Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৬৮






     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











             কালের কারিগর
              


                          অর্ঘ্য ঘোষ


                        (  কিস্তি --- ৬৮ ) 



তাই সে মেয়েকে সামনে রেখে সেই প্রত্যাখ্যানের জ্বালা মেটানোর ছক কষতে থাকে।স্বামীর সম্মতি পাওয়ার পর গুটি সাজাতেও শুরু করে দেয়। একদিন মেয়েকে ডেকে বলেন -- হ্যা রে , তুই যে প্রায়ই সূর্যদের বাড়িতে এই খেয়ে এসেছিস ওই খেয়ে এসেছিস বলে গল্প করিস , তা শুধু খেয়ে থাকলেই হবে ?  ওদের দুই ভাইবোনকেও মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে পারিস তো !
শ্রাবন্তীও কতদিন ভেবেছে কথাটা। কিন্তু বাবা- মা যা নাক উঁচু। কি বলতে কি বলে ফেলবে সেই আশংকায় কিছু বলতে পারে নি।কিন্তু এবারে মায়ের কথায় ভরসা পেয়ে সে বলে , আমার তো খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু তোমরা কিছু মনে করবে ভেবে বলতে পারি নি।ততক্ষণে তো মা-বাবার মনোভাব তার জানা হয়ে গিয়েছে। তবু পরে যদি কোন জটিলতা হয় তাহলে মা-বাবাকে যাতে পাশে পাই তার জন্যই তাদের সম্মতি পাওয়ার জন্যই কথাটা বলে শ্রাবন্তী।
মেয়ের কথা শুনে রীনা বলে , না-না আমরা কিছু মনে করব কেন ? তুই বরং সামনের জন্মদিনেই ওদেরও আসতে বলে দে। 
সেই মতো অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে সূর্য আর সুস্মিতাকেও তার জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করে শ্রাবন্তী।নিমন্ত্রণের কথা শুনে প্রথম দিকে ছেলেমেয়েদের পাঠাতে খুব একটা ইচ্ছা ছিল না ছন্দার। কিন্তু মনোতোষ বলেন , ওরা গেলে ক্ষতি কি ? সবাই তো ছেলেপুলের বাবা-মা হয়ে গিয়েছি। আর মনের মধ্যে পুরনো রাগ পুষে রেখে লাভ কি ? ওদের যাওয়া আসাতে যদি ভুল বোঝাবুঝিটা দূর হয় তাহলে ক্ষতি কি ? 
স্বামীর ওই কথার পর আর অমত করতে পারে না ছন্দা।কারণ তিনিই তো ওরা যখন ছোট ছিল তখন মেলামেশায় সম্মতি জানিয়েছিলেন। তার উপরে ছেলের মন দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটাও উড়িয়ে দিতে পারেন না তিনি। তাই  মন সায় না দিলেও আপত্তি জানাতে পারেন না।সাধনাই কেবল ভালভাবে মেনে নিতে পারেন নি।সবার সামনেই বলেন - ওরা বড়োলোক , আমরা গরীব। তেলে জলে কখনই মিশ খায় না।ওদের সঙ্গে এত মাখামাখি না করলেই কি নয় ?
সাধনার কথার উপর কোন বলতে পারেন না ছন্দা কিম্বা মনোতোষ। কিন্তু নাতি-নাতনিরা ঠাকুমাকে ধরে ঝোলাঝুলি শুরু করে দেয় -- ও ঠাকুমা যাই না।আমাদের বন্ধুরা তো সবাই যাবে।
নাতি নাতনীর পীড়াপীড়িতে অগত্যা মত দিতে হয় সাধনাকে। সেদিন সন্ধ্যাতেই একটা উপহার নিয়ে দুই ভাইবোনে শ্রাবন্তীদের বাড়ি যায়। আরও অনেক নিমন্ত্রিতের সঙ্গে রজতকেও নিমন্ত্রণ করেছিল শ্রাবন্তী।রজতের সঙ্গে সূর্যদের সেই রকম কোন  ঘনিষ্ঠতা নেই। একই ক্লাসে পড়া ,  একসময় একসঙ্গে বাবার কোচিংয় নেওয়া উপলক্ষ্যে স্বাভাবিক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।কিন্তুরেজাল্ট খারাপ হওয়ার পর থেকে সে আর কোচিংয়ে যায় না। খাতায় নাম লেখা থাকলেও স্কুলেও বিশেষ একটা যায় না। শাসকদলে নাম লিখিয়ে নানা কুর্কম করে। বড়োলোকের ছেলে তাই বাবার টাকায় কাপ্তানি করে বেড়ায়। অনেকেই এখন তাকে এড়িয়ে চলে। সূর্যরাও তাই , বিশেষত সুস্মিতা তাকে দু চোখে দেখতে পারে না। রজতের দৃষ্টিটা তার কেমন নোংরা লাগে। আর সবেতেই বড়োলোকী ভাব। সুস্মিতা অবশ্য মনে করে শুধু রজতই নয় , গড়পড়তা বড়োলোকেরা একই রকম হয়। কিন্তু তার সেই ধারনা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে বদলে যায়।




                                                      এতদিন তারা শুনেছিল বড়োলোকরা নাকি খুব নাক উঁচু হয়।গরীবদের তারা মানুষই মনে করে না। ঠাকুমাও তো সেইজন্যই তাদের প্রথমে আসতে দিতে চাইছিলেন না।কিন্তু শ্রাবন্তীর মা রীনাকাকী আর বাবা সৌমেনকাকুর কি অমায়িক ব্যবহার।সবসময় তাদেরই যেন বেশি বেশি আপ্যায়ন করছিলেন।শুধু কি তাই ? বাড়ি আসার সময় আবার  যাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করে ছেড়েছেন। বাড়ি ফিরে দুই ভাইবোন সাতকাহন করে সেই গল্পই করে। শুনে সবাই আশ্চর্য হয়ে যান। সব থেকে বেশি অবাক হন সাধনা। তার মুখ থেকে শুধু একটাই কথা শোনা যায় -- হবেও বা। 
সেই থেকে শ্রাবন্তীদের বাড়িতে দুই ভাইবোনের যাতায়াত বেড়ে যায়। ততদিনে সুস্মিতা- শ্রাবন্তীদের মাধ্যমিক পরীক্ষাও হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষার পর সুস্মিতা মাঝেমধ্যে মামারবাড়ি বেড়াতে যায়। কিন্তু শ্রাবন্তী প্রায়ই সূর্যদের বাড়িতে হাজির হয়। কোনদিন বলে আজ বাবার জন্মদিন , তো কোনদিন বলে আজ লক্ষ্মীপুজো। সবদিন সুস্মিতা থাকে না।তাই সূর্যকে একাই যেতে হয়। ওদের বাড়ি গিয়েই বুঝতে পারে জন্মদিন-লক্ষ্মীপুজো কিছুই নয়।শ্রাবন্তীকে একান্তে সেই কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলে , আমি জানি তো সুস্মিতা মামারবাড়িতে আছে। সেইজন্য তোমার সঙ্গে একান্তে কাটাব বলেই তো আমাকে ওইসব মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে। তোমার ভালো লাগছে না ? শ্রাবন্তীর মিথ্যা কথা বলাটা প্রথমে মেনে নিতে কষ্ট হয় সূর্যর। তাদের বাড়িতে কেউ সাধারনত মিথ্যা বলে না। তাই সুস্মিতা যদি কোনদিন সত্যিটা জানতে পারে তাহলে সে খুব ছোট হয়ে যাবে। আবার ওই অজুহাতে শ্রাবন্তীকে কাছে পাওয়ার প্রলোভনও জয় করতে পারে না সে।তাই ওই ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে। উপলক্ষ্যটা মিথ্যা হলেও শ্রাবন্তীর মা অবশ্য খাওয়াতে কসুর করেন না। সময় সুযোগ মতো শ্রাবন্তীর পড়ার ঘরে বসে সে সবের সদ্ব্যবহারের পাশাপাশি গল্পগুজবে দিন কাটে সূর্যর। মনোতোষ আর ছন্দাও ওদের সম্পর্কের বিষয়টি আঁচ করেন।কিন্তু কিছু বলার মতো কাজ সূর্য করে না।পড়াতেও সে সবার আগে রয়েছে। আচার-আচরণেও তার ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায় না।হঠাৎ করে ওদের মেলামেশায় বাধা দিলে সূর্য মনে আঘাত পেতে পারে। সেক্ষেত্রে তার প্রভাব তার পড়াশোনাতেও পড়তে পারে। তাই মনোতোষ - ছন্দা ঠিক করেছেন , সবদিক বজায় রেখে সূর্য যদি শ্রাবন্তীর সঙ্গে মেলামেশা করে তাহলে তারা বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ছেলে যদি শ্রাবন্তীকে বিয়ে করতে চায় তাহলেও তাকে বৌ হিসাবে বরণ করে ঘরে তুলতে আপত্তি করবেন না। কিন্তু খুঁতখুঁতানি যায় না সাধনার। তিনি মন থেকে ওদের মেলামেশা মেনেও নিতে পারেন না , আবার নাতির মনে কষ্ট হবে ভেবে কিছু বলতেও পারেন না।ওই টানাপোড়নের মধ্যেই সাধনাকে আরও একটি দোটানায় পড়তে হয়। মাধুনিয়ার মতো একটা নিস্তরঙ্গ গ্রামেও  বিধানসভা নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে।রাতারাতি সৌমেনের মতো পয়সাওয়ালা লোকেরা বিরোধী দলের নেতা হয়ে বসে। সৌমেনের বাবা কুণালের তো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্রব ছিলই। সেটাকে ভাঙিয়েই দ্রুত রাজনীতির ময়দানে সৌমেনরা জায়গা করে নেয়।  তাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় প্রতিদিন এলাকা তেতে ওঠে।  মাইকে সেইসব কথা ভেসে বেড়ায় সারা গ্রাম।বাড়িতে থেকেও তা শুনতে হয় ছন্দাকেও।তার খুব হাসি পায়।সৌমেনের চোখের নিচের সেই ক্ষতচিহ্নটার কথা মনে পড়ে যায় তার।মনে হয় , মানুষের কি দুর্ভাগ্য সৌমেনের মতো একটি লোক নীতি-আদর্শের বড়াই করছে , মেয়েদের সম্মানের বুলি কপচাচ্ছে , আর তাদের তাই শুনতে হচ্ছে। শাসকদলও গদি টিকিয়ে রাখতে মরীয়া হয়ে উঠেছে। সুব্রতদের সঙ্গে প্রতিদিনই সৌমেনদের দলের ছেলেদের টক্কর বাঁধছে। এরা ওদের পোস্টার ছিঁড়ছে , তো ওরা এদের দেওয়ালে আলকাতরা লেপে দিচ্ছে। গোলাগুলি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।দু'পক্ষের সংঘর্ষে তেতে উঠছে গ্রাম। 




                                            সাধনারা অবশ্য ওইসব রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান না। কিন্তু ওই রাজনীতিই তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠে। একদিন সদলবলে তাদের বাড়িতে হাজির হয় সুব্রত। তাদের সংগে ছিলেন ধোপদুরস্ত পোশাক পড়া নেতা গোছের আরও দু'জন লোক। তাদের একজনকে চেনেন সাধনা।সিউড়ির সদর কার্যালয়ে ওই লোকটার কাছেই তিনি ডাক্তারকাকার সঙ্গে সুব্রতদের অত্যাচারের কথা বলতে গিয়েছিলেন। সুদীপ ভট্টাচার্য না কি যেন নাম লোকটার। তার জন্যই তো খুব বড়ো মাসুল দিতে হয়েছে তাকে। অকালে স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি। স্বামী হারানোর যন্ত্রণা আজও ভুলতে পারেন নি।সেই কথা মনে পড়তেই রাগে গা জ্বালা করে ওঠে তার।রাগের চোটে সৌজন্যের খাতিরে তাদের আসুন বসুন বলতেও ভুলে যান সাধনা।লোকগুলো অবশ্য সৌজন্যের ধারও ধারেন না। সুদীপ নামের লোকটা তার সামনে এগিয়ে এসে সরাসরি বলে , আমরা এই গ্রামে খুব শীঘ্রই কলেজ গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আপনাদের কাছে কলেজের জমির দলিলপত্র আর ফিক্সড ডিপোজিটের কাগজগুলো রয়েছে।কলেজ গড়তে ওগুলো দরকার। আপনার স্বামীও তো বলেছিলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলে নাকি তার ওইসব দিতে আপত্তি নেই। কি সুব্রত তাই তো নাকি ?
তারপর সুব্রতর দিকে চেয়ে যেন তাকে স্বাক্ষী মানে লোকটা।সুব্রতও যেন স্বাক্ষী দেওয়ার জন্য মুখিয়েই ছিল।গদগদ স্বরে বলে ,  হ্যা দাদা আমাদের তো সেই কথাই বলেছিলেন।
শয়তানটার কথা শুনেই চাঁ করে মাথায় রক্ত চড়ে যায় সাধনার। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের সেই দৃশ্যটা। এই ছেলেটিই তো চড় মেরেছিল স্বামীকে। সেই অপমানের জ্বালা জুড়োতেই তো তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে হয়।তারপরেও ওরা কোন মুখে তাদের বাড়িতে এসে দাঁড়াতে পারে ? কড়া করে দু'কথা শুনিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন সাধনা।সেই সময় স্কুল থেকে ফেরে মনোতোষ। বাড়ির উঠোনে এক দংগল লোককে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে প্রথমে ভেবেছিলেন রাজনৈতিক দলের নেতারা বুঝি ভোট প্রচারে এসেছেন। কিন্তু মায়ের মুখচোখের ভাবটা দেখে তার কেমন যেন লাগে। দ্রুত কাছে গিয়ে সে মাকে সরিয়ে নিয়ে আসে। মা তখন রাগে রীতিমতো কাঁপছেন। মাকে ছন্দার কাছে পৌঁছে দিয়ে জটলাটার কাছে যায় সে। পুরো বিষয়টা শুনে সে'ও দোটানায় পড়ে যায়। কলেজ সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্রই বাবা পরম যত্ন করে রেখে গিয়েছেন। কিন্তু একক সিদ্ধান্তে তিনি কি করে ওইসব কাগজপত্র এদের হাতে তুলে দেবেন ?
সেদিনের সেই উদ্যোক্তারা অধিকাংশই আর বেঁচে নেই। দু'চারজন যারাই আছেন তারাও বাবার আত্মহত্যার পর ঘর ঢুকে গিয়েছেন। তাহলেও কাউকে না জানিয়ে তিনি কি করে ওইসব মুলবান নথি হস্তান্তর করবেন ?  আবার না দিলে যদি বাবার মতোই অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয় ? শাসকদল পারে না এমন কাজ নেই। তাদের হাত অনেক -- অনেক লম্বা। তাই তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন , দেখুন নথিপত্র সব আমাদের কাছেই রয়েছে। সেসব দিতেও আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু একক সিদ্ধান্তে সেসব আপনাদের হাতে তুলে দিলে আমাদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে। তাই আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ , সংগঠক কমিটির  যারা জীবিত রয়েছেন , তাদের মধ্যে দু/চার জনকে নিয়ে আসুন। তাদের সামনেই সমস্ত নথিপত্র আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছি।তার কথা শুনে ওদের দলের নেতা সুদীপ ভট্টাচার্য বলেন , ঠিক আছে কালই আমরা সেইরকমই কয়েকজনকে নিয়ে আসছি।
তারপরই তারা বেরিয়ে যায়। স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচে মনোতোষ। নিজেকে চাপমুক্ত লাগে তার। কিন্তু পরদিন সকালেই ফের চাপের মুখেই পড়তে হয় তাকে।

                              ( ক্রমশ )

নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                 ----০---


No comments:

Post a Comment