Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৭১




     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



         শুরু  হল  ধারাবাহিক উপন্যাস -- 











             কালের কারিগর
              


                       অর্ঘ্য ঘোষ




                     (  কিস্তি --- ৭১ ) 




কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন মনোতোষ। এতক্ষণ তো তাহলে তিনি শুধু শুধু ছেলেকে দোষারোপ করছিলেন। ব্যাপারটা যদি সত্যি হয় তাহলে তো ইন্টারভিউ দিতে দিতে চাকরির বয়স পেরিয়ে যাবে , কিন্তু কোনদিনই সূর্যের মতো ছেলেদের তালিকায় নামই উঠবে না। আর তাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চাকরির নিয়োগ পত্র হাতিয়ে নিয়ে মাস্টারি করবে রজতের মত ছেলেরা। প্রশ্নপত্র পেলেও যাদের উত্তর লেখার ক্ষমতা নেই , তারা ছাত্রছাত্রীদের কি পড়াবে ভেবে পান না মনোতোষ। টাকা নিয়ে ওই ভাবে চাকরি দেওয়ার ফলে শুধু যে প্রকৃত প্রাপকেরাই বঞ্চিত হচ্ছে তাই নয় , প্রকৃত শিক্ষা থেকে ছাত্রছাত্রীরাও বঞ্চিত হবে। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই নড়বড়ে হয়ে পড়বে। ওই ভাবে চাকরি হাতাতে গিয়ে সবাই তো প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারির মোহে বাঁধা পড়ে যাবে। এর ফলে যাদের বিজ্ঞানী , ডাক্তার কিম্বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তারাও প্রাইমারী স্কুলে চাকরি করার জন্য লাইন দেবে। খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন মনোতোষ। ছন্দার কথাতে তার চিন্তাজাল ছিঁড়ে যায়। তিনি শুনতে পান খুঁকীকে উদ্দেশ্য করে ছন্দা বলছে -- তাহলে তো ভাই গঙ্গাজল তোর আর কোন চিন্তা নেই। ছেলের চাকরি একেবারে পাকা। আমাদের ছেলেটা দেখ না অত ভালো রেজাল্ট করেও কোন ধার লাগতে পারল না।
একরাশ হতাশা ঝরে পড়ে ছন্দার গলায়।নিজেকে খুব অসহায় লাগে মনোতোষের। সে স্ত্রীকে সান্ত্বনা সূচক কিছু বলার আগেই ফের মুখ খোলে খুঁকী।গলার স্বর একবারে নিচে নামিয়ে খুঁকী বলে , গঙ্গাজল সূর্যর চাকরির একটা সুযোগ আছে। তোরা যদি রাজি থাকিস তো বল ? 
----- কি সুযোগ ?  আগ্রহের আতিশয্যে ঝড়ে পড়ে ছন্দার গলায়। স্ত্রীর মানসিক অবস্থাটা উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না মনোতোষের।ছোটবেলার খেলার সাথীর ছেলে চাকরী পেতে চলছে ,  আর তার ছেলে কোন চাকরির নাগাল পাচ্ছে না সেই কথাটা ভেবেই মায়ের মন উতলা হয়ে পড়ে। ততক্ষণে খুঁকীও সবিস্তারে বলতে শুরু করে দিয়ে দিয়েছে সুযোগের কথা -- তোমাকে বলব কি ভাই গঙ্গাজল , তোমার ছেলের নাম লিস্টে উঠে নি জানার পর থেকেই মনে এক ফোটাও শান্তি ছিল না। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না , কিন্তু আমি সত্যি বলছি তোমার  ছেলের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনাও করেছি। ভগবান বোধহয় সেই প্রার্থনা শুনেছেন। বলেই না সুযোগটা সামনে এল।
----- সুযোগটা সামনে এল মানে ?
---- মানে আমাদের সঙ্গে তো ৭ লাখে কথা হয়েছিল কিন্তু এখন চাহিদা অনেক বেড়ে গিয়েছে। অনেকে বারো লাখ টাকা দিয়েও চাকরি কিনতে চাইছে। কিন্তু আগে থেকে টাকা দেওয়া ছিল বলে ওই নেতা  আমাদের কাছে এখন ৯ লাখ টাকা চাইছে।কিন্তু এখনই তো আমাদের বাড়তি দু লাখ টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। সেই কথা শুনে ওই নেতা একটা সুযোগ দিয়েছেন। উনি বলছেন আর একজনকে যোগাড় করে দিলে দু-জনের আট লাখ টাকা করে দিলেই হবে। ভেবে দেখো কত বড়ো সুযোগ বারো লাখের চাকরি আট লাখে। হাতে হাতে চারলাখ টাকা লাভ ভাবা যায় !  আর তোমারা নিলে আমারও এক লাখের চাপ কমে যাবে। সবাইকে তো বলতে পারছি না। তোমরা আমার আপনারজন বলেই ভরসা করে বলা।
খুঁকীর কথা শুনে মুখ খোলেন মনোতোষ --- কিন্তু সূর্যের তো লিষ্টে নামই ওঠে নি।
---- ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না মনোদা । ওরাই সব ঠিক করে দেবে। প্রথম দিকে বাইরের জেলায় পোষ্টিং দেবে। কেউ জানতেও পারবে না চাকরি পাওয়ার কথা। তাই জলঘোলাও করতে পারবে না। তারপর নিয়োগের বিষয়টি থিতিয়ে গেলে নিজের জেলাতে ফিরিয়ে দেবে।





                              কথাগুলো শুনে মাথার শিরা ছিঁড়ে যাওয়ার যোগাড় হয় মনোতোষের। চোখ বন্ধ করে তিনি শুধু ভাবতে থাকেন ঘুষ সাম্রাজ্য চালাতে কি নিখুঁত ছক কষে রেখেছে শাসকদল। এই চক্র থেকে বেরোয় কার সাধ্যি ? চোখ খুলে দেখেন তার মুখের দিকে উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রয়েছে দুটি মুখ। দুটি মুখের অভিব্যক্তি দু-রকম।ছন্দার চোখে মুখে উপছে পড়ছে ছেলের চাকরির আশার আলো। আর খুঁকীর চোখে এক লাখ টাকা বাঁচানোর আশা। ছন্দাই প্রথম কথা বলেন , হ্যা গো আমাদের সব কিছু বিক্রিবাটা করে টাকাটা যোগাড় হবে না ?  
তার কথা শেষ হতেই খুঁকী বলে , এই সুযোগ কিন্তু আর আসবে না। সবাই বলাবলি করছে পরের বারে চাকরির দাম পনেরো  / ষোলো লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
এবারে মুখ খোলেন মনোতোষ। খুব শান্ত স্বরে ধীরে ধীরে তিনি বলতে শুরু করেন , আমার অত টাকা দিয়ে চাকরি কেনার ক্ষমতা নেই। আর থাকলেও টাকা দিয়ে ছেলেকে চাকরি কিনেও দিতাম না। দরকার হলে সূর্য ছেলে পড়িয়ে কিম্বা চায়ের দোকান করে শাক ভাত খাবে , কিন্তু ঘুষ দিয়ে কেনা চাকরির বেতনের টাকায় ঘি ভাত খাবে না। যেটুকু সঞ্চয় থাকবে তা ওদের দুই ভাই বোনকে দিয়ে যাব। সেই টাকা নিয়ে ওরা যা খুশী করতে পারবে। কিন্তু প্রাণ  থাকতে তিল তিল করে জমানো টাকা ডাকাতদের হাতে তুলে দিতে পারব না।স্বামীর কথায় বিমর্ষ হয়ে পড়েন ছন্দা। শেষ চেষ্টা হিসাবে স্বামীকে বলেন , হ্যা গো আর একবার ভেবে দেখলে হত না ? 
খুঁকী বলে , ভালোর কাল নেই  একেই বলে। বাড়ি বয়ে এত বড়ো একটা সুযোগের কথা বলতে এলাম তা মন উঠল না। একদিন এর জন্য পস্তাতে না হয় দেখো। বেশ ভাই চললাম , কথাটা যেন পাঁচকান না হয় সেটা দয়া করে মনে রেখো।
রাগী রাগী মুখ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় খুঁকী। ছন্দা জানে মনোতোষ এক কথার মানুষ। ওকে বলেও আর কিছু লাভ হবে না। তবু শেষ চেষ্টা হিসাবে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে বলেন , হ্যা গো ভুল হচ্ছে না তো , আর একবার ভেবে দেখলে হত না ? সবাই যদি এইভাবে টাকা দিয়ে চাকরি কিনে নেয় তাহলে ছেলেটা তো কোন দিনই চাকরি পাবে না।
স্ত্রীর কথার কোন প্রত্যুত্তর করেন না মনোতোষ।কিন্তু কথাটা যে অমূলক নয় তা উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না তার।মনের মধ্য একটা টানাপোড়েন  শুরু হয়। সত্যিই সে ভুল করছে না তো ? পরক্ষণেই মনে হয় টাকা দিয়েই যদি চাকরি কিনতে হবে তাহলে শিক্ষার দাম কি রইল ?তীব্র টানাপোড়নের মধ্যেই একদিন শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা শুনতে পান মনোতোষ। দেখা যায় গ্রামের স্কুলেই নিয়োগ পত্র পেয়েছে রজত। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই মানসিক অস্থিরতা আরও বেড়ে যায় সূর্যর। বাইরে বেরোতে পারে না।সবাই জিজ্ঞেস করে , এই তোমার চাকরি হলো। এবারে ও তোমার কিছু হল না। 




                                       অক্ষমতার জ্বালাটা আরও বেড়ে যায়। মনে হয় , সবাই  যেন আঙুল উচিয়ে বলছে , তুমি পারো নি , তুমি হেরো তুমি হেরো। কারও কথায় কণা মাত্র সহমর্মিতা মেলে না , হুল ফোটানোর যন্ত্রনা টের পায় সূর্য। বাড়িতেও তিষ্ঠোতে পারে না। তাকে ঘিরে বাবা-মায়ের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া তার মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে। শ্রাবন্তীর উপেক্ষা স্বত্ত্বেও ব্যর্থতার জ্বালা ভুলতে সে বার বার তাদের বাড়িতে ছুটে যায়। কিন্তু শ্রাবন্তীর ব্যবহার তাকে আরও হতাশা গ্রস্থ করে তোলে। তাকে দেখে ব্যস্ততার ভাব দেখিয়ে এড়িয়ে যায় শ্রাবন্তী। তাকে দেখলেই শ্রাবন্তী বলে , তোমাকে না বলেছি চাকরি বাকরি একটা কিছু না জুটিয়ে আমার কাছে আসবে না।তারপরই সূর্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে।
অপমানহত হয়ে বাড়ি ফেরে সূর্য। আস্তে আস্তে তার মান অপমান বোধটাও চলে যায়। শ্রাবন্তী আর তার মা তাকে এত অপমান করে তবুও ওদের বাড়ি চলে যায়। কিন্তু শ্রাবন্তী আর সূর্যর সঙ্গে দেখাই করে না।চাকরি পাওয়ার পর থেকে রজতের সঙ্গেমেলামেশা বেড়েছে শ্রাবন্তীর। ইদানীং তাকে প্রায়ই রজতের কোমর জড়িয়ে মোটর বাইকে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। সেটা দেখেই আরও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে সূর্য। প্রত্যাখ্যানের জ্বালা তাকে কার্যত গৃহবন্দী করে তোলে। সব সময় ভ্যালভ্যাল করে চেয়ে থাকে।চোখে মুখে কেমন যেন পাগল পাগল ভাব। আপন মনে প্রায়ই বিড় বিড় করে। বিষয়টা নজর এড়ায় না সুস্মিতার। একদিন শ্রাবন্তীদের বাড়ি গিয়ে তাকে ধরে সে। সরাসরি প্রশ্ন করে --- দাদার সঙ্গে এই রকম ব্যবহার করছিস কেন ? 
--- কি রকম ব্যবহার ? লেখাপড়ায় ভালো ছিল বলে দু/ চারদিন মেলামেশা করেছি। কিন্তু ওই পড়াশোনার দাম কি আছে ? সামান্য একটা প্রাইমারী স্কুলের চাকরিও যে শিক্ষায় জোটে না ,  সেই শিক্ষার গলায় দড়ি।
---- চাকরিটাই কি বড়ো হল ? ভালোবাসাটা কিছু নয় ? 
----- একটা বেকার বাউণ্ডুলেকে ভালোবাসা আর গলায় দড়ি বেঁধে ডুবে মরা একই ব্যাপার। সেটা আমি পারব না। 
---- তাহলে কি তুই দাদাকে নয় , দাদার ভাল রেজাল্টকে ভালোবেসে ছিলি ?
---- তা ছাড়া ? তোরা কি ভেবেছিল তোদের ওই নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসারে বৌ হওয়ার জন্য আমি হেদিয়ে মরছিলাম। আমরা বড়লোক, বাবার একমাত্র সন্তান আমি। সেই সম্পত্তি হাতিয়ে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লোভে  তোরাও তো  দাদাকে আমার পিছনে ভিড়িয়ে দিয়েছিলি।
----- মোটেই না। তোদের ভালবাসার কথা ভেবেই বাবা- মা তোদের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
---- তুমি তোমার বাবা-মাকে বলে দিও সবসময় সব চাওয়াই যে তাদের মনোমত হবে তার কোন মানে নেই। কখনো কখনো উল্টোও হয়।
মেয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেন শ্রাবন্তীর মা। ওই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ সুস্মিতার বোঝার কথা নয়। কিন্তু কথাগুলো বলে খুব আত্মতৃপ্তি লাভ করে রীনা। সেদিনের সেই প্রত্যাখ্যানের জ্বালা কিছুটা হলেও মেটে তার। এবার নিজের ছেলেকে দেখে বুঝক ওর বাবা মা।
সুস্মিতা আর কোন কথা বলতে পারে না। মাথা নিচু করে শ্রাবন্তীদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে সে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঠাকুমায়ের কথা মনে পড়ে তার। আজ ঠাকুমা নেই। কিন্তু তার বলে যাওয়া সেই কথাগুলো যেন কানে বাজে। মনে হয় ঠাকুমা যেন বলছেন ," ওরা বড়োলোক, আমরা গরীব। কাজ কি ভাই ওদের সঙ্গে মিশে ? জলে তেলে যে মিশ খায় না ভাই।" 
জলে ভিজে যায় সুস্মিতার চোখ।

                            ( ক্রমশ )


নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                                    ( ১ ) 
                                  


                             ( ২) 





                                       

                       ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )

            



                          ( ৫ )

                                 ( খেলার বই )
         

                                                                                 


                 ----০---



No comments:

Post a Comment