Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৬৫





     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











             কালের কারিগর
              


                          অর্ঘ্য ঘোষ
                                      
                           (  কিস্তি --- ৬৫  ) 




বছর খানেকের পর থেকে অবশ্য তার একাকীত্ব দূর হতে শুরু করে। এক বছরের মাথায় ছন্দার কোল আলো করে আসে ফুটফুটে এক শিশু। সাধনাই তার নাম দেন সূর্য। এখন তাকে নিয়েই কি করে যে সময় কেটে যায় তা টেরই পান না তিনি।দু'বছরের মাথায় ছন্দা আর একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। তার নামও সাধনাই দেন।নাতনীর নাম রাখেন সুস্মিতা।পর পর নাতি - নাতনীকে পেয়ে সাধনার নিসঙ্গতা অনেকখানিই দূর হয়ে যায়। ব্যস্ততাও বেড়ে যায় তার।দুটি বাচ্চা আর সংসারের কাজ সামাল দিতে গিয়ে হিমসিম খেতে হয় শাশুড়ি -- বৌমাকে।  ছন্দার মা - ঠাকুমা এসে মাঝে মধ্যে সংসার সামলে দিয়ে যান।কিন্তু নাতিটা এরই মধ্যে তার খুব ন্যাওটা হয়ে পড়েছে ঠাকুমায়ের।বিশেষ করে মায়ের কোলে বোন চলে আসার পর থেকে তার কোল ছাড়াই হতে চায় না সে। এতদিনে সাধনার সংসার যেন পূর্ণতার স্বাদ পায়। এ সময় স্বামীর জন্য খুব আফশোষ হয় তার। মানুষটা  বাচ্চা ছেলে খুব ভালোবাসতেন। স্কুল থেকে ফেরার সময় পকেট ভর্তি চকলেট কিনে নিয়ে আসতেন। সেই সময় তার ফেরার অপেক্ষায় বাচ্চা ছেলেগুলো পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত। তাকে দেখতে পেলেই হল।  কাকু কাকু বলে পিছু নিত। আর ভুবনবাবু ওদের দেখে মাঝ পথে দাঁড়িয়ে যেতেন। তারপর ওদের কারও গাল টিপে , কারও চুল এলোমেলো করে দিয়ে , আবার কাউকে কোলে তুলে নিয়ে চকলেট দিতে দিতে বাড়ি ফিরতেন। বাচ্চাগুলোর জন্য পিকনিকের আয়োজনও করতে হয়েছিল তাকে। সে'ও এক মজার ব্যাপার। বন্ধুদের নিয়ে বছরে একবার পিকনিকের রেওয়াজ ছিল দীর্ঘদিনের। একবার সেই পিকনিক থেকে হাঁড়ি-কড়াই নিয়ে গাড়ি করে ফেরার সময় কয়েকটি ছেলেমেয়ে তাদের পথ আটকায়।ভুবনবাবুকে পাকড়াও করে অভিমানী গলায় বলে -- আমাদের নিয়ে গেলে না তো কাকু ?  তোমার সঙ্গে আঁড়ি। যাও তোমার সঙ্গে আর খেলব না। 
তাদের বলার ধরণ দেখে সবাই হেসে ফেলেছিল। ভুবনবাবুই তাদের সামনে হাটু মুড়ে বসে কান ধরে বলেছিল -- সত্যি 
কাকু বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে। এবারটির মতো মাফ করে দাও আর ভুল হবে না। আগামী রবিবারই তোমাদের নিয়ে শিয়ালডাঙ্গার মাঠে পিকনিক হবে।কি এবার ভাব তো ? বলে ছেলেমেয়েগুলোর দিকে নিজের বুড়ো আঙুলটা বাড়িয়ে ধরেন তিনি। আর ছেলেমেয়েগুলো তার আঙুলে আঙুল ঠেকিয়ে ভাব ভাব বলে চিৎকার করতে করতে তার ঘাড়ে পিঠে চেপে বসে। আর তখন তাকে দেখে শিশু ভোলানাথের মতো দেখাচ্ছিল।মুখে নির্ভেজাল হাসি।শিশুর মতো মন না হলে কি শিশুদের মনে ওই ভাবে জায়গা করে নিতে পারতেন ? কথা মতো পরের রবিবারই পাড়ার সমস্ত বাচ্চাদের নিয়ে পিকনিকের ব্যবস্থা করেছিলেন।সেই থেকে প্রতিবছরই আমৃত্যু বন্ধুদের মতো বাচ্ছাদের নিয়েও বছরে একদিন খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। আসলে খুব আনন্দপ্রিয় মানুষ ছিলেন।বাড়িতে নিত্য অভাব , কিন্তু দারিদ্রকে আমলই দিতেন না। বরং মজা করে বলতেন , লোকে কি করে টাকা রোজগার করবে ভেবে পাচ্ছে না আর আমি টাকা খরচের দিক খুঁজে পাচ্ছি না। স্বামীর কথা ভাবতে ভাবতেই কখন চোখে জল চলে এসেছিল টের পায় নি সে। মনোতোষ হঠাৎ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই খেয়াল হয় তার। দ্রুত আঁচলে চোখ মুছে মনোর মাথায় হাত রেখে  আর্শিবাদ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন তিনি।মনো বলে , মা আমি ভালোভাবে এম, এস, সি পাস করেছি।আজই খবরটা পেলাম।
---- খুব ভালো খবর রে। তোর বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশী হতেন।




                            কথাটা শুনেই মুহুর্তের মধ্যে মনোর মনটাও বাবার জন্য বিষন্ন হয়ে পড়ে।বাবার শিক্ষানুরাগের কথা মনে পড়ে যায় তার। সত্যিই বাবা থাকলে খুব খুশী হতেন। সেই সময় সূর্যর ছেলেমানুষিতে  বিষণ্ণতা দূর হয়ে যায় বাবার দেখাদেখি সে'ও আচমকা সাধনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসে। সবে আধো আধো বুলি ফুটেছে সূর্যর। কিন্তু কি প্রখর বুদ্ধি। বড়োদের যা করতে দেখবে তা করা চাই। সে মায়ের রুটি বেলাই হোক কিম্বা ঠাকুরমায়ের আলপনা দেওয়াই হোক , সবেতেই তাকে হাত লাগাতে হবে। তাই নিয়ে ছন্দার কাছে কম বকা খায় ! তখন সাধনাই ওর মাকে বকেন -- ওইটুকু ছেলে , ওকে বকাবকি কোর না তো। ছোট ছেলে একটু দুষ্টুমি না করলে মানায় না।
--- মা , এরপর তোমার ঘাড়ে চেপে বসবে। তখন সামলাতে পারবে না কিন্তু।
---- আমার ঘাড়ে বসবে ,  তোর তো বসবে না।
নাতিকে ঘাড়েই তুলে নেন সাধনা।সেই নাতিই এখন তাকে প্রণাম করে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু ঠাকুমা বাবার মতো মাথায় হাত রেখে আর্শিবাদ না করায় যেন কিছুটা অভিমান হয় তার। নিজেই ঠাকুমার হাতটা মাথায় তুলে নিয়ে আধো আধো স্বরে বলে -- আমায় কলো - কলো।
বিষয়টি অনুধাবন করেই সাধনা নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন -- ওলে বাবালে ছোনার আমাল কি বুদ্ধি লে। বলে নাতিকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেন। ওই ভাবে নাতি নাতনিকে নিয়ে দিন কেটে যায় সাধনার। স্বামী চলে যাওয়ার পর বাড়ি থেকে বেরোতেই চান না তিনি।এমন কি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেও যান না।এই তো কয়েকদিন আগে পরে সৌমেনের মেয়ে আর খুঁকীর ছেলের অন্নপ্রাশনে সপরিবারে নিমন্ত্রণ ছিল তাদের।মনোতোষ গিয়ে যৌতুক দিয়ে এসেছে।কিন্তু  তিনি যান নি। নাতি নাতনীকে নিজস্ব জগত গড়ে নিয়েছে সাধনা। দেখতে দেখতে নাতি নাতনিরাও প্রাইমারী স্কুলে পা রাখে। এক ক্লাসে আগে পিছে পড়ে সূর্য আর সুস্মিতা। রাজীব - খুঁকীর ছেলে রজতও সূর্যর সঙ্গেই এক ক্লাসে পড়ে। সুস্মিতার সঙ্গে পড়ে সৌমেন -- রীনার মেয়ে শ্রাবন্তি। সাধনাদের বাড়ির অদুরেই প্রাইমারি স্কুল। তাই কোন দিন টিফিনে কিম্বা ছুটির পর সূর্য - সুস্মিতার সঙ্গে আসে রজত আর শ্রাবন্তীও। নিজেদের ছেলেমেয়ের পাশাপাশি যখন যা হয় তা ওদের হাতেও দেয় ছন্দা।সৌমেন কিম্বা রীনার ব্যবহারের কথা সে মনে রাখতে চায় না। সবাই বলে , শিশুরা ভগবান। ভগবানের সঙ্গে বিভেদ করাটা পাপ বলেই মনে করে ছন্দা।তাই ছন্দার স্নেহের ছায়ায় ওরা পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠে। প্রতিদিন আরও অনেকের সঙ্গে খেলতে আসে ওরা।সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেও বাড়ি যেতে চায় না। তখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠাতে হয় ওদের। সূর্য আর সুস্মিতা অবশ্য এরই মধ্যে রুটিন মেনে চলতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। হাত পা ধুয়ে সকাল সন্ধ্যা সবাই মিলে প্রার্থনা সংগীত গায়। 



                            
                                             সেই সময় বাড়িটাতে যেন তপবনের শান্তি বিরাজ করে। কোন কোন দিন সাধনা নাতি - নাতনীকে নিয়ে ঠাকুর ঘরে সুর করে রামায়ন - মহাভারত পড়েন। তার সংগে গলা মেলাতে মেলাতে রামায়ণ , মহাভারত , মেয়েদের নানা ব্রতকথা ওদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। রাতেও ওরা দু'জনে তার দু'পাশে শোয়। কিন্তু ওরা না ঘুমানো পর্যন্ত তার পাশ ফেরার উপায়টি পর্যন্ত থাকে না। যখন যার দিকেই পাশ ফিরবেন তখন অন্যজন তাকে নিজের দিকে ফেরানোর জন্য টানাটানি শুরু করে দেবে। নাতি-নাতনীদের এই ছেলেমানুষি বেশ উপভোগ করেন সাধনা। ওই ভাবে ছেলেমানুষি করতে করতেই আস্তে আস্তে প্রাইমারীর গন্ডী ছাড়িয়ে হাইস্কুল উঠে ওরা। কিন্তু সাধনার কাছে তাদের ছেলেমানুষি যায় না।এখন মনোর সংগেই স্কুলে যায় ওরা। তাই মনোর পাশেই খেতে বসে দু'জনে। আর তাকে পালাক্রমে দু'জনকে খাইয়ে দিতে হয়।ভুলক্রমে যদি কারও মুখে দু'বার গ্রাস তুলে দিয়েছে অমনি অন্যজন চিৎকার করে বলে উঠেছে -- ওর নয়, ওর নয়, এবার আমার পালা।সাধনা হেসে উঠেন। মনো ওদের কপট শাসন করে -- এভাবে ঠাকুমা জ্বালাস কেন  ?নিজে নিজে খেতে পারিস না।
বাবার বকুনি খেয়ে খাওয়া বন্ধ করে ঠোঁট ফোলায় দু'জনে। সেটা লক্ষ্য করে সাধনা বলেন ,   আঃ  মনো ওদের বকছিস কেন ? ওরা আমাকে জ্বালাচ্ছে কে বলল ? তুই-ই তো ওদের থেকেও বেশি বয়েস পর্যন্ত আমার হাতেই খেয়ে স্কুলে যেতিস মনে নেই ?
মুহুর্তের মধ্যে মনোতোষের সামনে এসে দাঁড়ায় অতীত। মনে পড়ে যায় মা তাকেও ওই ভাবে খাইয়ে দিতেন।বাবা আর সে পাশাপাশি বসে খেত। কিন্তু মা ক্ষণেকের জন্য তার পরিবর্তে বাবার প্রতি মনোযোগী হলেই তারও অভিমান হত।মনে হতো মা তার একার। মায়ের ভাগ সে কাউকেই দিতে পারবে না। বাবাকেও না। তখন তো আর বাবা মায়ের সম্পর্কের রসায়নের কোন ধারণা ছিল না।সব বাচ্ছাদেরই  মনোস্তত্ত্ব একই রকম।প্রিয়জনের ভাগ কাউকেই দিতে পারে 
না।সে তো ঠাকুমায়ের স্নেহছায়া পায় নি বললেই চলে।জ্ঞান হওয়ার আগেই দাদু-ঠাকুমাকে হারাতে হয় তাকে।তাই মা'ই ছিল তার অন্যতম প্রিয়জন , আজও তাই। তবে বাবাও দুরের মানুষ ছিলেন না। বরং জ্ঞান হবার পর থেকেই বাবাও হয়ে ওঠেন তার ফ্রেন্ড - ফিলোজফার এবং গাইড বাবার আদর্শেই সে নিজেকে গড়ে তুলেছে।আনমনে খেতে খেতে কখন তার পাতের ভাত শেষ হয়েছে খেয়াল করে নি মনোতোষ। অভ্যাস বসেই খালি থালা থেকে খাবার তোলার জন্য হাত বাড়াতেই শব্দ করে হেসে ওঠে দুই ছেলে মেয়ে।ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লজ্জায় পড়ে যায় মনোতোষ।ছন্দা একটা থালায় ভাত নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে , আর চাট্টি ভাত দেব ?
সে হাত তুলে বলে , আরে না না। আর খেতে পারব না।
--- কিন্তু এই যে দেখলাম পাতে কিছুই নেই অথচ হাত নামিয়ে খাবার তুলতে যাচ্ছিলে।
স্ত্রীর কথায় মনো খুব অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তবু সবার সামনে সত্যি কথাটাই প্রকাশ করে দেয়। ছন্দার প্রশ্নের উত্তরে বলে , আসলে খেতে খেতেই ছেলেবেলায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। আনমনে খেয়ালই ছিল না খাবার শেষ হয়ে গিয়েছে।তার কথা শুনে মা - ছন্দা তার দিকে চেয়ে থাকে।কেউ কোন কথা বলে না। শুধু বিচ্ছু দুটোকে তার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসতে দেখে মনোতোষ।

                              ( ক্রমশ )



নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                 ----০---


No comments:

Post a Comment