( কিস্তি -- ৭০)
কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। হুড়মুড়িয়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে শাসক দলের দীর্ঘ দিনের সাম্রাজ্য। আসলে তলায় তলায় যে একটার পর একটা খুঁটি ঘুন পোকায় কেটে ছিল , তা জানা স্বত্ত্বেও সময়ে পাল্টানোর পরিবর্তে চোখ বন্ধ করেছিল শাসক দল। তাই মানুষের মধ্যে একটা তীব্র শাসক বিরোধিতা তৈরি হয়।সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীরা মানুষের মনে নানা রকম স্বপ্নের জাল বিস্তার করে ফেলে। অনেকের মধ্যেই 'দেখিই না ওদের একটা সুযোগ দিয়ে ' এই গোছের মনোভাবের জন্ম হয়।সেই মনোভাব থেকেই মানুষ দু-হাত তুলে ভোট দেয় বিরোধীদের।তারই জেরে গোহারান হারতে হয় শাসকদলকে।কিন্তু অচিরেই মানুষের স্বপ্ন-ভঙ্গ হতে শুরু করে।খুব দ্রুত নেতা হিসাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে সৌমেনের মতো নীতি আর্দশহীন লোকেরা।জার্সি বদলে সুব্রতরাও নাম লেখায় তাদের দলে।
রাজনীতির ময়দানটা দু-হাতে কামিয়ে নেওয়ার জায়গা হয়ে ওঠে।শিক্ষাক্ষেত্রকেও গ্রাস করে নেয় সেই অবক্ষয়। রাজনীতি নিয়ে মনোতোষের কোন কালেই কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা সর্বোপরি নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে নানা কথা কানে আসে তার। ওইসব কথা বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয় না তার। কিন্তু নিজের ছেলের ঘটনাই তার সেই বিশ্বাসের ভিত নড়িয়ে দেয়। মাধ্যমিকে মেধা তালিকায় স্থান , প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক এমন কি গ্রামের কলেজ থেকে বি,এস,সিতে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে পাস করার পরও চাকরির বাজারে হোঁচট খেয়ে চলেছে সূর্য। দাদার ওই দশা দেখে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে সুস্মিতাও। এবারে তার ফাইন্যাল ইয়ার চলছে। তার মুখেই মনোতোষ বার বার শুনেছে , দাদার তো ওই অবস্থা। ভালো লেখাপড়া করেই বা কি হবে ?
মনোতোষ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন , চাকরি পাওয়াটাই লেখাপড়ার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। নিজেকে শিক্ষিত করাটাই আসল।
সেই কথা শুনে ছেলেমেয়ে দুটো কিছু প্রত্যুত্তর করে নি বটে , কিন্তু মনোতোষের নিজেরই মনে হয়েছে তার সান্ত্বনা বাক্য আসলে ভাবের ঘরে চুরির সামিল। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় চাকরির মাপকাঠি দিয়েই শিক্ষার সার্থকতা বিবেচিত হয়। চাকরিহীন প্রকৃত শিক্ষিত মানুষকে এই সমাজ কানাকড়িও মুল্য দেয় না।তাই শুধু তার ছেলেমেয়েই নয় , ছাত্র সমাজের একটা বড়ো অংশই এখন লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ওই সব ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে বহু বার বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে।সেদিন ক্ষীরময়ই তার আক্ষেপের কথা শোনাল। নুন্যতম বেতনে অন্যের গাড়ি চালিয়ে একমাত্র ছেলে জীতেনকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করিয়েছে সে।আহামরি নাহলেও পড়াশোনায় একেবারে ছি-ছি'ও নয় তার ছেলে।সেই জীতেনকে কলেজের পরিবর্তে পাড়ার বিভিন্ন ঠেকে আড্ডা দিতে দেখে মনোতোষ একদিন ক্ষীরময়কে জিজ্ঞেস করেন , হ্যা গো গ্রামেই কলেজ হয়েছে। ঘরের খেয়ে দিব্যি পড়াশোনা করা যায়। কিন্তু তোমার ছেলেটাকে কলেজ যেতে দেখি না কেন ?
তার প্রশ্নে খুব সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে ক্ষীরময়। আমতা আমতা করে বলে , আপনাকে কি বলব মাস্টারমশাই ওই কথাটাই ছেলেকে জিজ্ঞেস করে উত্তর শুনে চুপ করে গিয়েছি।
---- কেন কি হয়েছে ?
---- ছেলেই আমাকে প্রশ্ন করেছে কি হবে বেশি লেখা পড়া শিখে ? তোমার টাকা আছে যে চাকরি হবে ? কি বলব মাস্টারমশাই তার ওই প্রশ্নের কোন জবাব আমি দিতে পারি নি।
জবাব দিতে পারেন না মনোতোষ নিজেও। প্রশ্নটা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। স্বজনপোষণ , আর্থিক দুনীতি সব আমলেই ছিল , হয়তো থাকবেও। কিন্তু এক সময় যোগ্যতার ভিত্তিতেও কিছু চাকরি হয়েছে। নাহলে সে আর বাবা তো চাকরিই পেত না। তাদের তো টাকা পয়সা দিয়ে চাকরি নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না।কিন্তু এখন সব ক্ষেত্রেই টাকা , নাহলে চাকরিই মিলছে না।এই তো সূর্যই পাশ করে সমানে একের পর এক ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছে। কিন্তু অত ভালো রেজাল্ট করা স্বত্ত্বেও কোথাও চাকরি জুটছে না। ছেলেকেও তাই স্তোকবাক্য দেন -হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিস না। একদিন ঠিক কিছু না কিছু একটা জুটে যাবে দেখিস।
কিন্তু একরাশ হতাশা গ্রাস করে নেয় সূর্যকে। ভালো পরীক্ষা দিয়েও কোন লাভ হচ্ছে না। অথচ তার চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক পিছনে পড়ে থাকা ছেলেমেয়েরা একের পর এক চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি সে ঠিকঠাক ইন্টারভিউ দিতে পারছে না ? সংশয়টা মনে উঁকি দিতেই সে টিপস নেওয়ার জন্য একদিন চিরন্তনকে ধরে। চিরন্তন তারই সহপাঠী।লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো ছিল না। টেনেটুনে পাশ করেছে। তার সঙ্গেই হাইস্কুলের চাকরির পরীক্ষায় বসেছিল।সে'ই এখন কলেশ্বর হাইস্কুলে চাকরি করছে।সূর্যর প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসে চিরন্তন।কিছুতেই খোলসা করতে চায় না।অনেক সাধ্য সাধনার পর বলে , টিপস বলে কিছু নেই।আসল টিপস হল টাকা।এক নেতার হাতে নগদ দশ লক্ষ টাকা গুনে দিয়েছিলাম। তিনিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেই কথা শুনেই আরো মুসড়ে পড়ে সূর্য। তার বাবার তো অত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই।
থাকলেও বাবা কোনদিনই চাকরির জন্য ঘুষ দেবেন না। তাহলে ভালো রেজাল্ট করেই বা কি লাভ হল ? প্রশ্নটা সূর্যর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতেই থাকে। কোন উত্তর মেলে না। তারই মধ্যে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। হাইস্কুলে শিক্ষকতার আশা ছেড়ে প্রাইমারি স্কুলের চাকরির জন্য আবেদন করে সূর্য। রজতের মতো টেনেটুনে পাশ বহু ছেলেমেয়েও আবেদন করে। পরীক্ষা দিয়ে এসে মনের জোর ফিরে পায় সূর্য। বাড়ি ফিরে মিলিয়ে দেখেছে সবক'টি উত্তর সে ঠিক লিখেছে। এবারে আর তার চাকরি না হয়ে যায় কোথায়। চাকরিটা হলেই সে শ্রাবন্তীকে বিয়ে করার কথা বলবে বাবা- মাকে।শ্রাবন্তীও তাকে একটা চাকরি বাকরি যোগাড়ের জন্য তাড়া লাগায়। শ্রাবন্তীকে ঘিরে একটা রঙিন স্বপ্নের জাল বোনে সে। মনে মনে ভাবে, এবারে অন্তত সেই গানটার মতোই সে'ও শ্রাবন্তীকে বলতে পারবে " চাকরিটা আমি পেয়ে গ্যাছি।" কিন্তু তার মনের ইচ্ছা মনেই থেকে যায়।পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায় তালিকায় সূর্যর নামই নেই।কিন্তু রজতের মতো বহু টেনেটুনে মাধ্যমিক কিম্বা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা ছেলেও তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছে। সেই সব দেখে শুনে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে।অক্ষমতার গ্লানি কুড়ে কুড়ে খায় তাকে। যেখানেই যায়, সবাই আঙুল তুলে তার ব্যর্থতাটাই দেখিয়ে দেয়। সান্ত্বনা খোঁজার জন্য শ্রাবন্তীর কাছে ছুটে যায়। কিন্তু সান্ত্বনা মেলে না। বরং শ্রাবন্তী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে ওঠে, একটা চাকরি জোটানোর মুরোদ নেই , প্রেম করার শখ কত ? যাও আগে একটা চাকরি যোগাড় কর। তারপর আমার কাছে এসো।
মেয়ের কথাগুলো কান এড়ায় না রীনার। সাজানো ছকেই গুটি এগোচ্ছে দেখে তার মন খুশীতে ভরে ওঠে। এই ভাবেই মেয়েকে দিয়ে মনোতোষের প্রত্যাখ্যানের জ্বালা সে তার ছেলের উপরে মিটিয়ে নিতে চায়। তাই মেয়েকে সমর্থন জানিয়ে সে সূর্যকে বলে , তুমি বরং সেটাই করো।একটা কাঠ বেকারের হাতে তো আমাদের একমাত্র মেয়েকে তুলে দিতে পারি না।কোন কথা বলতে পারে না সূর্য।মনে মনে ভাবে , চাকরি এক আশ্চর্য বস্তু।কয়েক দিন আগেই এই বাড়িতে তার কি আদর আপ্যায়নই না ছিল! আজ চাকরি নামক সেই বস্তুটা করায়ত্ত করতে পারে নি বলে কেউ দুদণ্ড বসতেও বলল না।
শ্রাবন্তীর কাছে ঘা খেয়ে আরও রক্তাক্ত হয়ে ফিরে আসে সূর্য।মনোতোষ আর ছন্দা ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। ছেলেটা সব সময় কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকে। চোখে-মুখে ফুটে ওঠে কালির ছোপ।ভালো করে খেতেও পারে না। স্বামীর কাছে তাই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ছন্দা বলে , ছেলেটা দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।হ্যা গো কিছু একটা করা যায় না ?
স্ত্রীর কথা শুনে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন মনোতোষ।ঝাঝিয়ে ওঠেন -- কি করব ? বাবা হিসাবে তাকে উপযুক্ত শিক্ষিত করে তুলেছি।তারপরেও তোমার ছেলে যদি প্রাইমারী স্কুলের চাকরির তালিকাতে স্থান দখল করতে না পারে তাহলে আমি কি করতে পারি ? কত টায়েটোয়ে পাশ করা ছেলের নাম তালিকাতে উঠে গেল আর উনি গন্ডী টপকাতেই পারলেন না। পারবেন কি করে ? চাকরি চেষ্টা না করে মেয়েটার পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াতে বলো গে তাহলেই চাকরি এসে ওনার হাতের মুঠোয় ধরা দেবে।
স্বামীর কথা শুনে অবাক হয়ে যায় ছন্দা।মনোতোষকে কখনও এইরকম ভাষায় কথা বলতে শোনেন নি তিনি। তার বুঝতে অসুবিধা হয় না ছেলেকে নিয়ে মনোতোষও খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।সেই জন্য ছন্দা মনে মনে ঠিক করেন ওই প্রসঙ্গ তুলে আর স্বামীর দুশ্চিন্তা বাড়াবেন না। কিন্তু তিনি চাইলে কি হবে ? ঘুরে ফিরে সেই প্রসঙ্গই এসে পড়ে। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে সবে চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছেন সেই সময় বাড়িতে আসে খুঁকী। অসময়ে গঙ্গাজলকে দেখে অবাক হয়ে ছন্দা বলে , আজ কোন দিকে সূর্য উঠেছে রে , পথ ভুলে নাকি ?
----- না - না পথ ভুলে নয় , একটা কাজের কথা নিয়ে এসেছি।এই সময় মনোদাকে বাড়িতে পাব বলেই অসময়ে আসা।
ওই কথা শুনে খুঁকীর মুখের দিকে চায় দু'জনে। গলার স্বর কিছুটা নামিয়ে খুঁকী বলে , অত ভালো রেজাল্ট করে সূর্য চাকরি বাকরি তো কিছুই পেল না।
খুঁকীর কথা শুনে গায়ে জ্বালা ধরে যায় ছন্দার। মনে মনে বলে জানিসই তো , তাহলে বাড়ি বয়ে আবার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে এসেছিস কেন ? না হয় প্রাইমারী নিয়োগ তালিকায় তোর ছেলের নামই উঠেছে কিন্তু চাকরি তো এখনও পাই নি। এরই মধ্যে নিজের ছেলের ঢাক পেটাতে আমাদের খোঁচাতে আসা কেন বাপু। আমরা মরছি নিজের জ্বালায় , আর উনি এলেন ঢাক পেটাতে।
গঙ্গাজল যাই বলুক না কেন , সৌজন্যের খাতিরে ছন্দাকে বলতেই হয় -- হ্যা , তোর ছেলের তো ভাল খবর শুনলাম। তালিকায় নাম উঠেছে। দেখ এবার কি হয়।
--- আরে সেই কথা বলতেই তো এলাম। নাম কি আর এমনি এমনি উঠেছে ?
---- মানে ? --- বিস্ময় ঝড়ে পড়ে মনোতোষের গলায়।
--- রজত লেখাপড়াতে কেমন তা আমিও জানি, তোমরাও জানো।সোজা পথে যে ওর কিছুই হবে না তা আমরা ভালোই জানতাম। দরখাস্ত করার পরেই তাই ওর বাবা উঁচুতলার এক নেতাকে ধরেছিলেন। সেই নেতাই বলেছিলেন সাত লাখ টাকা লাগবে তাহলে চাকরি পাকা। আমাদের তো একটাই ছেলে , তাই আর অমত করি নি।
---- কিন্তু রজতের তো তালিকায় নাম উঠেছে। নিশ্চয় পরীক্ষাটা ভালো দিয়েছিল। আমাদের গুনধরটি তো সেটাও পারেন নি।
--- মনোদা তালিকায় নাম তোলাটাও তাদেরই হাতে ?
---- মানে ?
---- অর্ধেক টাকা জমা দেওয়ার পরই নেতা প্রশ্নপত্রটাই দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওর বাবার তো ছেলের জ্ঞানগম্যির কথা অজানা নয়। তাই নেতাকে বলেছিলেন , দাদা ওই প্রশ্নপত্র নিয়ে আমি কি করব ? ছেলে যদি উত্তর মুখস্থ করে লিখতেই পারবে তাহলে দাদা আর আপনাকে ধরা কেন ?
সেই কথা শুনেই না নেতা বলেছিলেন ঠিক আছে তোমার ছেলেকে তাহলে খাতায় নিজের নাম আর রোল নং ছাড়া কিছু লিখতে বারণ কোর। আর কোন সেণ্টারে পরীক্ষা দিচ্ছে সেটা আমাকে জানিয়ে দিও। সেই মতোই তো রজত সাদা খাতা জমা দিয়ে এসেছিল। তারপর ওই নেতাই একদিন ওর অফিসে রজতকে নিয়ে ওর বাবাকে যেতে বলে ছিলেন।সেখানেই তো একজন লোক রজত এবং আরও কয়েকজন ছেলেকে সব বলে দেন আর ওরা সেই মতো লিখে দিয়ে আসে। তোমরা আমাদের আপনার জন , তোমাদের সত্যি কথাটা বললাম বলে পাঁচকান করো না যেন।
কথাগুলো শুনে গঙ্গাজলের মুখের দিকে অবাক হয়ে বিষ্ময়ে চেয়ে থাকেন ছন্দা। কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন মনোতোষ।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment