Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৬৯






     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











             কালের কারিগর
              


                       অর্ঘ্য ঘোষ

                        ( কিস্তি --- ৬৯ ) 



কিন্তু পরদিন সকালেই ফের চাপের মুখে পড়তে হয় তাকে। সবে তখন চা খেতে বসেছে তারা। সেই সময় দলবল নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে  সৌমেন। তাদের দেখে অবাক চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মনোতোষ।ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেলামেশা থাকলেও সৌমেনের সঙ্গে তার  কথাবার্তা নেই বললেই চলে। তাই সাত সকালে এভাবে সৌমেনদের বাড়িতে আসার কোন কারণ খুঁজে পায় না সে। তাহলে কি ভোটের প্রচার করতেই এলো ওরা ? তাই-ই হবে হয়তো। সৌমেন তো এখন বিরোধী দলের নেতা। সৌমেনই তার ভুল ভেঙে দেয়। মনোতোষকে উদ্দেশ্য করে সে বলে , শুনলাম শাসক দলের লোকেরা নাকি কলেজের টাকা আর কাগজ পত্র সব নিতে এসেছিল ? 
--- হ্যা, জবাব দেয় মনোতোষ।
---- তোমরা কি বললে ? 
---- কি আর বলব ? বললাম কমিটির দু-চারজন সদস্যকে নিয়ে আসুন , তারা সম্মতি দিলে সব তুলে দেব আপনাদের হাতে।
---- কিন্তু ভোটের আগে তা তো দেওয়া চলবে না।কলেজ করে ওদের কিছুতেই ভোটের ফায়দা তুলতে আমরা দেব না।
---- কারা ভোটের ফায়দা তুলবে না তুলবে তা নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। কলেজের ওই টাকার জন্য চোর বদনাম নিয়ে একজনকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তাই আমি আর আমার পরিবারের কারো উপর ওই টাকার অশুভ ছায়া পড়তে দেব না।আমরা কমিটির হাতে টাকা ফিরিয়ে দেব।পারলে তোমরা তাদের কাছে গিয়ে আটকে দিও।
মনোতোষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মা যেমন নিঃশব্দে এসেছিলেন, কথাগুলো বলে ঠিক সেই ভাবেই রান্নাঘরে ফিরে যান।
----- তোমারও কি মত তাই ? প্রশ্নটা করে মনোতোষের দিকে চেয়ে থাকে সৌমেন।
---- ছোটবেলা থেকেই আমি বাবা--মায়ের মতের বাইরে যাই নি। আজও যেতে পারব না। মায়ের মতই আমার মত।
--- বেশ , তাহলে দেখি আমরা কি করতে পারি।
কথাটা বলেই রাগী রাগী মুখ করে বাড়ি ছাড়ে সৌমেনের দল। সৌমেনদের আচরণ মনোতোষকে খুব বিস্মিত করে। বাবার মুখেই সে শুনেছিল সৌমেনের বাবা কুণালরা কলেজের জন্য এক কানাকড়ি চাঁদা তো দেয় নি , উল্টে চোর বদনাম রটিয়ে তাকে আত্মহননের পথে ঠেলে দিয়েছিল। আর তারই ছেলে সব জেনেও সেই টাকার উপরেই খবরদারি করতে এসেছে। লজ্জাও করে না সব। বিরোধী দলে থাকলে কি সবেতেই বিরোধিতা করতে হবে ? ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে মানুষের এতদিনের একটা আশায় জল ঢেলে দিতে হবে। রাজনীতির প্যাঁচপোঁচ অত বোঝেন তিনি। রাজনীতি নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তবু তার মনে প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে।




                               তাই বিক্ষিপ্ত মন নিয়েই স্কুলে যান মনোতোষ। কলেজের কাগজপত্রগুলো হস্তান্তর করা নিয়ে তার মনটা খুব চঞ্চল হয়ে পড়ে। যা রক্ষা করতে বাবা নিজের জীবন দিয়ে গিয়েছেন , তা মিথ্যা কথা বলে হাতিয়ে নিয়ে অন্য কিছু করবে না তো ওরা ? সেই আশঙ্কাতেই মনটা কিছুতেই স্থিরতা পায় না। বিক্ষিপ্ত মন নিয়েই  স্কুল থেকে ফেরেন নতিনি। বিকালের দিকেই কলেজের সংগঠক কমিটির ৪ জন সদস্যকে নিয়ে শাসক দলের নেতারা পৌঁছোন। তাদের মনোতোষ ভালো করেই চেনেন।পাশের গ্রামেই বাড়ি।বাবা বেঁচে থাকাকালীন প্রায়ই কলেজ নিয়ে আলোচনা করতে আসতেন। তার মধ্যে ফিক্সড ডিপোজিটে বাবার পাশাপাশি বিনয়কাকা আর শক্তিকাকারও নাম রয়েছে।সবাইকে বৈঠকখানা ঘরে বসিয়ে মনোতোষ শক্তিকাকাদের জিজ্ঞেস করে -- কাকা আপনারা সব শুনেছেন নিশ্চয়। আপনাদের কি মত ?
--- দেখ বাবা , আমরা তো একদিন টাকা জমি সব কলেজ গড়ার জন্যই যোগাড় করেছিলাম। কিন্তু আমরা তো কলেজ গড়তে পারি নি। তাই এরা যখন গড়ব বলছে তখন টাকা জমি ওদের হাতে তুলে দেওয়াই ভাল।
মনোতোষও আর দ্বিরুক্তি করেন না। আলামারি থেকে বের করে আনেন কলেজের সমস্ত নথিপত্র। সেগুলো খুলে বাবার কাজ দেখে বিস্মিত হয়ে যায় মনোতোষ। যে বাবা নিজের সংসারের হিসাবের কোন ধার ধারতেন না , সেই বাবাই কি সুন্দর করে পরিপাটি ভাবে গুছিয়ে রেখেছেন কলেজের সব কাগজ - পত্র। প্রথমেই রয়েছে তার কাছে জমা থাকা সমস্ত নথিপত্রের একটা তালিকা।চাঁদার হিসাব থেকে শুরু করে জমি রেজিস্টারি সহ অন্যান্য সমস্ত খরচের খুঁটিনাটি হিসাব লিখে রেখে গিয়েছেন বাঁধানো খাতায়। এমন কি ফিক্সড ডিপোজিটের নবীকরণের তারিখও চিরকুটে লিখে গেঁথে রেখেছেন। সেই চিরকুট দেখেই হিসাব কষে দেখা গেল সংগৃহিত টাকা সুদে আসলে দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে। বাবার তৈরি করে যাওয়া তালিকা মিলিয়ে প্রতিটি নথিপত্র শাসক দলের নেতাদের হাতে তুলে দেন মনোতোষ। সেগুলো হাতে নিয়ে যুদ্ধ জয়ের মেজাজে চলে যান শাসক দলের নেতারা। এতদিন ওই সব নথিপত্র রক্ষা করার জন্য সৌজন্যের খাতিরে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দেওয়ার প্রয়োজন করেন না তারা। নিতান্তই বলতে হয় তাই বলার মতো করে কলেজের নতুন কমিটিতে তাকে থাকার জন্য বলেন। মনোতোষ সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। যাদের জন্য বাবাকে চোর বদনাম নিয়ে আত্মহত্যা করতে হয়েছে তাদের গড়া কমিটিতে সে কিছুতেই থাকতে পারবে না। তিনি স্কুল, কোচিং আর নিজের সংসার নিয়েই থাকতে চান। এখন তারও বাবার মতো কয়েক জন সান্ধ্য আসরের বন্ধু জুটেছে। তাদের সঙ্গে হারু  বাগদি , বোধন দলুই , ধুলু ভল্লা , শ্রীপতি মণ্ডলদের মতো ভুবনবাবুর অনুগত কয়েকজনও যোগ দিয়েছেন।তাদের সঙ্গেই গল্প গুজব করেই কেটে যায় সন্ধ্যাটা। 




                   তারই মধ্যে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হয়। সুস্মিতা সেকেন্ড ডিভিশন আর শ্রাবন্তী টেনেটুনে পাশ করে। শ্রাবন্তীর অবশ্য তা নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই। ভালো রেজাল্ট নয় , তাদের পরিবারে পাশ করাটাই কৃতিত্বের ব্যাপার।সুস্মিতার সঙ্গে আর্টস নিয়ে গ্রামের স্কুলেই ভর্তি হয় শ্রাবন্তীও। এখন আর আগের মতো শ্রাবন্তীদের বাড়ি যাওয়া হয় না সূর্যর। সামনের তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। তাই পড়া নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। নানা অছিলায় শ্রাবন্তীই মাঝে মধ্যে সূর্যদের বাড়িতে হাজির হয়। সুস্মিতা তাদের একান্তে কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ করে দেয়।তারই মাঝে ভোটের দামামার সঙ্গে একদিন বেজে ওঠে কলেজ উদ্বোধনের মাইক। মাইকের শব্দে বিষন্ন হয়ে যায় সাধনার মন। সেই কলেজ হলো, কেবল মানুষটাই দেখে যেতে পেলেন না। বৈঠকখানা ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো স্বামীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে সাধনা বলে চলেন , তোমায় বলেছিলাম না তোমার স্বপ্ন একদিন সার্থক হবেই। তোমার স্বপ্ন সার্থক হয়েছে গো। শুনতে পাচ্ছ মাইক বাজছে , মানুষের মনে আনন্দ আর ধরে না। তুমিই শুধু অভিমান করে আমাকে ফেলে চলে গেলে। আমি যে তোমার কাছে যাব তারও উপায় রাখো নি। ছেলে-বৌমা, এই সংসারের দায়িত্ব যে যাওয়ার আগে তুমি আমাকেই দিয়ে গিয়েছো। তোমার দেওয়া দায়িত্ব আমি কি করে অস্বীকার করি বলতো ? 
মনোতোষ দেখতে পায় মায়ের চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। তারও চোখে জল আসে। সে কাছে গিয়ে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয়। তার মনও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় কলেজ গড়া নিয়ে বাবার উদ্দীপনার কথা। বাবার স্বপ্নের সেই কলেজ শুরু হতে চলেছে। বাবাই শুধুই নেই। 
কালই এসে পৌঁছেছে কলেজ অনুমোদনের চিঠি।ঠিক হয়েছে নিজস্ব বাড়ি না হওয়া পর্যন্ত স্কুলেই সকালের দিকে কলেজের ক্লাস হবে। শিক্ষক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত স্কুলের কিছু শিক্ষক আর অবসর প্রাপ্ত কিছু শিক্ষক স্বেচ্ছাশ্রমে পড়াবেন।নেতারা বেছে বেছে তাদের দলের সমর্থকদেরই শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করেছেন। সে দিন সকাল থেকেই গ্রামে তাই সাজো সাজো রব। শাসক দলের নেতাদের হাকডাকে সরগরম হয়ে ওঠে গ্রাম। মন্ত্রী আসবেন উদ্বোধন করতে। সেইজন্য ঢালাও খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। মাইকে ভেসে আসছে তার সদর্প ঘোষণা। বাবার কথা মনে পড়ে যায় মনোতোষের। সবই হল , বাবাই কেবল দেখে যেতে পারলেন না। এই কলেজের জন্যই চোর বদনাম নিয়ে তাকে চলে যেতে হল। সেদিন শাসক দলের চাপের মুখে পড়ে যদি পার্টি অফিস করতে টাকাটা দিয়ে দিতেন তাহলে হয়তো এই কলেজ আর হত না। কিন্তু কেউ কোন দিন জানতে পারবে না বাবার আত্মবলিদানের কথা। কালের গর্ভে চাপা পড়ে যাবে কলেজের অন্যতম স্থপতির নাম। তা যাক, বাবা তো এলাকার মানুষের জন্যই কলেজের স্বপ্ন দেখে ছিলেন। তিনি দেখে যেতে পারলেন না ঠিকই , কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ায় তার অতৃপ্ত আত্মা নিশ্চয় শান্তি পাবে। বাড়ি থেকেই মনোতোষ শুনতে পান সমানে কলেজ গড়ার কৃতিত্ব জাহির করে চলেছেন শাসক দলের নেতারা। তাদের কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় কোন সদিচ্ছা থেকে নয় , রাজনৈতিক ফিকিরেই ভোটের মুখে কলেজটা করতে বাধ্য হয়েছে তারা। কারণ দীর্ঘদিন ধরে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করতে করতে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে শাসকদল। মানুষকে নতুন করে পাইয়ে দেওয়ার আর কিছু ছিল না। তাই করে দেখিয়ে দেওয়ার তাগিদেই কলেজ গড়ে তারা।কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয় না।

                          ( ক্রমশ )


নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                 ----০---






No comments:

Post a Comment