকা লাগাতেন - এই জন্যই তো তোকে আনতে চাই না। এরকম করলে আর কোনদিন আনব না কিন্তু। বকা খেয়ে ছুটে বাবার সঙ্গ নিত সে। আবার কিছুটা গিয়ে আলের ধারে লজ্জাবতীর পাতা পা দিয়ে ছুঁয়ে নুইয়ে পড়া দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে পড়ত। কখন ও ঘাসের ঝোঁপে ফু দিয়ে জোকের অস্তিত্ব টের পাওয়ার চেষ্টা করত। তারপর ফের বকা খেয়ে খেই হারিয়ে একে চন্দ্র -- দুইয়ে পক্ষ করতে করতে কাছাকাছি পৌঁচ্ছে শুনত বাবা তখন ভরাট গলায় আবৃত্তি করছেন -' আমাদের ছোটনদী চলে বাঁকে বাঁকে।' ওই ভাবে হেটে স্কুলে পৌঁছানোর পর বাবা নিজে হাতে তার কাদামাখা পা ধুইয়ে পরিস্কার করে দিতেন।এতদিন লক্ষ্য করে নি। আজ মনে হল আলপথটা যেন সরু হয়ে গিয়েছে।কিন্তু দুধারের জমিতে আজও উড়ে বেড়াচ্ছে কত রঙ বেরঙের ফড়িং। পায়ের স্পর্শে মাথা নুইয়ে দিচ্ছে আলপথের ধারের লজ্জাবতীলতা। যেন মায়া অঞ্জন মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবাকে ঘিরে তার সেই হারিয়ে যাওয়া শৈশব। বাবাই শুধু নেই। আবার আছেও। সে যেন স্পষ্ট শুনতে পাই বাবার সেই কন্ঠস্বর -- বল বাবু , একে চন্দ্র -- দুইয়ে পক্ষ -- তিন এ নেত্র -- চার এ বেদ ------।




                     ওই ভাবেই প্রায়ই দিনই স্মৃতি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফেরে মনোতোষ। বাড়িতেও অনুক্ষণই বাবার কথা মনে পড়ে তার। কিন্তু মায়ের কথা ভেবে ভুলে থাকার ভান করে।  মাকে দেখে খুব কষ্ট হয়। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে মা যেন কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। নানা রকম কথা বলে মা'কে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে সে। কিন্তু মাকে যেন বিষাদ প্রতিমার মতো মনে হয় তার। হাসির কথায় হাসেন ঠিকই , কিন্তু সেই হাসিতে উৎফুল্লতা থাকে না। খুব নিঃসঙ্গ মনে হয় মাকে।যতক্ষণ সে বাড়িতে থাকে মাকে সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মায়ের মনের তল পায় না। ডাক্তারদাদুকে মায়ের কথাটা বলেছে মনোতোষ। ডাক্তারদাদু বলেছে , সুখী দম্পতিদের মধ্যে কেউ একজন চলে গেলে ওই রকমই হয়।কিছুতেই অন্যজন সেই বিয়োগ ব্যাথা সইতে পারে না। অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা পর্যন্ত কাজ করে বিশেষ করে স্ত্রী'দের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে অনেক দেরী লেগে যায়। মা'ও কিছুতেই বাবার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছেন না।এক দিন রাতে মায়ের ঘরে ঢুকে সে'ও সেটা উপলব্ধি করেছে। এতদিন শান্তিলতা এ বাড়িতেই ছিলেন।তিনি ছিলেন বলে সাধনাও তার সঙ্গে গল্প গুজব করে তাও কিছু ভুলে থাকতে পারতেন।কিন্তু দিন তিনেক আগে শান্তিলতা বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। সাধনা তাকে আরও কয়েকটা দিন থেকে যেতে বলছিলেন। ছন্দা আর মনোতোষ তো চেয়েছিল শান্তিলতা বরাবর এ বাড়িতেই থেকে যান।কিন্তু শান্তিলতা মৃদু হেসে বলেন , বেশ  কয়েকদিন হলো এসেছি। ওদিকে কি হচ্ছে গিয়ে একটু দেখি। পরে আবার আসব।
পরে অবশ্য মনোতোষ ছন্দার কাছে শুনেছে তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে শান্তিলতা নাকি বলেছেন , তোরা আর জোড়াজুড়ি করিস না। বেশি দিন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে  বাপেরবাড়ির লোকেদের  থাকাটা ভালো দেখায় না।পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে। তার চেয়ে যখন দরকার হবে খবর পাঠাবি , আমি কিম্বা তোর মা চলে আসব।অগত্যা ঠাকুরমাকে কিছু বলতে পারে নি ছন্দা। সব শুনে মনোতোষও আর জোর করে নি।সেদিন থেকেই সে আর ছন্দা মায়ের ঘরে এক সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সাধনা তীব্র আপত্তি করেন। তারা শুলে নাকি তার ঘুম হবে না। আসলে ছেলে-বৌমায়ের প্রাইভেসী নষ্ট হয়ে যাবে বলেই তিনি ওই অজুহাত খাড়া করেছেন বলেই মনোতোষের ধারণা।কিন্তু মাকে একা রেখে সে আর ছন্দাও পাশের ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে না।মাঝে মধ্যে পালা করে দু'জনে মায়ের ঘরে ঘুরে যায়। সেদিন ওই ভাবেই মায়ের ঘরে গিয়ে দৃশ্যটা দেখেই থ হয়ে যায় মনোতোষ। ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই সে দেখতে পায় মা উঠে টেবিলের কাছে কি যেন করছেন।তার উপস্থিতি টের পেয়ে থতমত খেয়ে যান মা।বিষ্মিত হয়ে সে দ্রুত মায়ের কাছে পৌঁছোয়। তাকে দেখে মা হাতের মুঠোয় কিছু একটা লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন।মায়ের আচরণে সে অবাক হয়ে যায়।মায়ের মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখ পড়ে যায় টেবিলে।নাইট ল্যাম্পের আবছা আলোতেও দেখতে পায় একটা কাগজ পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে রাখা আছে। সেটা চোখের সামনে মেলে ধরতে হাড়হিম হয়ে যায় তার। কাগজে ফুটে উঠে মায়ের হস্তাক্ষর। গোটা গোটা হরফে লেখা ' সুইসাইডালনোট। ' মা লিখেছেন -- 
স্নেহের বাবা মনো  ,  মা ছন্দা তোমাদের মতো ছেলে - বৌমা সচরাচর কেউ পাই না। তাই তোমাদের ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তোমাদের বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমার বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছে। সব সময় মনে হয় তোমাদের বাবা পরপারে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাই সেখানে যাওয়ার জন্যই এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হলাম। আমাকে ভুল বুঝো না ,
ক্ষমা কোর।
          --- তোমাদের মা।




চিঠিটা পড়েই কেঁদে ফেলে মনোতোষ। তাকে কাঁদতে দেখে সাধনাও কেঁদে  ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতে হাতের মুঠো খুলে দেখান তিনি। মনোতোষ দেখে মায়ের হাতে বেশ কয়েকটা ট্যাবলেট। সে গুলো যে ঘুমের ট্যাবলেট তা বুঝতে অসুবিধা হয় তার। মায়ের ঘুম হচ্ছিল না বলে সে'ই তো কয়েকদিন আগে ডাক্তারদাদুর কাছে থেকে ট্যাবলেট গুলো এনে দিয়েছিল। মা যে বাবার মতোই একই পথ বেছে নেওয়ার চেষ্টা করবে তা ভাবতেও পারে নি সে।তাই নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজের উপরেই রাগ হয় তার।তাকে কাঁদতে দেখে মা বলেন , কাঁদিস না বাবা। এই দেখ আমি একটাও ট্যাবলেট খাই নি। সে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। 
সেই সময় ঘরে আসে ছন্দাও। সব শুনে সে 'ও কেঁদে ফেলে। সাধনা জড়িয়ে বলে , তুমি কি করতে যাচ্ছিলে মা ? বাবা চলে গেলেন , তুমিও যদি চলে যাও তাহলে আমরা কার কাছে থাকব মা ?
সাধনা কোন প্রত্যুত্তর করতে পারেন না। শুধু ছেলে আর বৌমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ভাসান। মনে মনে ভাবেন , সত্যিই তো তিনি বড়ো ভুল করতে যাচ্ছিলেন। যদি আত্মহত্যা করতেন তাহলে আইন হয়তো মনোদের কিছু করতে পারত না। কিন্তু সমাজ তাদের অপরাধী সাজিয়ে দিত। সবাই বলাবলি করত , নিশ্চয় ছেলে-বৌমার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েছে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। নাহলে স্বামী মারা যাওয়ার পরেই কেন ওই পথ বেছে নিতে হবে ?  কার মুখে হাত দিত ওরা ? সারা জীবন মাথা নিচু করে তার আত্মহত্যার দায় ওদের বয়ে বেড়াতে হত। মা হয়ে সন্তানের ঘাড়ে এ কি মারাত্মক দায় চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল সে !  একাকীত্ব কাটাতে আর কোনদিন ওই পথ মাড়াবে না বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সাধনা। বছর খানেকের পর থেকে অবশ্য তার একাকীত্ব দূর হতে শুরু করে।

                          ( ক্রমশ )


নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                 ----০----



No comments:

Post a Comment