Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৩৩




      
    

     


       অন্তরালে



                অর্ঘ্য ঘোষ 


    ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 




প্রশান্তকাকা বলেন , চালটা কিন্তু মোক্ষম দেওয়া হল। প্রসাদ মোড়ল এবার বুঝবে বাবারও বাবা থাকে। 
মনের আনন্দে জীতেনকাকা ছড়া কেটে  বলেন , বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। এইবার ঘুঘু তোমার বধিব পরাণ। সত্যি গো , আমরা এত তলিয়ে ভাবতে পারি নি। এ যাকে বলে একেবারে আটঘাট বেঁধে এগোনো। আমি শুধু ভাবছি বিষয়টা জানার পর প্রসাদ মোড়লের মুখের চেহেরাটা কেমন হবে!
প্রিয় দেখে সবার চোখে মুখে আত্মতৃপ্তির ছাপ ফুটে ওঠেছে। আসলে এক তরফা অপদস্থ হতে হতে প্রতিপক্ষের  জব্দ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে মানুষ এভাবেই নিজেদের অপদস্থ হওয়ার জ্বালা কিছুটা ভুলতে পারে। এতগুলো মানুষের মনের জ্বালা ভোলানোর সেই সম্ভাবনাটা তৈরি করতে পেরে প্রিয়র মনটাও কিছুটা হালকা হয়।যাত্রার দিন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পর যাত্রাদলের ম্যানেজারকে জানিয়ে দেওয়া হয়। স্বস্তি ফেরে সবার মনে। এত সহজে এই রকম একটা সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়ায় , খুশি মন নিয়ে সেদিনের মতো বাড়ি ফিরে যায় সবাই। পরদিন ডাক্তারবাবু , আর্যদা এবং অন্যান্য সাংবাদিকদের নবান্ন আর যাত্রা দেখতে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করতে প্রিয় আর ঋজু বোলপুরে যায়।কথাটা শুনেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন ডাক্তারবাবু। স্মৃতিমেদুর গলায় বলে উঠেন , ওঃ গ্রামের যাত্রার সঙ্গে কত যে স্মৃতি জ্বড়িয়ে আছে তার ঠিক নেই। আমিও তো  গ্রামেরই ছেলে ছিলাম। অনেক বই করেছি সে সময়। সোনার প্রতিমা , শ্মশান চিতায় প্রিয়া , মসনদ কার , অচল পয়সা, মা-মাটি-মানুষ। মা-মাটি -মানুষে আমি কামালের রোল করেছিলাম। ওঃ কি ডায়লগ!  এখনও মনে আছে --- ' ওরে গাঁয়ে ছায়া আছে , মায়া আছে , মাটিতে শষ্যের সম্ভাবনা আছে।' আজ হয়তো অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সত্যিই একদিন গাঁয়ে অনেক কিছু ছিল।
প্রিয় অবাক হয়ে ডাক্তারবাবুর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। চেম্বারে চশমা চোখের রাশভারী ডাক্তারবাবুর মনের ভিতরে যে এইরকম একটি সংস্কৃতি মনস্ক যাত্রা মোদী মন লুকিয়ে ছিল তা এতদিন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে।
ডাক্তারবাবু তখনও সমানে বলে চলেছেন -- শুধু কি তাই ? কোথাও যাত্রার খবর পেলেই ছুটতাম। সে সময় কলেশ্বরের শিবরাত্রির মেলায় সংবদ্ধ ক্লাব , লোকপাড়ায় প্রতিবাদ ক্লাব , ষাটপলশা আমরা ক'জন , রামনগরে শচী মাস্টারের উদ্যোগে কলকাতার দলের যাত্রা হত। উঃ কি সব যাত্রা।' নটী বিনোদিনী ', ' মীরার বধুয়া ',  ' মেয়ে নয় মনসা ' ব্রজের বাঁশরী, অচল পয়সা ' ' চাটুজ্জে - বাড়ুজ্জে' ' লাল গোলাপ ' আরও কত কি ? আর অভিনেতা - অভিনেত্রীরা সব তেমনি ছিলেন। অরুণ দাসগুপ্ত আর বীণা দাসগুপ্তার জুটির তো তুলনা ছিল না। বীণা দাসগুপ্তার গানে মন মোহিত হয়ে যেত। তেমনি অভিনয় ছিল বেলা সরকারের। ভিলেন চরিত্রে শেখর গাঙ্গুলির অভিনয় তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কলেশ্বরে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জিত মল্লিক এসেছিলেন সেইসব যাত্রায়। সেবার লোক ভেঙে পড়েছিল প্যান্ডেলে। কলেশ্বরে প্রতি বছরই নির্মল মুখোপাধ্যায়ের যাত্রা ছিল বাঁধা। প্রথমদিকে নির্মলবাবু ছিলেন সুশীল নাট্য সমাজ অপেরায়। সেই সময় তার বিপরীতে নায়িকার অভিনয় করতেন শিখা বোস। পরে নির্মলবাবু নিজেই মুক্তাঙ্গন যাত্রা সমাজ নামে যাত্রাদল খোলেন। সেই দলেই নায়িকা হিসাবে মীনাকুমারীর আবির্ভাব ঘটে। সাধারণত নিজেই যাত্রা পালা লিখতেন নির্মলবাবু। সেই সব পালার নাম ছিল ' সিঁদুর নিও না মুছে, ' সংসার পেল না সতী ',  ' মরমী বধু ', ' লালু ভুলু ' আরও কত সব বই। ওইসব যাত্রায় মেয়েরা তো বটেই ছেলেরা চোখের জল ধরে রাখতে পারত না। কোনরকমে টিকিটের টাকাটা যোগাড় হলেই আমরা মুড়ি বেঁধে নিয়ে ছুটতাম যাত্রা প্যান্ডেলে। ৪/৫ কিমি রাস্তা সাইকেল কিম্বা হেঁটেই মেরে দিতাম। 
বাড়ি ফিরতে রাত ভোর হয়ে যেত। কয়েকদিন ধরে যাত্রা নিয়েই চলত আলোচনা। ওইসব অভিনেতাদের অনুকরণে অভিনয় করার চেষ্টা করতাম।
ডাক্তারবাবুর কথা শুনে অবাক হয়ে যায় প্রিয়। কবেকার সব ঘটনা ছবির মতো তুলে ধরলেন।ডাক্তারবাবু থামতেই সে জিজ্ঞেস করে ---  ওইভাবে যাত্রা দেখে বেড়াতেন পড়াশোনার ক্ষতি হোত না ? বাড়িতে বকাবকি করত না ? 
---- না হে না , এখনকার মতো তখন বাবা-মায়েরা অত কেরিয়ার সর্বস্ব ছিলেন না। বরং তারা নাটক - যাত্রা দেখা, খেলাধুলো করতে উৎসাহই যোগাতেন। আর তাতে ছেলেমেয়েরা বখে যায় তা ভাবতেন না। তারা যে খুব একটা ভুল ভাবতেন না তার প্রমাণ তো আমি। ওইসব করেও একটা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে একটা ডাক্তারি পাস তো দিয়েছি। 




                               যাত্রার কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো নষ্টালজিক হয়ে ওঠেন ডাক্তারবাবু। স্মৃতির দরদালানের দরজা যেন দুহাট খুলে যায় তার। নেহাৎ দু'জন রোগী এসে পড়ায় থামতে হয় তাকে।পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দিয়ে বলেন - শোন দিনের বেলা রোগীদের ফেলে নবান্নে যেতে পারব না। তবে আর্যকে নিয়ে যাত্রা দেখতে ঠিক হাজির হব।
--- কিন্তু টাকা কেন ? আপনারা যাবেন সেটাই আমাদের কাছে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।
----- আরে ধর তো। কি কষ্ট করে যে এইসব অনুষ্ঠান করতে হয় তা আমি ভালো করেই জানি।
বলে তার হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়ে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চেম্বারে ঢুকে যান ডাক্তারবাবু। অগত্যা ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে বেড়িয়ে প্রিয়দের আর্যদার বাড়ি অভিমুখে রওনা দিতে হয়। নবান্ন আর যাত্রার কথা আগেই আর্যদাকে বলেছিল প্রিয়। আর্যদা দিনটা ডায়রিতে নোট করেও রেখেছিলেন। তাই আজ পরিবর্তিত দিনের কথাটা জানাতেই আর্যদা বলেন , সেকি আপনাদের না পান্ত নবান্নের দিনে যাত্রা হওয়ার কথা ছিল ? আমি তো সেই দিনটাই ধরে বসেছিলাম।
প্রিয় বলে , হ্যা প্রথমদিকে সেরকমই ঠিক ছিল। পরে প্রসাদ মোড়লের নোংরামির জন্য দিনটা বদলাতে হল।
--- কেন আবার কি নোংরামি করল লোকটা ? অবশ্য নোংরা লোকেরা নোংরামি ছাড়া থাকতেও পারে না।
-- তা যা বলেছেন।
ঘটনার কথা সবিস্তারে আর্যদাকে খুলে বলে প্রিয়। সব শুনে আর্যদা বলেন -- আচ্ছা হয়েছ, একেই বলে শঠে শাঠাং সমাচারেৎ।
ডাক্তারবাবুর মতোই আর্যদাও জোর করে প্রিয়র হাতে ৫০০ টাকা গুঁজে দিয়ে বলেন -- অন্য সাংবাদিকরা কি করবে জানি না। আমি আর ডাক্তারবাবু যাবই। তবে এসেছেন যখন তখন না হয় নিজের মুখেই সবাইকে একবার বলে যান। প্রেসক্লাবেই সবাইকে পাওয়া যাবে।  চলুন দেখি। 
তারপর আর্যদার মোটরবাইকে তারা পৌঁছোয় প্রেস কর্নারে। সেখানে তখন তাদের গ্রামে যাওয়া প্রায় সমস্ত সাংবাদিকই ছিল।তাদের দেখে তারা বলে ওঠেন -- কি ব্যাপার দাদা , আপনাদের অনশন তো দেরি আছে। সেদিন আমরা ঠিক পৌঁচ্ছে যাব। 
প্রিয় বলে , সে তো যেতেই হবে। আপনারা পাশে ছিলেন বলে আমরা এতদুর এগোতে পেরেছি।  আপনাদের ভরসাতেই অনশনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু আজ আমরা নবান্ন আর যাত্রার নিমন্ত্রণ করতে এসেছি। আপনারা গেলে আমরা খুব আনন্দ পাব।
প্রিয়র কথা শুনে প্রেস কাউন্সিলের সভাপতি উমাশংকর মজুমদার বলেন, খুব ভালো লাগল আপনাদের কথা শুনে।কাজ ছাড়া তো কেউ আমাদের কথা খুব একটা মনে রাখে না। কোন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করলেও তার পিছনে থাকে খবর করানোর উদ্দেশ্য। আপনারাই কেবল আত্মীর মতো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ জানাতে এলেন। সবাই যেতে পারব কিনা জানি না। কিন্তু কেউই এই আন্তরিকতার কথা  ভুলতে পারব না।
-- আপনাদের কথাও আমরা কোনদিন ভুলতে পারব না।



                          সাংবাদিকদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে গ্রামে ফেরে তারা। গ্রামে ঢুকতে কানে আসে ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দ। ঢেঁকির শব্দ নবান্নের কথা মনে পড়িয়ে দেয় প্রিয়কে। নবান্নের আগে ঢেঁকির শব্দে সরগরম হয়ে ওঠে গ্রাম। ভোর থেকে গভীর রাত্রি পর্যন্ত ঢেঁকিতে চালগুঁড়ো তৈরির ধুম পড়ে যায়।মহিলারা স্নান করে , ধোপদুরস্ত কাপড় পড়ে চালগুঁড়ি কুটতে ঢেঁকিশালে ঢুকে যান। পাশের গ্রামে আটা - চালগুঁড়ি তৈরির মেশিন বসেছে। এখন অনেকেই সেই মেশিন থেকে চালগুঁড়ি তৈরি করিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের গ্রামের মহিলাদের মেশিনে তৈরি চালগুঁড়ি না পছন্দের। তাদের যুক্তি মেশিনে তৈরি চালগুঁড়ির স্বাদ নাকি ঢেঁকিতে তৈরি গুঁড়ির মতো উৎকৃষ্ট নয়। ঢেঁকি ছাঁটা গুঁড়িতে জিলিপি - ছানাবড়াও ভাল হয়। আচমকা ঢেঁকির শব্দ ছাপিয়ে বেজে ওঠে মাইক। প্রসাদ মোড়লের খামার বাড়ি থেকে তারস্বরে পঞ্চরসের প্রচার শুরু হয়। খামার বাড়িতে বহিরাগত বেশ কিছু লোককে ঘোরাফেরা করতেও দেখা যায়।ওরা যে প্রসাদ মোড়লের বাড়িতে নবান্নের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছে তা বেশ বোঝা যায়। রাত পোহালে তাদেরও নবান্ন। তাই মাথায় মাথায় চিন্তা প্রিয়দের। এমনিতেই নবান্নের হাজারও ঝক্কি থাকে। তার উপরে এবারে প্রসাদ মোড়লের জন্য নবান্নের দিনে যাত্রা করতে হচ্ছে তাদের।দম ফেলার ফুরসতটুকু নেই বললেই চলে।প্রসাদ মোড়লের উপরে খুব রাগ হয় প্রিয়র। তার জন্যই এবারে তাদের নবান্নের আনন্দটা মাটি হয়ে গেল। অন্যান্যবার তারা নিজ নিজ বাড়িতে চালগুঁড়ো গোলা মুখে দিয়ে কার বাড়িতে ভাল মিষ্টি হয়েছে , কাদের বাড়িতে গাছ পাকা কলা আছে খোঁজ করে করে খেয়ে বেড়ায়। নবান্নে মিষ্টি তৈরির জন্য গ্রামের মানুষ মাসখানেক আগে থেকে দুধ মেরে চাঁচি জমিয়ে রাখে। নবান্নের  
আগের রাতে নিজ হাতে ছানাবড়া আর জিলিপি তৈরি করে। কি স্বাদ সেই মিষ্টির ! একটা খেলেই আর একটা খেতে ইচ্ছে করে। তেমনি গাছেই বস্তা জড়িয়ে  রেখে কলা পাকানো হয়। সে কলার স্বাদই আলাদা। ওই লোকটার জন্যই এবার সেই স্বাদ নেওয়া হয়তো তাদের আর হবে না। শুধু কি রসনা তৃপ্তি ?  খাওয়াদাওয়ার ফাঁকেফাঁকে চলত ছোটদের সঙ্গে বড়দের কবাডি কিম্বা ডাংগুলি খেলার প্রতিযোগিতা। বয়স্করা মেতে উঠতেন তাসে। মেয়েরা লুডো কিম্বা গল্পে। সে সবও এবার ওই লোকটার জন্যই হারাতে হচ্ছে তাদের। রাগের টানে আচমকাই প্রিয়র মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে -- শয়তান একটা।



         ( ক্রমশ ) 





নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---




2 comments:

  1. Durdanta hoyeche lekhar.....

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ । কিন্তু আপনার নামটা জানা যাচ্ছে না । জানাবেন প্লিজ ।

    ReplyDelete