( কিস্তি ---- ৭৩ )
তারপরই সেই অভিশপ্ত দিনটা আসে। সে দিন সকাল থেকে খুব মেঘ করেছিল। আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন , মাঝে মাঝে এক আধ পশলা বৃষ্টি পড়ছিল। অন্যান্য দিনের মত সে দিন আর চাকরির খোঁজে বেরোয় নি সূর্য। তাকে কেমন যেন অস্থির দেখাচ্ছিল।ছন্দা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন -- কি রে আজ আর কোথাও বেরোবি নাকি ?
--- না আজ আর কোথাও যাব না। বাবাকে বরং স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসি , অন্যমনস্ক ভাবে কথা গুলো বলে সূর্য।
--- সেই বরং ভালো হবে। রান্না হয়ে গিয়েছে। স্নান করে বাবার সঙ্গে বসেই চাট্টি খেয়ে নে।
ছেলের কথায় মনে মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি পান ছন্দা। বৃষ্টি বাদলার দিনে কোথায় ঘুরে ঘুরে বেড়াবে তার ঠিক নেই। তার চেয়ে বাবাকে স্কুলে পৌঁচ্ছে দিয়ে আসাই ভাল। 'রেনি - ডে'র ছুটি হয়ে গেলে একেবারে নিয়েও আসতে পারবে। সেই ভেবেই বাবা-ছেলেকে পাশাপাশি খেতে দেন। খেতে খেতেও অন্যমনস্ক দেখায় সূর্যকে। আজ কাল অবশ্য সব সময়ই অন্যমনস্ক থাকে সে। কিন্তু আজ যেন বেশি অনমনস্ক দেখায় তাকে। মুখ দেখেই বোঝা যায় কিছু একটা চিন্তা যেন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মনের মধ্যে। অন্যমনস্ক মন নিয়েই সাইকেল বের করে দরজার সামনে দাঁড়ায় সূর্য।মনোতোষ রডে বসে ছেলের মাথার উপর উঁচু করে ছাতাটা মেলে ধরেন।সাইকেল এগিয়ে যায় স্কুলে পথে।দুগগা দুগগা বলে দুহাত কপালে ঠেকান ছন্দা। তার মনে পড়ে যায় মনোতোষও একদিন বাবাকে ওইভাবে সাইকেলে চাপিয়ে স্কুলে যেত।
বাবাও ওইভাবেই ছেলের মাথায় ছাতা মেলে ধরে থাকতেন।পার্থক্য কেবল একটাই , সেদিন ওরা বাবা-ছেলে দু'জনেই ছিলেন শিক্ষক।আজ বাবাই শুধু শিক্ষক।সেই কথা ভেবেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে ছন্দার।ছেলের যন্ত্রণার কথা ভেবে তার যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়।ভুলে থাকতে গৃহকাজে মন দেন তিনি।মনোতোষও যেতে যেতে ছেলেকে বেকারত্বের জ্বালা ভোলাতে বলেন , দেখিস চিরদিন এমন যাবে না।চিন্তা করিস না।আমার তো আর এক বছর চাকরি আছে।অবসর নেওয়ার পর বাড়িতেই বাচ্চাদের স্কুল খুলব।সেখানে বিনা পয়সায় আমরা বাচ্চাদের প্রকৃত শিক্ষার পাঠ দেব।সে দিন কচি-কাঁচাদের কলকাকলি তোকে সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেবে দেখিস।
সূর্য কোন প্রত্যুত্তর করে না।মনোতোষ তবু বলেই চলেন তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। সেই সময় বৃষ্টিটা একটু ঝেঁপে আসে , সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া।ছাতায় আর বৃষ্টি আটকায় না।পড়ো শিব মন্দিরটার কাছে সাইকেল থামায় সূর্য। মনোতোষ ভাবেন ভিজে যাওয়ার আশঙ্কাতেই বোধহয় এখানে দাঁড়িয়েছে সূর্য।ভালোই হবে বৃষ্টিটা ধরে গেলেই না হয় যাওয়া যাবে স্কুলে। সেই ভেবে মন্দিরের ভগ্নপ্রায় ভোগ ঘরে গিয়ে দাঁড়ান মনোতোষ। তখন কেউ কোথাও নেই। একটা কুকুর কেবল কুন্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে আছে কোনে।তাকে দেখে কিছুক্ষণ ভুক ভুক করে ফের মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ে কুকুরটা।ছেলেকে ডাকেন মনোতোষ -- সাইকেল থাক, তুই চলে আয়। ভিজিস না ঠান্ডা লেগে যাবে।
কোন সাড়া দেয় না সূর্য।কিন্তু ভোগঘর থেকেই মনোতোষ দেখতে পান সূর্য একটা মোটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে আসছে তার দিকে। তার মাথায় তখন যেন খুন চেপে গিয়েছে। কি ঘটতে চলছে অনুমান করতে অসুবিধা হয় না তার। কিন্তু এতে যে হিতে বিপরীত হবে। চাকরি তো পাবেই না , উল্টে খুনের দায়ে হয়তো সারা জীবন জেলে পচে মরতে হবে ছেলেটাকে।
মুহুর্তে তার মনে পড়ে যায় মানসের কথা।ওই ভাবে মরলে তবু তার চাকরিটা সূর্য পেলেও পেতে পারে।ছেলের যন্ত্রণা দূর করতে তাই করবে সে। মানস পারলে সে'ই বা কেন পারবেন না ? চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে মনোতোষের। হাত তুলে ছেলেকে নিরস্ত করতে বলেন -- ওরে এত বড়ো ভুল করিস না বাবা।
তোর যন্ত্রণাটা আমি বুঝি।লক্ষ্মী বাবা আমার , আমাকে আজকের দিনটা সময় দে। আমিই তোর চাকরি পাওয়ার পথটা পরিস্কার করে দিয়ে যাব। কিন্তু মহাপাতকের কাজ তুই করিস না বাবা।
কিন্তু বৃষ্টিতে চাপা পড়ে তার আর্তি।সূর্য ছুটে এসে পাথরটা দিয়ে বাবার মাথায় সজোরে আঘাত করে বসে।আর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মনোতোষ।তার আর্ত চিৎকারে ভারী হয়ে উঠে বাতাস।ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে গিয়ে লাগে সূর্যর চোখে মুখে , বাবার রক্তে ভিজে যায় তার পরনের জামা।সেই রক্ত মেখেই মাটিতে লুটিয়ে পড়া বাবাকে ঘিরে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে সূর্য পাগলের মতো বলেই চলে , হু, হু, এবার আমার চাকরি পাকা। আর আমাকে কেউ বেকার , ধর্মের ষাঁড় বলতে পারবে না।
তারপর বাবাকে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এক সময় সূর্যও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।ছন্দার কাছে খবরটা যখন পৌঁছোয় তখন স্কুলের শিক্ষক আর গ্রামের লোকেরা মনোতোষকে রামপুরহাট হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। আর সূর্যকে গণপ্রহার দিয়ে তুলে দিয়েছে পুলিশের হাতে।খবর শোনার পরই কি করবেন কিছু ভেবে উঠতে পারেন না ছন্দা।
মাথার উপর পুরুষ মানুষ বলতে রয়েছেন বাবা।কিন্তু তিনি তো শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রয়েছেন।তাই কি করবেন , কোথায় যাবেন তা ভেবে কোন কুল কিনারা পান না। মায়ের এই অসহায় অবস্থা দেখে সুস্মিতা বলে , মা কাউকে কিছু বলতে হবে না। আমরাই আগে গিয়ে দেখি। তারপর নিশ্চয় কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
মেয়ের কথাটা মনে ধরে ছন্দার।পরিস্থিতি দেখে তখন না হয় নিশ্চিন্তপুরে প্রভাতদাদের খবর দেবে।সুধাকাকী আর নেই। কিন্তু রুম্পাদি -- প্রভাতদারা তো আছে। এই বিপদের দিনে তারা নিশ্চয় তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।প্রভাতদাদের কাছে ফোন নম্বর নিয়ে অম্লান কাকুকেও খবর দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে।অম্লানকাকুর সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ নেই , কেমন আছেন কে জানে , কিন্তু এই বিপদের কথা শুনলে তিনিও নিশ্চয় পাশে এসে দাঁড়াবেন।
সেই মতো গোপনে জমানো কিছু টাকা আর সোনার হারটা সঙ্গে নিয়ে মা-মেয়ে রামপুরহাটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। হাসপাতালে পৌঁছেই দেখতে পান বেডে একাকী পড়ে রয়েছেন মনোতোষ।অক্সিজেন আর স্যালাইন চলছে।কেউ কোথাও নেই। তাদের দেখে এগিয়ে আসেন একজন নার্স। ছন্দাকে জিজ্ঞেস করেন , আপনাদের পেশেন্ট ?
ছন্দা ঘাড় নেড়ে হ্যা বলতেই , তীব্র ভৎর্ষনা করে নার্সটি বলতে শুরু করেন , কেমন লোক আপনারা ? সেই যে ভর্তি করে দিয়ে চলে গেলেন আর পাত্তাই নেই। যত দ্রুত সম্ভব অপারেশান করাতে হবে , দু বোতল রক্ত চাই। কিন্তু কথাটা বলব কাকে ? কেউ থাকলে তো ? খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম।বিনা চিকিৎসায় মারারই যদি ইচ্ছা ছিল তাহলে এখানে আনারই বা কি দরকার ছিল ? এখন আপনারা এসেছেন চটপট রক্তের ব্যবস্থা করুন।
ছন্দা বুঝতে পারেন আইনী ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কাতেই হয়তো যারা মনোতোষকে নিয়ে এসেছিলেন তারা ভর্তি করিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছেন। ছেলেটা কি অবস্থায় আছে কে জানে ?
কিছু ভাবার অবকাশ নেই তার। নার্সের কথা শুনেই চরম দুশ্চিন্তায় পড়েন তিনি।একা মেয়েকে নিয়ে এই শহরে কি ভাবে রক্তের ব্যবস্থা করবেন তা ভেবে পান না। দু-চোখে যেন অন্ধকার নেমে আসে তার। তারই মধ্যে প্রভাতদের কথা ভেবে যেন এক চিলতে আশার দেখতে পান। সেই আশাতেই রিক্সা নিয়ে প্রভাতদাদের বাড়ির দিকে রওনা দেন তারা। সেই কবে এসেছিলেন ছন্দা , এখন অনেক বদলে গিয়েছে জায়গাটা। তবুও আন্দাজে আন্দাজে রিক্সাওয়ালাকে বলে প্রভাতদাদের বাড়ির দরজার সামনে পৌঁছোন তারা। বাড়ির সামনে রিক্সা থামতে দেখে এগিয়ে আসে রুম্পা আর প্রভাত। তাদের দেখে প্রথমে কিছুটা আশ্চর্য হয়ে যায় তারা। তারপর বাড়িতে যেতে বলে। কিন্তু ছন্দা বলেন, বাড়িতে এখন যাওয়ার সময় নেই। প্রভাতদা তোমাকেই এখন আমাদের সঙ্গে হাসপাতালে যেতে হবে।
তারপর ঘটনার কথা তাদের সবিস্তারে খুলে বলে ছন্দা।সব শুনে ভ্রু কুঁচকে যায় প্রভাতদার।মাথা নেড়ে সে বলে , এতো পুলিশী ব্যাপার। আমার প্রমোশনের কথা চলছে।আমি তো এখন এই ঝামেলায় জড়াতে পারব না।শেষে চাকরি নিয়েই না টানাটানি হয়ে যায়।
প্রভাতদার কথা শুনে দু'চোখে অন্ধকার নেমে আসে ছন্দার। বড়ো আশা নিয়ে সে এখানে ছুটে এসেছিলেন। এখন কি করবেন ? আচমকা তার অম্লানকাকুর কথা মনে পড়ে। সে প্রভাতদাকে জিজ্ঞেস করে , তোমার কাছে অম্লানকাকুর ফোন নম্বর আছে ?
---- আছে। কিন্তু অম্লানকাকুর সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিন যোগাযোগ নেই।তবু ফোন করে দেখতে পারো।বড় পদে ছিলেন , ওদের চারিদিকে যোগাযোগ থাকতে পারে।
বলে একটা কাগজে ফোন নম্বরটা লিখে তার হাতে ধরিয়ে দেয় প্রভাতদা। তারপর ওরা আর একটাও কথা বলে না। মুখের ভাব দেখেই বোঝা যায় বিদায় করতে পারলেই যেন বাঁচে। অগত্যা তাদের বিদায় জানিয়ে মেয়েকে নিয়ে টেলিফোন বুথের দিকে এগিয়ে যান ছন্দা। যেতে যেতেই তার মনে পড়ে যায় এই রুম্পাদিকেই আত্মহত্যার পথ থেকে সরিয়ে এনে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন তার শ্বশুরমশাই।প্রভাতদার চাকরির ব্যবস্থা করে নিজের বাড়িতে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।
আর আজ প্রমোশন আটকে যাওয়ার অজুহাতে তার স্বামী মৃত্যু সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে শুনেও এড়িয়ে গেল ওরা ! তাহলে গ্রামের লোকের আর কি দোষ দেবে ? প্রভাতদার মতো একজন শিক্ষিত মানুষ যদি এভাবে এড়িয়ে যায় তাহলে গ্রামের মানুষেরা তো হাসপাতালে ফেলে পালাতেই পারে। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মন নিয়ে টেলিফোন বুথে পৌঁছোন তারা। কিন্তু অম্লানকাকুকে ফোন করে আশার শেষ প্রদীপটুকুও নিভে যায়। সব শুনে অম্লানকাকু বলেন , আমার বয়েস হয়েছে। অবসর নিয়েছি। এই অবস্থায় আমিই বা কি করতে পারি বলো ?
ওই কথা শোনার পর ছন্দার মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে। মাথাটা চেপে ধরে টেলিফোন বুথের সামনে বসে পড়েন তিনি।হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় ভোম্বলকাকার কথা। ভোম্বলকাকাও পিকনিকে আর তাদের বিয়েতেও গিয়েছিলেন। বার বার বলেছিলেন, রামপুরহাট গেলেই যেন তাদের বাড়ি যায়। কোনও রকম সমস্যায় পড়লে তাকে জানাতে যেন ইতস্তত না করি। কিন্তু প্রভাতদা আর রুম্পাদির কথা ভেবে মনটা কিছুটা দমে যায়। উপকৃত মানুষগুলোই যদি অকৃতজ্ঞের মতো সব ভুলে যায় তাহলে ভোম্বলকাকাই বা তাদের কথা মনে রাখবেন কেন ? কিন্তু ডুবন্ত মানুষ কিছু না পেলে খড়কুটো ধরেও বাঁচতে চায়।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment