( কিস্তি --- ৭৫ )
মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আইনের রেলিং।ছেলের মাথায় হাত রেখে মনোতোষ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন , যত দ্রুত সম্ভব আইনী রেলিংয়ের বাঁধা সরিয়ে তাকে বের করে আনবেনই আনবেন।সেই আশ্বাস দিয়েই ছেলের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে বেড়িয়ে আসেন মনোতোষ।রাতটা ভোম্বলকাকাদের বাড়িতে কাটিয়ে খুব সকাল সকাল তারা পৌঁচ্ছে যান বিনয়বাবুর বাড়ি।রামপুরহাট বারে দুঁদে উকিল হিসাবে পরিচিতি রয়েছে বিনয়বাবুর।সব কিছু শোনার পর তিনি ওকালতনামায় মনোতোষের সই করিয়ে সেই দিনই সূর্যের জামিনের আবেদন করেন। উদ্বিগ্ন স্বরে মনোতোষ বিনয়বাবুকে জিজ্ঞেস করেন , উকিলবাবু আজ ছেলের জামিন হবে তো ?
বিনয়বাবু বলেন , দেখুন মামলার রায় সম্পর্কে আগে থেকে কিছুই বলা যায় না।তবে আমার ধারণা জামিন তো হবেই , মামলাটা পুরোপুরি খারিজও হয়ে যেতে পারে।দেখুন কি হয়। আপনার বরং এখন আদালত কক্ষে গিয়ে বসুন। যথা সময়ে আমার মুহুরি আপনাদের ডেকে নেবেন।
উকিলবাবুর কথা মতো তারা আদালতে হাজির হন। বাঁধানো বট তলায় বসেন সবাই। কিছুক্ষণ পরে আরও অনেক অভিযুক্তের সঙ্গে সূর্যকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আদালতের লক আপে নিয়ে আসে পুলিশ।ছেলেকে ওই অবস্থায় দেখে চোখ ফেটে জল আসে মনোতোষের।সেখান থেকেই তিনি লক্ষ্য করেন সূর্যকে ওই অবস্থায় দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না ছন্দা আর সুস্মিতা। তারা ছুটে সূর্যর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু কয়েকজন পুলিশ অসভ্যের মতো তাদের ঠেলে সরিয়ে দেয়।কিছুতেই তাদের সূর্যের কাছে ঘেঁষতে দেয় না।
সেটা লক্ষ্য করে এগিয়ে যান ভোম্বলকাকা।পুলিশগুলোর সঙ্গে চুপিচুপি কথা বলার পর কিছু টাকা তাদের হাতে তুলে দেন। তার পরই ম্যাজিকের মতো কাজ হয়। বটতলাতে বসেই মনোতোষ দেখতে পান যে পুলিশগুলো একটু আগেই ছন্দাদের হঠিয়ে দিচ্ছিল তারাই আবার ওদের ডেকে সূর্যের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এমনকি এক ফাঁকে ভোম্বলকাকাকে পুলিশগুলোর জন্য চা আর সূর্য্যের জন্য কিছু খাবারও নিয়ে যেতে দেখা গেল। এখানেও ঘুষ ! কথাটা তুলতেই ভোম্বলকাকা বলেন , কিচ্ছু করার নেই। যে দেশের যা দস্তুর।
কথাটা শুনে খুব ঘৃণা হয় মনোতোষের।ভোম্বলকাকা বলেন , আগে থেকে যোগাযোগ করে ওদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলে আর কোমরে দড়ি লাগাত না। মনোতোষ ভেবে পায় না তাহলে যাদের টাকা নেই তাদের কি হবে ? সব ক্ষেত্রে সব সুযোগ সুবিধাগুলো কি টাকাওয়ালারাই হাতিয়ে নেবে ? প্রশ্নগুলো তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতেই থাকে। সেই সময় বিনয়বাবুর মুহুরি নারায়ণবাবু তাদের আদালত কক্ষে ডেকে নিয়ে যান। আদালত কক্ষে তিল ধারণের জায়গা নেই।কেমন করে যেন সবাই মামলার বিষয়টি জেনে গিয়েছেন।তাই মামলার গতি প্রকৃতি জানতে আদালতে ভীড় জমিয়েছেন তারা।বারের অন্যান্য উকিলবাবুরা ভেঙে পড়েছেন আদালত কক্ষে।
যথারীতি সরকারি উকিল অনিলবাবু এবং বিনয়বাবু নিজের আসনে বসে মামলার নথিপত্রে চোখ বুলিয়ে নেন। সেই সময়ই সূর্যকে নিয়ে এসে আদালত কক্ষের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে যায় কয়েকজন পুলিশ।ছেলেকে দেখে উতলা হয়ে পড়েন ছন্দা। মনোতোষেরও ছেলের কাছে গিয়ে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে খুব ইচ্ছা করে। এই কয়েকদিনেই ছেলেটা কত রুগ্ন হয়ে গিয়েছে। গালে অবিন্যস্ত চিকন দাড়ি। চোখে উদাসীন দৃষ্টি। মনে হয় যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে যুবক মনোতোষ। বুকের ভিতরটা হু- হু করে ওঠে তার। এই ছেলেকে ছেড়ে তিনি বাড়িতে থাকতেই পারবেন না। পরম নিষ্ঠায় তিল তিল করে যে ছেলেমেয়ে দুটোকে মানুষ করেছেন তিনি। তার নিষ্ঠায় তো ফাঁকি ছিল না।রাষ্ট্রব্যবস্থার অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে তারা।সেই সময় আচমকা ক্ষণেকের জন্য চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। আদালতে প্রবেশ করেন বিচারক। অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও উঠে দাঁড়িয়ে বিচারককে অভিবাদন জানান। শুরু হয়ে যায় বিচার প্রক্রিয়া। উকিলবাবুরা সওয়াল জবাব শুরু করে দেন।
প্রথমেই সরকারি পক্ষের উকিল অনিলবাবু সূর্যের জামিনের বিরোধিতা করে বলেন , ধর্মাবতার আমরা জানি পিতৃহত্যা মহাপাতকের কাজ। যে সন্তানকে বাবা নিজে না খেয়ে তার মুখে আহার তুলে দেন , সমস্ত ঝড়ঝাপটা থেকে ছাতা হয়ে সন্তানকে রক্ষা করেন , সর্বোপরি যে মানুষটি তাকে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন সামান্য একটি চাকরির জন্য সেই মানুষটিকেই যে সন্তান পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল তার জেলের কুঠুরির অন্ধকারে থাকাই উচিত। জামিনের পরিবর্তে আমি তার চরম শাস্তি প্রার্থনা করি।
সরকারি পক্ষের আইনজীবি থামতেই বিচারকের অনুমতি নিয়ে বিনয়বাবু উঠে বলতে শুরু করেন --- ধর্মাবতার কে কাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল সেটা প্রমাণ সাপেক্ষ।আমার বন্ধু তার চরমতম শাস্তি দাবি করার আগে তার ধারে পাশেও যান নি। এক্ষেত্রে কেউ কোন অভিযোগ করে নি। পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে খুনের চেষ্টার মামলা দায়ের করেছে। কিন্তু যাকে খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল তার কোন বয়ান রেকর্ড করে নি পুলিশ। অভিযোগের স্বপক্ষে কোন স্বাক্ষ্য প্রমাণও দাখিল করে নি।আদালত অনুমতি দিলে আমি যাকে খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল তাকে কাঠগড়াতে ডাকতে চাই।কারণ আমি মনে করি এই মামলায় সর্বাগ্রে তার বয়ান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিনয়বাবুর কথা শুনে বিচারক একবার সামনের দিকে তাকিয়ে নেন। তারপর অনুচ্চ স্বরে বলেন -- অনুমতি দেওয়া হোল।
স্বাক্ষীর কাঠ-গড়ায় ডাক পড়ে মনোতোষের। সেখানে গীতা ছুঁইয়ে তাকে সত্য বলার শপথ করিয়ে নেওয়া হয়। বিনয়বাবু কাঠগড়ার কাছে এসে বলেন , আচ্ছা মনোতোষবাবু সেদিন ঠিক কি হয়েছিল আপনি আদালতের কাছে খুলে বলুন তো।
বিনয়বাবুর কথা শুনে দোটানায় পড়ে যান মনোতোষ।উকিলবাবুর শেখানো কথা বলতে গেলে মিথ্যা বলতে হয়। গীতা ছুঁয়ে সেটা বলা পাপ।আবার সত্যি বললে সূর্যকে বাঁচাতে পারবেন না। কি করবেন তিনি এখন ? সেই দোটানার মধ্যেই তার মনে পড়ে যায় গীতার মর্মাথ।গীতাতেই তো বলা হয়েছে , রণে ছলনার আশ্রয় নেওয়াটা কোন অক্ষত্রিয় জনিত কাজ নয়। আর মুলত যার উপদেশ সম্বল করে ওই ধর্মগ্রন্থ রচিত হয়েছে সেই শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশেই তো অপরাজেয় দ্রোণাচার্যকে বিভ্রান্ত করার জন্য সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরকে দিয়েও ' অশ্বথামা হত ইতি গজ ' এই কথাটি বলানো হয়েছিল। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এটাও তো একটা যুদ্ধ।সেই যুদ্ধের চক্রবুহে আটকে পড়া সন্তানকে যে করেই হোক তাকে উদ্ধার করতেই হবে।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বিচারক তাড়া লাগান -- কই কি হলো কিছু বলুন। চুপ করে থেকে আদালতের মুল্যবান সময় নষ্ট করবেন না।
অগত্যা মুখ খুলতে হয় মনোতোষকে। শেষ পর্যন্ত অপত্য স্নেহের জয় হয়। অপত্য স্নেহের টানেই উকিলের শেখানো কথাই ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেন তিনি।নিস্তব্ধ আদালত কক্ষে শোনা যায় তার কন্ঠস্বর -- সেদিন ছিল বৃষ্টি বাদলার দিন।রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে উঠেছিল।অন্যান্য দিনের মতোই আমাকে সাইকেলে চাপিয়ে স্কুলে পৌঁচ্ছে দিতে যাচ্ছিল আমার ছেলে সূর্য। পড়ো শিব মন্দিরের কাছে একটা বড়ো পাথর পড়ে ছিল।পিচ্ছিল রাস্তায় টাল সামলাতে না পেরে সাইকেল থেকে পড়ে যায় সূর্য। আমিও পাথরের উপর আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।
তার কথা শেষ হতে না হতেই না হতেই সরকার পক্ষের উকিল উঠে দাঁড়িয়ে বলেন , অবজেকশান ইয়োর অনার। উনি আদালতে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলছেন। পুলিশ রিপোর্ট বলছে , কর্মরত অবস্থায় মৃতের পোষ্য হিসাবে চাকরি পাওয়ার জন্যই পাথর দিয়ে বাবাকে খুনের চেষ্টা করে অভিযুক্ত। এখন ছেলেকে বাঁচানোর জন্য উনি শেখানো বুলি আউড়াচ্ছেন।
সরকারি আইনজীবির বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিনয়বাবু বলতে শুরু করেন -- এই প্রসঙ্গে আমার একটা কথা বলার আছে , মাস্টার ডিগ্রী করা একটা ছেলেকে কেন চাকরি পাওয়ার জন্য বাবাকে খুন করতে হবে ? কেন সরকার তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে না ? তাহলে কি পরোক্ষে বাবাকে খুনের প্ররোচনার দায় সরকার এড়াতে পারে ?
সেক্ষেত্রে তো সর্বাগ্রে রাষ্ট্রনায়কদেরই শাস্তি হওয়া উচিত। কারণ খাদ্য , বস্ত্র , বাসস্থানের মৌলক অধিকার সুনিশ্চিত করার শপথ নিয়েই তারা ক্ষমতাসীন হন। কিন্তু অনেকাংশেই তারা সে কথা ভুলে যান।
কেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধেই বা কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না ?
বিনয়বাবুর বক্তব্যের পর গুঞ্জন উঠে আদালত কক্ষে।সবার মুখ চোখের ভাব দেখেই মনে হয় ওই বক্তব্যের সঙ্গে তারাও একমত।শুধু কিছুটা বিব্রত দেখায় সরকার পক্ষের আইনজীবিকে।পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার জন্য তিনিও উঠে দাঁড়িয়ে বলেন , এই মামলার সঙ্গে ওই বক্তব্যের কোন সাযুজ্য নেই। তাই আমার মনে হয় অবান্তর প্রসঙ্গের অবতারণা করে আমার বন্ধু আদালতের মুল্যবান সময় নষ্ট করছেন।
---- মাননীয় ধর্মাবতার এই প্রসঙ্গ মোটেই অবান্তর নয়। আর পুলিশই তা উত্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। এটাকে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে না দেখে সমস্যার মূলে গিয়ে পর্যালোচনা করা উচিত বলেই মনে করি। ভালো রেজাল্ট করেও এতো বেকার ছেলেমেয়ে চাকরি পাচ্ছে না কেন ? তাহলে কারাই বা চাকরি পাচ্ছে তা এই প্রেক্ষাপটে বিবেচ্য।
--- নিশ্চয় ওরা ভালোভাবে চাকরির পরীক্ষা দিতে পারে নি।
---- মাননীয় ধর্মাবতার , আমার বন্ধু বেশ ভাল যুক্তি দেখিয়েছেন। ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পারে নি। আমাদের তাহলে জানা দরকার কারা ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পারেন নি।আর কারা ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পেরেছেন। একটা উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে।ওই যে যুবকটিকে দেখছেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে , আমরা এতক্ষণে সবাই জেনে গিয়েছি চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে চাকরি হাতানোর জন্য নাকি বাবাকে খুন করতে গিয়েছিল।
কিন্তু আমরা যা জানি না সেটা হল , ওই যুবকটি বি,এস,সি'তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। এখন আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে একই সরকারের শিক্ষা দফতেরর প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় যে ছেলেটি উত্তীর্ণ হতে পারল না সেই ছেলেটিই কি করে বি,এস সি'তে ফার্স্ট ক্লাস পায় ? তাহলে কোনটা ঠিক ধর্মাবর্তার ? আমার প্রার্থনা এই প্রেক্ষাপটে আদালত এই বিষয়টির রহস্য উদঘাটনের নির্দেশ দিক। তাহলে হয়তো সত্যি , সত্যিই চাকরি জন্য কোন ছেলেকে পিতৃহন্তা হতে হবে না।
ব্যাপক গুঞ্জনের মধ্যে শেষ হয় সেদিনের সওয়াল জবাব।পরদিন রায় দেওয়ার ঘোষণা করে আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান বিচারক।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment